একজন রোকেয়া আফজাল

রিতু পারভী | শনিবার , ৮ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:০৭ পূর্বাহ্ণ

জীবনকে কর্মময় করে অন্যের জন্য দৃষ্টান্তযোগ্য করে রেখে যেতে পারেন গুটিকয়েক মানুষ। তাঁরা নিজের কাজের দ্বারা চারপাশের কল্যাণ করে অনুসরণের জন্য রেখে যান পথ। যতটুকু সুযোগ জীবন দেয় ততটুকুকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে পথ তৈরি করে এগিয়ে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না।

কিছু মানুষের দ্বারাই জীবনের ব্যপ্তিকে প্রসারিত করে ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব হয়। আর যদি সে নারী হয় তাহলে সে নারী সর্বজয়া। নারীদের জন্য সমস্যা সংকুল এই সমাজে নিজেকে ছাড়িয়ে ছড়িয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন এক কাজ। মেধা, শ্রম, একাগ্রতাকে সঠিকভাবে পরিচালিত করে মানব কল্যাণকে চিন্তায় রেখে খুব কম নারী সফল এক জীবন তৈরি করতে পারে। রোকেয়া আফজাল রহমান সেই জায়গায় সফল এক ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের কান্ডারি রোকেয়া আফজাল রহমান জীবনের দেয়া প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। বিশ্বে ব্যাংকিং পেশায় যখন নারীদের পদচারণা একদম কম সেই সময়েই রোকেয়া রহমান এই পেশায় কর্মজীবন শুরু করেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাংকিং পেশায় প্রথম নারী ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা হিসেবে তিনি নিযুক্ত হন। সফল এই ব্যাংক কর্মকর্তা বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড সদস্য হিসেবে তিন বছর দায়িত্ব পালন করেন।

ব্যাংকিং পেশার পরপরই তিনি নিজস্ব উদ্যোগে ব্যবসা শুরু করেন কৃষি ক্ষেত্রে। তিনি ব্যবসায়ী কম উদ্যোক্তা বেশি হিসেবে পরিচিত। ১৯৮০ সালে কৃষি ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি ক্ষেত্র কৃষি পণ্য সংরক্ষণের কথা ভেবে তিনি মুন্সিগঞ্জে হিমাগার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নিজস্ব কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলেন। আর কোল্ড স্টোরেজ আলু আমদানি, রফতানি এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে শুরু হয় কৃষি ক্ষেত্রে তাঁর যাত্রা।

রোকেয়া আফজাল রহমান কৃষিভিত্তিক দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন। কৃষকদের নানাভাবে সহায়তার মাধ্যমে তিনি প্রান্তিক কৃষকদের সাথে কাজ করে গেছেন। তিনি কৃষকদের ব্যাংক ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেন।

নিজস্ব কৃষি উদ্যোগের পাশাপাশি তিনি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মাইডাসের এর সাথে যুক্ত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্ন থেকেই। মাইডাস ফাইন্যান্সিং লিমিটেড যা নারী উদ্যোক্তাদের বিনা বন্ধকিতে লোনের ব্যবস্থা করে তার শুরুটা হয় রোকেয়া আফজালের প্রচেষ্টায়। ‘মাইডাস মিনি মার্ট’ চালু করে নারী উদ্যোক্তাদের পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা করা, উইমেন টু উইমেন সাপোর্ট প্রোগ্রাম ছিল রোকেয়া আফজালের নারী উদ্যোক্তাদের সহায়তায় নতুন নতুন ভাবনা এবং প্রজেক্ট। এই মহীয়সী নারী নারীমুক্তির অন্যতম শর্ত নারীদের স্বনির্ভর করে গড়ে তুলতে, তাদের উদ্যোক্তা বানাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে গেছেন।

বাংলাদেশ এশিয়া ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন সাপোর্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান, উইমেন এন্ট্রাপ্রেনার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ফেডারেশন অব উইমেন এন্ট্রাপ্রেনার্স, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত থেকে নারীদের কল্যাণে কাজ করছেন রোকেয়া আফজাল রহমান। ১৯৯৪ সালে উইমেন অন্ট্রাপ্রেনরস অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউইএ) নামের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন রোকেয়া আফজাল। ১৫০ জনকে নিয়ে গড়া এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। এবং ২০০৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ মহিলা উদ্যোক্তা ফেডারেশন বা বিএফডব্লিউই, সারাদেশে যার সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ।

১৯৪১ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণকারী রোকেয়া আফজাল রহমানের শিক্ষা জীবনের শুরু কলকাতার স্বনামধন্য লরেটো কনভেন্ট স্কুল থেকে।

এরপর করাচির সেন্ট জেভিয়ার্স কনভেন্ট থেকে মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক। এই গুণী নারী পেশাগত জীবনে একজন সার্থক মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। পুরুষশাসিত এই সমাজে অসংখ্য পুরুষ শিল্পপতি, ব্যবসায়ীর পাশাপাশি একজন নারী হিসেবে স্বগৌরবে নিজের অবস্থানকে উজ্জ্বল করে রেখেছেন।

বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, মিডিয়া ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের চেয়ারপারসন রোকেয়া আফজাল রহমান ৫ এপ্রিল ২০২৩ এ ৮২ বছর বয়সে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান অনন্তলোকে কিন্তু পেছনে রেখে যান কর্মময় এক জীবন, যে জীবন নারীদের কল্যাণে রেখে গেছেন অগুনিত উল্লেখযোগ্য কাজ, দেখিয়ে দিয়ে গেছেন অসংখ্য পথ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসত্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনই প্রত্যাশিত
পরবর্তী নিবন্ধধর্ষণ ও তদসংশ্লিষ্ট আইন