একুশ চেতনার উৎস, প্রেরণার উৎস

নাসের রহমান | বৃহস্পতিবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

বাংলা ভাষা বাঙালির ভাষা। পূর্ব ও পশ্চিম দুই বাংলার মানুষের ভাষা বাংলা। বাংলা তাদের মায়ের ভাষা, প্রাণের ভাষা। তাই প্রাণ দিয়ে ধরে রেখেছে মায়ের ভাষাকে। তাও আবার পূর্ব বাংলার দামাল ছেলেরা। খড়গ নেমে এসেছিল ভাষার উপর। রুখে দিয়েছে সর্ব শক্তি দিয়ে। শাসক চক্র ভাষাকে ক্ষত বিক্ষত করতে চেয়েছিল, পারেনি। রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। এরপর শহীদ মিনার গড়ে উঠে পূর্ব বাংলায়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালন করতে থাকে বাঙালি। এ দিনটি বাঙালির প্রেরণার উৎস হয়ে যায়। শুধু ভাষার মধ্যে আর সীমাবন্ধ থাকে না। এর মাঝে বাঙালি নিজের পরিচয় খুঁজে পায়। অধিকার আদায়ের কথা ভাবতে পারে।

পৃথিবীর আর কোনও দেশে শহীদ মিনার নেই। একমাত্র এ দেশের সর্বত্র শহীদ মিনার দেখা যায়। ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালির চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ লাভ করে। এ জন্য বিজয় দিবস আমাদের গর্বের দিন, গৌরবের দিন। দীর্ঘ অনেক বছর ধরে ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসে। এখন আর শুধু শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয় না। ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে এই দিনটি সারা বিশ্বে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারির বীর শহীদদের ভাষার জন্য যে আত্মহুতি দিয়েছে তা বিশ্ববাসী মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করবে। এখন শহীদ দিবস আর শোক দিবস বা দুঃখের দিন নয়, বাঙালির জন্য একটি গৌরবের দিন। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় ১৯৩ দেশে ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

২১শে ফেব্রুয়ারির মধ্য দিয়ে বাঙালির অর্জনের শেষ নেই। কিন্তু বাংলা ভাষার উৎকর্ষতা ও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বাংলা ভাষার যে প্রমিত রূপ তার যে সৌকর্য ও মাধুর্য তা যেন আগের মত আর নেই। মুখের ভাষা আর লেখার ভাষার মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। অঞ্চল ভেদে মুখের কথা ভিন্ন ভিন্ন রকম হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু লেখার ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন রূপ থাকা প্রয়োজন। পত্রপত্রিকায় বা বইপত্রে বাংলা ভাষার ভিন্নতা দেখা যায়। বাক্য গঠনে শব্দ চয়নে নানা অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। সবচেয়ে বেশি আশঙ্কার বিষয় হলো বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে নাটক বা অন্যান্য অনুষ্ঠানে যেসব সংলাপ বা কথোপকথন শোনা যায় তা এদেশের কোনো অঞ্চলের ভাষার সাথে মিলে না। অদ্ভুত সব বাক্য চয়ন করে নাটকের সংলাপ বলা হয়। সস্তা বিনোদন দিতে গিয়ে ভাষাকে কেউ বিকৃতভাবে উপস্থাপন করতে পারে না। এতে রসবোধ বাড়ে না বরং ভাষার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। এভাবে চলতে থাকলে একসময়ে ভাষার সত্যিকার রূপটা খুঁজে পাওয়া দুরূহ হয়ে যেতে পারে।

ভাষা আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করা। স্বাধীনতার পর বাংলাকেই রাষ্ট্রভাষা করা হয়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার নামকরণও বাংলায় করা হয়। সাইনবোর্ডগুলো বাংলা বর্ণমালায় লেখা হয়। সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। নানা ক্ষেত্রে ইংরেজির পরিবর্তে বাংলা ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাংলা ব্যবহারে সীমাবন্ধতা থাকলেও ধীরে ধীরে তা কাটিয়ে উঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সরকারি বেসরকারি সব ক্ষেত্রে বাংলা দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্কুলে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়ের বইগুলো বাংলায় প্রণয়নের উপর গুরুত্বারোপ করা হয়। কয়েক বছরের মধ্যে শিক্ষার সর্বোচ্চ পর্যায়েও বাংলা ভাষায় পাঠদান সম্ভব হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিয়ে বিশ্ব সভায় মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর বাংলা ভাষার অগ্রযাত্রা সেভাবে আর অব্যাহত থাকেনি। বাংলার চেয়ে ইংরেজিকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। ফলে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের যে ধারাবাহিকতা শুরু হয়েছিল তা আর বেশি দূর এগিয়ে যায়নি।

বিশ্বয়ানের এ যুগে ক্ষেত্র বিশেষে ইংরেজিকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন রয়েছে। তবে কোনও অবস্থায় বাংলাকে বাদ দিয়ে নয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর বাংলা ভাষাবাসীর দায়িত্ব আরো বেড়ে যায়। বাংলা বাঙালির অন্যতম মাতৃভাষা হলেও এদেশে আরো মাতৃভাষা রয়েছে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের মাতৃভাষা, বিশেষ করে চাকমা মারমা ও ত্রিপুরা ভাষা। আরো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী থাকলেও এ তিনটি গোষ্ঠীর মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এরা মুখে মুখে মাতৃভাষায় কথা বললেও এর লেখ্যরূপ নেই বললে চলে। এ তিনটি ভাষায় শিশুদের উপযোগী করে বই ছাপানো হয়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শ্রেণিকক্ষে মাতৃভাষার এসব বই পড়ানো হচ্ছে। শিশুরা যেন বর্ণমালা থেকে শুরু করে নিজ ভাষায় পড়তে পারে সে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এসব শিশুরা কিন্তু নিজের ভাষায় ছড়া বলতে পারে, গান গাইতে পারে। নিজের মাতৃভাষার সাথে অপরের মাতৃভাষাকে সম্মান দেখাতে হবে। একুশ আমাদের সে শিক্ষা দেয়। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসহ সবার মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

ফেব্রুয়ারিকে ভাষার মাস বলা হয়। এ মাস এলে বাংলা ভাষা নিয়ে আয়োজন শুরু হয়। অমর একুশের বই মেলা হয়। অনেক বড় বই মেলা। অনেক বই প্রকাশিত হয়। দেশের অনেক জায়গায় বই মেলা হয়। মেলায় বই বেচাকেনা হয় প্রচুর। কিন্তু বইগুলো মানসম্পন্ন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। তরুণ প্রজন্মের বই পড়ার অভ্যাস নিয়ে কথা আসে। বই না পড়লে জ্ঞানের পরিধি কখনো বাড়ানো যায় না। বই মননশীলতা তৈরীতেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ভাষার মাসেও নানা কর্মসূচির মধ্যে তরুণদের বই পড়ায় মনযোগী করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। বই মেলা এখন আনন্দ উৎসবের জায়গা হয়ে উঠেছে। বই প্রেমীদের মিলন মেলা হলেও বইয়ের প্রতি আকর্ষণ সেভাবে নেই। মেলায় গিয়ে নতুন বই দেখার চেয়ে মোবাইলে সেলফি তোলায় ব্যস্ত থাকে বেশি। তরুণ প্রজন্ম পড়ার মাঝে যদি আনন্দ খুঁজে পায় নিশ্চয়ই তারা বই পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। বই পড়ার প্রতি এ আগ্রহ শুধু ফেব্রুয়ারি মাসে নয় যেন সারা বছর ধরে চলতে থাকে। একসময়ে স্লোগান ছিল ‘বই হউক নিত্য সঙ্গী’। এখন মোবাইল আমাদের নিত্য সঙ্গী হয়ে উঠেছে। মোবাইলেও সহজে বই পড়া যায়। তবে বই থেকে বই পড়ার আনন্দ আলাদা। আমরা চাই তরুণ প্রজন্ম বই পড়ার আনন্দে মেতে থাকুক। এবারের ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের প্রত্যাশা একুশের মূল চেতনা বাংলা ভাষার সর্বজনীনতার দিকে এগিয়ে চলা।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাষা আন্দোলন ও কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস
পরবর্তী নিবন্ধ১০ লাখের বেশি ইউক্রেনীয় শরণার্থীর বুলগেরিয়ায় প্রবেশ