বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকূলে প্রায় সময় ভেসে আসে মৃত কচ্ছপ। কিন্তু গত কয়েকদিনে কচ্ছপের মৃত্যুর মিছিল নেমেছে। এক সপ্তাহে অন্তত শতাধিক মৃত কচ্ছপ উপকূলে ভেসে এসেছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তার মধ্যে তিন দিনে ভেসে এসেছে ৭০টি মৃত কচ্ছপ। কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের সেন্টমার্টিন, সোনাদিয়া ও কুতুবদিয়াসহ বিভিন্ন উপকূলে এসব মৃত কচ্ছপ ভেসে আসে। চলমান প্রজনন মৌসুমে সৈকতে ডিম পাড়তে এসে কচ্ছপগুলো মারা পড়ছে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কচ্ছপের এমন অস্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন কক্সবাজারে অবস্থিত বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানী। গত তিন দিন কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের টেকনাফের সাবরাং থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত সরেজমিনে গিয়ে ৭০টি কচ্ছপের মৃতদেহ দেখতে পেয়েছেন এই বিজ্ঞানী দল। এসব কচ্ছপের বেশিরভাগ ছিল অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙা সামুদ্রিক কচ্ছপ। অধিকাংশ কচ্ছপের পেটে ডিম ছিল বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
গত বছর প্রজনন মৌসুমের একই সময়ে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্ট মৃত মা কচ্ছপ ভেসে এসেছিল। গত বছরের তুলনায় এ বছর মারা পড়ার হার অস্বাভাবিক বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বোরি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শিমুল ভূঁইয়া জানান, গত শনিবার, রোববার ও গতকাল সোমবার ভেসে এসেছে ৭০টি মৃত কচ্ছপ। এর আগে ৪ জানুয়ারি থেকে ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন পয়েন্টে ভেসে আসে ১৪টি মৃত কচ্ছপ। গত ২৫ দিনে ৮৮টি মৃত কচ্ছপ ভেসে আসার তথ্য পাওয়া গেছে। এছাড়া সোনাদিয়া উপকূলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মৃত কচ্ছপ ভেসে আসতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, শনিবার টেকনাফের সাবরাং জিরো পয়েন্ট থেকে উখিয়া উপজেলার রূপপতি পর্যন্ত ১২টি এবং রোববার দ্বিতীয় দিনে রূপপতি থেকে সোনার পাড়া পর্যন্ত ৪৯টি, পেঁচারদ্বীপ থেকে হিমছড়ি পর্যন্ত সাতটি এবং সোমবার একই এলাকা থেকে দুটি কচ্ছপের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার হওয়া কচ্ছপের সবগুলো অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙা কচ্ছপ জানিয়ে বোরির এই বৈজ্ঞানিক কমকর্তা বলেন, মৃত কচ্ছপের মধ্যে পুরুষ ও স্ত্রী কচ্ছপ রয়েছে। এসব কচ্ছপ এক থেকে দুদিন বা তারও আগে মারা পড়েছে। কিছু কচ্ছপের মৃত্যু এক সপ্তাহ বা ১০–১২ দিন আগে হয়েছে। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে মৃত কচ্ছপের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মৃত্যুর কারণে সম্পর্কে তিনি বলেন, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম। এ সময় সমুদ্র উপকূলের বালিয়াড়িতে ডিম দিতে আসে মা কচ্ছপ। কচ্ছপগুলো জেলেদের জালে আটকা পড়ে, সমুদ্রে বড় নৌযানের ধাক্কা বা এবং অন্য কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মারা পড়ছে। অলিভ রিডলি বা জলপাই রঙের সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজননক্ষেত্র কক্সবাজারের সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন সমুদ্র উপকূলের সৈকতের বালিয়াড়ি। প্রজনন মৌসুমে (নভেম্বর থেকে মার্চ) এ প্রজাতির কচ্ছপ দল বেঁধে হাজারো মাইল পাড়ি দিয়ে বালিয়াড়িতে ডিম পাড়তে আসে। কিন্তু দুই দশক ধরে এদের প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস হওয়া এবং আসার পথে নানা বাধায় প্রতি বছর মারা পড়ছে স্ত্রী কচ্ছপ।
কক্সবাজার উপকূলে কচ্ছপের প্রজনন ও সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করছে নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। এই সংস্থার ২০০৩ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, কক্সবাজার উপকূলের ৫২ পয়েন্টে সামুদ্রিক মা কচ্ছপ ডিম দিতে আসত। ওই সময় এসব পয়েন্ট মা কচ্ছপের কাছে অত্যন্ত নিরাপদ পয়েন্ট ছিল। তবে এখন এই সংখ্যা ৩০ থেকে ৩২ ঠেকেছে।
নেকমের উপ–প্রকল্প পরিচালক ড. শফিকুর রহমান জানান, মা কচ্ছপের ডিম দেওয়ার সময় সাধারণত নভেম্বর থেকে শুরু হলেও এখন এপ্রিল–মে পর্যন্ত চলে। রাতের বেলায় নির্জন উপকূলে এসে গর্ত তৈরি করে ডিম দেয়। এরপর মা কচ্ছপ ফিরে যায় সাগরে। ৬০ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে ডিম থেকে বাচ্চা জন্ম নেয়। এরপর বাচ্চাগুলো গর্ত থেকে বের হয়ে সাগরে ফিরে। কচ্ছপের ডিম পাড়ার স্থানগুলো কুকুর–শিয়াল বা অন্য কোনো প্রাণী যাতে নষ্ট করতে না পারে তার জন্য পাহারা ও ঘেরাবেড়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, কক্সবাজারের সোনাদিয়া থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত সৈকতের নির্জন এলাকায় কচ্ছপ দল বেঁধে ডিম দিত। অপরিকল্পিত পর্যটন, অবকাঠামো নির্মাণ, সৈকতে আলোকায়ন, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়াসহ নানা কারণে কচ্ছপ প্রজনন মৌসুমে বাধা পাচ্ছে।