মাস জুড়ে প্রীতি, বছর জুড়ে বিরাগ

সোমা ধর | বৃহস্পতিবার , ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ at ৬:০১ পূর্বাহ্ণ

তোমার কোলে, তোমার বোলে

কতই শান্তি ভালোবাসা

মরি বাংলা ভাষা।

গীতিকার, সুরকার এবং গায়ক অতুল প্রসাদ সেন তাঁর কথায়, সুরে, ছন্দে কালজয়ী এই গান আমাদের উপহার দিয়ে মায়ের মতো করে মায়ের ভাষাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন। এই ভালোবাসা অবিচ্ছেদ্য।

ভাষার মাস এলেই শরীরে বহমান রক্তে যেন আলোড়ন জাগে, শিহরিত হয় তনু, মন, দেহ। মায়ের ভাষার মতো এত মধুর আর কোনো ভাষায় নেই। মাকে জড়িয়ে থেকে যে প্রশান্তি তেমন শীতলতা অনুভূত হয় মায়ের ভাষাতেও। তাই মা এবং মাতৃভাষা একে অন্যের পরিপূরক। শত ক্রোশ দূরে থেকে ও মায়ের টান যেমন ভোলা যায় না, তেমনি মাতৃভাষা, যে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক, বাংলা ভাষাভাষীর মিলন মেলা হবেই হবে। এই আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি।

কিন্তু মাতৃভাষার যথাযথ সম্মান কি আমরা করছি? উত্তরে বলতে হয় ‘না’ । তার একমাত্র কারণ বিদেশী ভাষা প্রীতি আর স্বদেশী ভাষা বিরাগ। যুগের হাওয়ায় গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসতে ভাসতে আমরা যেমন আমাদের শেকড় ভুলে যাই, তেমনি ইংরেজি ভাষাকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে নিজের ভাষাকে করে তুলি দায়সারা। ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারায় যেন আমাদের একমাত্র জীবনের লক্ষ্য। বাংলায় কথা বললে যদি ‘গেঁয়ো’ মনে করে এমন একটি মনোবৃত্তি সবসময় আমাদের মনে। তবে এই মনোবৃত্তি তৈরির নেপথ্যে কাজ করছে একটি শ্রেণি, যারা শিক্ষায় পারদর্শী হয়ে ইংরেজি ভাষাকে রপ্ত করে নিয়েছেন, আবার আর কেউ নিজেকে বিশেষ মর্যাদায় আসীন হতে গিয়েও ইংরেজি ভাষার প্রতি মনোযোগী হয়ে পড়ছেন। জীবিকার প্রয়োজনে তা যুক্তিযুক্ত তা মানছি, কিন্তু তাই বলে যারা এই ভাষা রপ্ত করতে পারছে না, বা করছে না তাদের অসম্মান করার ধৃষ্টতা দেখিয়ে নিজেরই অসম্মান করছেন তা হয়ত তারা বুঝতে পারছেন না। ইংরেজি ভাষা বলতে না পারলেই বাংলায় কথা বলা মানুষের প্রতি আক্রমণ। আমার প্রশ্ন তাদের কাছে। প্রতিটি ভাষায় চর্চার বিষয়, জ্ঞানী, মূর্খ সবাই চর্চা করেন। আসল বিষয়টা হল শুদ্ধতা। আমরা যে ভাষায় কথা বলি না কেন তা কতোটা শুদ্ধ হচ্ছে তাই বিচার্য। এমন অনেক জ্ঞানী গুণী আছেন যারা অনর্গল ইংরেজি ভাষায় কথা বলছেন কিন্তু ‘ক থেকে ঁ পর্যন্ত বলতে বললে আটকে যান, হেসে বলেন অভ্যেস নেই। আমরাও ক্ষমা করে দিয়ে থাকি। কিন্তু কোনো কারণে আমরা ইংরেজিতে কিছু বলতে না পারলে আমাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সমালোচনা করাই আমাদের একমাত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। নিজের অক্ষমতা ছাপিয়ে অন্যের নিন্দে করাতেই আমাদের আনন্দ। বাঙালি জাতির এই নিন্দুক রূপ যেন রক্তের ধারায় মিশে গেছে।

আমার অভিযোগ হলো ইংরেজি ভাষা না জানলেই সে লেখাপড়া জানে না তাতো নয়। হয়তো সে অন্য কোনো ভাষায় আপনার চেয়েও অনেক বেশি পটু। নিজের ভাষার প্রতি প্রেম অনেকেরই আছে। আমার আছে। আমি এখনো বাংলা ভাষার শুদ্ধতা চর্চা করি। বাংলায় কথা বলা মানে কিন্তু আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা নয়। প্রমিত বাংলা আর আঞ্চলিক বাংলায় অনেক পার্থক্য। আমাদের প্রমিত বাংলায় কথা বলতে শিখতে হবে, চর্চা করতে হবে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি আমরা যদি চর্চা করি আমরা আমাদের প্রতিবেশী দেশের চেয়েও ভালভাবে বাংলা চর্চা করতে পারি। পশ্চিমবঙ্গে পা রাখলেই মনে হবে এত সুন্দর বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষ না জানি বাংলার প্রতি তাদের কত জ্ঞান। কিন্তু আমার ভুল ভেঙে যায় তাদের বাংলা বানানের প্রতি ওদাসীন্য মনোভাবে। লিখতে দিন হাজারো বানান ভুল, অথচ কী নিখুঁত উচ্চারণ! তবে দক্ষতাও অনেকের আছে। আসলে কথা বলার ধরনটাই ওদের ভিন্ন যাতে বোঝার উপক্রম নেই তিনি বা তারা সত্যিকারের বাংলায় পারদর্শী কিনা। অঞ্চলভেদে পশ্চিমবঙ্গেও কথা বলায় তারতম্য আছে।

তাই নিজের ভাষাকে রপ্ত করতে হবে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বলনে, কথনে, পঠনে, লিখনে, উচ্চারণে। প্রতিযোগিতা হবে নিজের ভাষায়, দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে নিজের ভাষায়। আমি তাই মনে করি। এবার আসি ফেব্রুয়ারি মাস এলেই ভাষা প্রীতি নিয়ে। সারা বছর ভালো করে বাংলায় কথাও বললাম না অথচ ভাষার মাস এলেই সাদা কালো আচ্ছাদনে নিজেকে জড়িয়ে ভাষা প্রেম দেখানো এখন যেন ফ্যাশন। এক শ্রেণি করছে, আমায়ও করতে হবে এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে অনেকের মাঝে। বাংলাদেশ সরকার সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের কথা বলেন, কিন্তু তার যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে এখনো সন্দিহান।

বাংলার সাথে সাথে দু একটা ইংরেজি না বললে যে কথার মাধুর্য থাকে না, তাই না? আমি যুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু যাঁদের আত্মত্যাগে আমরা এই বাংলা পেলাম আজ সত্যি কষ্ট হয়, ইচ্ছে হয় আবার আন্দোলন হতো তবে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিতাম তাঁদের সাথে। তবে এবারের আন্দোলন হত বাংলাকে মাতৃভাষা জেনেও যারা পর ভাষায় নিজেকে দক্ষ করে মাতৃভাষাকে ভুলে যায় তাদের বিরুদ্ধে।

ভাষা সব সময় বহমান, গতিশীল। বিশ্বে ভাষার ব্যবহার সংক্রান্ত একটি পরিসংখ্যানিক আকর গ্রন্থ ‘এথনোলগ’ এর ২৫ তম সংস্করণ (২০২২) অনুসারে, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৭,১৫১ টি ভাষার ব্যবহার রয়েছে। ভাষার দিক থেকে পৃথিবীতে প্রথম সাতটি ভাষার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ইংরেজি, এর পর রয়েছে ম্যান্ডারিন, হিন্দি, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, আরবী, আর বাংলা। বর্তমানে বাংলা ভাষাতে ২৬ কোটি ৫০ লক্ষেরও বেশি মানুষ কথা বলে। বাংলাদেশে সর্বমোট ৪১ টি ভাষা রয়েছে। বিশ্বের তিনটি দেশে দাফতরিক ভাষা হিসেবে বাংলার প্রচলন আছে ( বাংলাদেশ, ভারত ও সিয়েরা লিওন)

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনই একপর্যায়ে পরিণত হয়েছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে। ধর্ম, বর্ণ, আঞ্চলিকতা ভুলে বাংলা ভাষার যোগসূত্রই এ দেশের আপামর জনসাধারণকে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ‘বাংলা’ নামক নতুন একটি রাষ্ট্রীয় ভাষারও জন্ম হয়েছিল। কিন্তু বায়ান্ন বছর পরে ২০২৩ এ দাঁড়িয়ে নিজের কাছে প্রশ্ন জাগে, আজ বাংলা ভাষাকে আমরা নতুন প্রজন্মের কাছে কতোটা তুলে ধরতে পারছি? এই অক্ষমতা নতুন প্রজন্মের নয়, আমাদের। কেননা আমরা পারিনি তাদের কাছে সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে, তাই তাদের কাছে বাংলার প্রতি আছে বিরাগ, আর বাংলা শুদ্ধ উচ্চারণ ও লিখনে আছে অদক্ষতা। অথচ ইংরেজি ভাষা তাদের কাছে তুলনামুলক ভাবে সহজপাঠ্য।

আমরা বাঙালি। বাংলা আমাদের রক্তে, শিরায়, উপশিরায়। মাতৃভাষাকে ভালবাসতেই হবে, নইলে তো আমরা আমাদের জন্মদাত্রী মা কেও একদিন অস্বীকার করব। তা কী হয়? না কী সম্ভব? মায়ের প্রতি আমাদের যে শ্রদ্ধা তেমন আমাদের ভাষার প্রতিও থাকতে হবে। নিজেকে বিশ্বের কাছে দক্ষ প্রমাণে শেকড় ভুলে গেলে তো চলবে না। যে শিশুটি আজ জন্ম নিল সে কিন্তু জানে না কী বাংলা, কী ইংরেজি। একজন মা তাকে আদরে আদরে মা ডাক শেখান। এর চেয়ে আনন্দের বা গৌরবের ডাক আর কী হতে পারে? আমরা যারা অগ্রজ, আমাদেরই নৈতিক দায়িত্ব আমাদের নতুন প্রজন্ম, আমাদের অনুজ দের সঠিক পথ দেখানো। আমি ইংরেজি শিক্ষা বা জানার বিরুদ্ধাচারণ করছিনা, বরং নিজের মাতৃভাষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে, দক্ষ হয়ে অন্য ভাষায় দক্ষতা অর্জনের কথা বলছি। এতে নিজেও যেমন সমৃদ্ধ হয়ে উঠবো, তেমনি ভাষাকে সম্মান প্রদর্শন ও করতে পারবো। আমরা বাংলা বলতে পারি না বা বাংলায় একটি শুদ্ধ বাক্য লিখতে পারি না। এই লজ্জা আমাদের। যাই বলব, যাই লিখব, শুদ্ধ বলব,এই কায়মনোবাক্যে আমাদের চলার পথ পরিশীলিত হবে। তাই শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলেই লোকদেখানো ভাষা প্রীতি না দেখিয়ে জীবনব্যাপী দেখিয়ে যাব। বিরাগকে ভালোবাসায় আমরাই পরিণত করতে পারি। আমাদের প্রতিটি আচরণ যেন নতুন প্রজন্ম অনুসরণ করতে পারে।

লেখক: পি এইচ ডি গবেষক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধজন কিটস: রোমান্টিক যুগের অন্যতম কবি
পরবর্তী নিবন্ধভাষা আন্দোলন ও কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস