ভাষা আন্দোলন ও কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস

নেছার আহমদ | বৃহস্পতিবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

পূর্ববাংলার এ অসামপ্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রাখার স্বার্থে এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিকে জোরদার করার লক্ষ্যে চট্টগ্রামের প্রগতিশীল সংগঠন ‘সাংস্কৃতিক বৈঠক’ এবং ‘প্রান্তিক নবনাট্য সংঘ’ যৌথভাবে ১৬১৯ মার্চ ১৯৫১ ইং হরিখোলার মাঠে দেশের প্রথম সাংস্কৃতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন অধ্যাপক আবুল ফজল। এ সম্মেলনের মূল সভাপতি ছিলেন আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ। সম্মেলনের অফিস ও সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে চৌধুরী হারুনুর রশিদ ও মাহবুব উল আলম চৌধুরী।

আন্দোলনের প্রয়োজনে ১৯৪৮ সালে গঠিত মূলনীতি বিরোধী সংগ্রাম কমিটিকে পরিবর্তীত ও পরিবর্ধিত করে ‘চট্টগ্রাম জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠন করা হয়। ১৯৫২ এর ৪ঠা ফেব্রুয়ারি আন্দরকিল্লাস্থ তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ অফিসে এ পরিষদ গঠন করা হয়।

প্রত্যেকদিন বাংলা, ইংরেজি ও উর্দুতে পোস্টার লিখে রাতে গণতন্ত্রী দল ও যুবলীগের কর্মীরা শহরের অলিতে গলিতে পোস্টার লাগিয়ে এবং অ. . . . বর্ণ লেখা নিয়ে মিছিল বের করে। একই পদ্ধতিতে ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি রাত দিন পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে পোস্টার লাগানো হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচী অনুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে পূর্ণদিবস হরতাল পালিত হয়। সমস্ত দোকানপাট, অফিস, আদালত ও স্কুল কলেজ সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। চট্টগ্রাম শহরের সর্বস্তরের জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতালে অংশ গ্রহণ করে। এ দিন লালদিঘি ময়দানে পূর্বনির্ধারিত জনসভায় যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা হতে খন্দকার ইলিয়াস পূর্বাহ্নে চট্টগ্রাম এসে পোঁছান। তিনি ঢাকার সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করে জানতে পারেন যে, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার অজুহাতে ঢাকায় ছাত্র মিছিলে গুলি চালানো হয়েছে। এতে বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র জনতা শহীদ হয়েছেন। এ খবর চট্টগ্রামে পৌঁছার সাথে সাথে গোটা শহর বারুদের মতো জ্বলে উঠে। সাথে সাথে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণে সকল মিছিল পূর্ব নির্ধারিত লালদিঘির জনসভায় যোগদেন। এ সভায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা না দেয়া পর্যন্ত আপোসহীন সংগ্রামের সংকল্প ঘোষণা করা হয়। সভায় প্রায় ৪০ হাজারেরও অধিক লোকের সমাগম হয়। তাই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে চট্টগ্রামের এই জনসভার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ২১ ফেব্রুয়ারিতে মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন জ্বর ও জলবসন্তে আক্রান্ত। রোগশয্যায় শুয়ে বিকেলে তিনি ঢাকার গোলাগুলির খরব শুনেন এবং এতে তিনি দারুণভাবে ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হন। অসুস্থ অবস্থায় মুখে মুখে তিনি রচনা করেন ১৭ পৃষ্ঠার দীর্ঘ এক কবিতা। যা ননী ধর সাথে সাথে লিখে ফেলেন। ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ নামের এ কবিতাটি একুশের প্রথম কবিতা। এটি সেদিনই সন্ধ্যা ৭ টায় লালদিঘি ময়দানের জনসভায় চৌধুরী হারুন অর রশীদ পাঠ করেন। একুশের এই অমর কবিতাটি ছাপানোর ব্যবস্থা করেন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের স্বত্বাধিকারী আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার। এ কবিতাটি প্রকাশের সাথে সাথে পুলিশ প্রেসটি বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করে। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে তালা ঝুলিয়ে দেয় এবং প্রেস থেকে প্রকাশক দবির আহমদকে গ্রেফতার করে। এরপর কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, চৌধুরী হারুন অর রশিদ এবং কামাল আহমদের নামে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি ও মালামাল ক্রোকের নির্দেশ দেয়া হয়। পরবর্তীকালে এই সরকারি মামলা চট্টগ্রাম সদর উত্তর মহকুমার আদালতে ১৯৫২ হতে ১৯৫৩ সাল অবধি চলে। মুসলিম লীগ নেতা নুর আহম্মদ চেয়ারম্যান, .কে খাঁন এই মামলা তুলে আনার জন্য বহু চেষ্টা তদবির করেন। কিন্তু বিচারে শেষ পর্যন্ত মুদ্রাকর কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের দবির আহমদকে ছয় বছর সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। চৌধুরী হারুন অর রশিদকে বেকসুর খালাস দেয়া সত্ত্বেও চট্টগ্রাম জেল হতে রাজশাহী জেলে স্থানান্তর করে তাঁর উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। এ্যাডভোকেট কামাল আহমদ ও মাহবুব উল আলমকে রফিকউদ্দিন সিদ্দিকীর হস্তক্ষেপে মোকদ্দমার দায় হতে নিষ্কৃতি দেয়া হয়।

কোহিনূর প্রেসের দবির উদ্দিন আহমদের কারাদণ্ড হওয়ার সময় তিনি পলাতক ছিলেন। পরে তিনি গ্রেফতার বরণ করেন। ভাষা আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাশেমকে দবির উদ্দিন আহমদের কারাভোগের ঘটনাটি খুবই মর্মাহত করে। ১৯৫৪ সালে এম এল এ নির্বাচিত হওয়ার পর এপ্রিল মাসে তাঁর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল দবির উদ্দিনের শাস্তি মওকুফের জন্য দেন দরবার করেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন আবুল কাশেম সাবজজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মো. ফয়েজ ও মাহফুজুল হক। তাঁরা কয়েক দফা আইন মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের আইন সচিবকে দবির উদ্দিন আহমদের মুক্তিদানের জন্য রাজি করান। (সুত্র ঃ সাপ্তাহিক সৈনিক, ১৯ এপ্রিল ১৯৫৫) এভাবেই আইন সচিব উদ্যোগী হয়ে দবির উদ্দিন আহমদের শাস্তির পরিমাণ কমিয়ে মাত্র ৬ মাস শাস্তিভোগের পর তাঁকে মুক্তি দেন।

চট্টগ্রামের কৃতী পুরুষ আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার চট্টগ্রামের প্রথম মুসলিম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে খ্যাত। সরকারি চাকরির প্রলোভন এবং অনেক লোভনীয় পদ ও আর্থিক সুবিধা প্রস্তাব প্রত্যাখান করে ১৯৩২ সালে সরকারি চাকরি হতে ইস্তফা দেন এবং প্রতিষ্ঠা করেন কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। এটি ছিল চট্টগ্রামের প্রথম বিদ্যুৎ চালিত প্রেস বা ছাপাখানা। এ ছাপাখানা চট্টগ্রামের প্রকাশনা শিল্পে বিপ্লবের সূচনা করে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত এ প্রেস সে সময়ে চট্টগ্রামের সাহিত্যপ্রেমীদের মিলন কেন্দ্রে পরিণত হয়। আন্দরকিল্লার ঘাটফরহাদবেগের রাস্তার মুখে জেমিসন হাসপাতালের আগে পুরানো দোতলা দালানটি এখনো স্বমহীমায় দণ্ডায়মান। এ দালানটি ছিল কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। উপরে আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার পরিবার পরিজন নিয়ে বসবাস করতেন এবং নিচে প্রেসের কাজ চলত।

ভাষা আন্দোলন ও একুশের কবিতা ছাপানোর বিষয়ে দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম. এ মালেক বলেন, ‘‘আমার বাবা আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার নিজের প্রফেশন ছেড়ে লাইব্রেরি ও প্রেস করেছিলেন ত্রিশের দশকে পশ্চাদ পদ মুসলিম সমাজকে শিক্ষার মাধ্যমে এগিয়ে নিতে। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনে কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতাটি তিনি ছেপে ছিলেন অসীম সাহসকিতায়। বায়ান্নের ২২ ফেব্রুয়ারি তারিখ রাতেই কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে শুরু হয়ে যায় কবিতাটির প্রকাশের কার্যক্রম। গভীর রাতে কম্পোজ ও প্রুফের কাজ যখন সমাপ্ত প্রায় তখন সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী হঠাৎ হামলা শুরু করে প্রেসে। কিন্তু প্রেস কর্মচারীরা অতীব দ্রুততার সাথে সম্পূর্ণ কম্পোজ ম্যাটার এমনভাবে লুকিয়ে রাখে যে, তন্ন তন্ন করে খোঁজাখুঁজির পরও পুলিশ তার খোঁজ পায়নি। ফলে ‘কাঁদিতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ প্রকাশনার কাজ শেষ করা যায়। পরদিন তেইশ ফেব্রুয়ারি তারিখে লালদিঘির প্রতিবাদ সভায় কবিতাটি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। পাক সরকার কবিতাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে পুলিশ গ্রেফতার করতে আসে। প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী নিজ কাঁধে ছাপার দায়িত্ব তুলে নেন। তাই গ্রেফতার করা হয় প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদকে। অবশ্য পরে তাঁকে জামিন দেয়া হয়েছিল। গোয়েন্দা গল্পের মতোই এ অবদানটি অতি রোমাঞ্চকর মনে হলেও এ সঙ্গে জড়িয়ে আছে দৈনিক আজাদীর অতুলনীয় গৌরব, সাহস ও কৃতিত্বের ইতিহাস’’।

দৈনিক আজাদীর ৩৫ বছর পূর্তি বিশেষ সংকলনে লেখা হয় ‘একুশের প্রথম সংকলন’ মাতৃভাষার দাবিতে শহীদের আত্মদান চট্টগ্রামে সর্বস্তরের মানুষের মাঝে গভীর রেখাপাত করেছিল। মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত কবিতাটি রাতারাতি ছাপিয়ে চট্টগ্রামের কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের ম্যানেজার কম্পোজিটর ও মেশিনম্যানেরা জনগণের ক্ষোভের বাস্তব রূপ দেন। তাঁদের উদ্যোগে ও কায়িক পরিশ্রমে প্রকাশিত এই পুস্তিকাই একুশের প্রথম সংকলন। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের স্বত্বাধিকারী আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের অনুমতিক্রমে প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরী দুর্দান্ত সাহসের সাথে এই কবিতাটি ছাপানোর দায়িত্ব নেন। ২২ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতের পর বিশ্বস্ত দু’জন কম্পোজিটর (যার মধ্যে নুরুজ্জামান পাটোয়ারী একজন) এবং মেশিনম্যানদের সহযোগিতায় ভোর রাতেই দবির আহমদ চৌধুরী পুস্তিকাটি ছেপে বের করে দেন। তিনি পেছনের মলাটে প্রেসের নামটিও ছেপে দেন। উল্লেখ্য প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ পুস্তিকার জন্য কাগজ সরবরাহ করেন। পাকিস্তান সরকার পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস বন্ধ করার আদেশ দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি দবির উদ্দিন চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। প্রকাশনার সব দায়দায়িত্ব দবির আহমদ নিজের কাঁধে নিলে কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে আবার কাজ চলতে থাকে। বিচারে দবির উদ্দিনের ছয় বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। নানা চেষ্টার পর তিনি ছ’মাস কারাবাসের পর মুক্তি পান।

১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে রাজপথ রক্তভেজা হয়েছিল শহীদদের প্রাণ বিসর্জনে। জাতির দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের বিভিন্ন অধ্যায়ে শুধু উপমহাদেশ নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও চট্টগ্রাম সমাদৃত হয়েছে, অনন্য উজ্জ্বল ও প্রত্যয়ী ভূমিকার জন্যে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা “দৈনিক আজাদী’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার। তারই প্রতিষ্ঠিত কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে মুদ্রিত কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা সংশ্লিষ্ট নিদারুণ নিপীড়ন, নির্যাতনের বিষয়সমূহ বর্তমান সময়ে ইতিহাসের স্বার্থে তুলে ধরা খুবই প্রয়োজন।

ভাষা আন্দোলনের সাথে একুশের প্রথম কবিতা এবং এর রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীর সাথে সাথে কোহিনূর ইলেকট্রিকের প্রেসের নাম ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়।

কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস এবং এর স্বত্বাধিকারী আব্দুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে তাঁদের গৌরবময় কাজের জন্য রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি এখন সময়ের দাবি।

তথ্য সূত্র : . এম. এ বর্ণিক রচিত ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে আঞ্চলিক ইতিহাস, . নেছার আহমদ রচিত ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ভাষা আন্দোলনের চট্টগ্রাম, . দৈনিক আজাদী, ৩৫ বছর বর্ষপূর্তির বিশেষ সংখ্যা, ‘হাজার বছর চট্টগ্রাম’।

লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, শিল্পশৈলী

পূর্ববর্তী নিবন্ধমাস জুড়ে প্রীতি, বছর জুড়ে বিরাগ
পরবর্তী নিবন্ধএকুশ চেতনার উৎস, প্রেরণার উৎস