ধর্ষণ ও তদসংশ্লিষ্ট আইন

রিমঝিম আহমেদ | শনিবার , ৮ এপ্রিল, ২০২৩ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর তথ্যমতে ২০২২ সালে সারা দেশে ধর্ষণ ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন। আর ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন সাত জন। ২০২১ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ১ হাজার ৩২১ নারী।  গত কিছুদিন যাবৎ চট্টগ্রামেও চাঞ্চল্যকর বেশ কিছু শিশু ধর্ষণ ও ধর্ষণ পরবর্তী হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হবার পরেও দেশে ধর্ষণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারাতে ধর্ষণ (Rape) এর সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, কোন নারীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সম্মতি ব্যতীত অথবা ভয় দেখিয়ে সম্মতি আদায় করে অথবা অন্যায়ভাবে বুঝিয়ে তার সম্মতি নিয়ে যৌন সহবাস করলে সেটা নারী ধর্ষণ নামে বিবেচিত হবে। নারী ধর্ষণ বলতে নারীর

বিনা অনুমতিতে বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনসঙ্গম করা বোঝায়। ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলতে প্রত্যক্ষ আগ্রহের অভাবকে বলা হয়েছে এখানে। নিদ্রিতা অবস্থায় কোন নারীর সাথে মিলিত হলে সে মিলনকে তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিলন বোঝায়। জড়বুদ্ধি কোন নারীকে তার বুদ্ধির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে যৌনসঙ্গম করাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মিলন বোঝাবে। মৃত্যুর ভয়ে বা আঘাতের ভয়ে সম্মতি দেয়াকে সম্মতি বলা চলে না।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ ধারার ব্যাখ্যাতে নারী ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন করে বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে যৌন সঙ্গম করাকে নারী ধর্ষণ বলে। এখানে আরো বলা হয়েছে, কোন পুরুষ যদি বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ১৬ বছরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করে, তাহলেও সেটা নারী ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে শিশু বলতে অনধিক ১৬ বছর বয়সের কোন ব্যক্তিকে বোঝায়। আর শিশু আইন, ২০১৩ এ শিশু বলতে অনধিক ১৮ বছর বয়সের কোন ব্যক্তিকে বোঝায়। আবার পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন,২০১০ এর ধারা(১৮) অনুযায়ী “শিশু” বলতে ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি এমন ব্যক্তিকে বোঝানো হবে।

ধর্ষণ, ধর্ষণজনিত কারণে মৃত্যু ইত্যাদির শাস্তি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯ ধারাতে ধর্ষণ এবং ধর্ষণজনিত কারণে শাস্তির কথা আলোচনা করা হয়েছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯() ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন পুরুষ কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করেন, তাহলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধিকতর সংশোধন কল্পে ২০২০ সালে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে নারী বা শিশু ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯() ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি ধর্ষণ বা উক্ত ধর্ষণ পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিতা নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ (Gang Rape) এর ক্ষেত্রে ও ৯ ধারার উপধারা২ এর শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

দলবদ্ধভাবে ধর্ষণ (gang rape) করতে গিয়ে কোন নারী বা শিশুকে মৃত্যু ঘটালে বা আহত করলে প্রত্যেক ধর্ষণকারী একই শাস্তি পাবে। অর্থাৎ প্রত্যেক ধর্ষণকারীর শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং এর অতিরিক্ত অন্যূন এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ডে দণ্ডনীয় হবেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯()() ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোন ব্যক্তি কোন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করেন, তাহলে তার শাস্তি হবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধিকতর সংশোধনকল্পে ২০২০ সালে অধ্যাদেশ প্রণয়ন করে নারী বা শিশু ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়।

ধারা৯ এর উপধারা৫ এ উল্লেখ আছে, যদি পুলিশ হেফাজতে কোন নারী ধর্ষিতা হন, তাহলে হেফাজতকারীকে ধর্ষণের জন্য সরাসরি দায়ী করা হবে। এবং হেফাজতকারীর ব্যর্থতার জন্য তার শাস্তি হবে অনধিক দশ বছর কিন্তু অন্যূন পাচ বছর কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ড। এই উপধারায় উল্লেখিত অপরাধে শাস্তির পরিমাণ কম হয়ে গিয়েছে, যা পরবর্তীতে অপরাধকে লঘু করে দেবার আশঙ্কা থাকে।

বর্তমানে ধর্ষণের সকল মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আওতায় করা হয়ে থাকে। দণ্ডবিধির আওতায় এখন আর ধর্ষণের মামলা করা হয় না। দণ্ডবিধির আওতায় ধর্ষণের মামলা করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের আত্ততায় ধর্ষণ মামলা করাকে আইনের ভাষায় Doctrine of Implied Repeal বলে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে ধর্ষণের মামলা করার কারণ হল এই আইন স্পেশাল আইন। আর স্পেশাল আইনের আত্ততায় মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে থাকে।

ধর্ষণের মামলা আমলে (Cognizance) নেয়ার ক্ষেত্রে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। দণ্ডবিধির অধীনে যদি ধর্ষণের মামলা করা হয় তাহলে মামলা আমলে (Cognizance) নেবেন প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট। মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বলা হয়। মেট্রোপলিটন এলাকাতে মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট বলা হয়।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের অধীনে কোন ধর্ষণের মামলা হলে সেই মামলা আমলে নিবেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল। কোন ম্যাজিস্ট্রেটের এই আইনের অধীনে মামলা আমলে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে মামলাটি আসলে সে মামলাটি রেডি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে পাঠিয়ে দেবেন। তারপর ট্রাইব্যুনাল মামলাটি আমলে নিয়ে বিচার সম্পন্ন করবে।

মোদ্দা কথা, ধর্ষণ হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতার চূড়ান্ত সহিংস রূপ। ধর্ষণকে যতদিন সমাজে ‘ইজ্জত, সম্ভ্রমহানি’ কিংবা শ্লীলতাহানি হিসেবে গণ্য করা হবে, ততদিনই এর দায় ভিকটিমের দিকে ঠেলে দেয়া হবে। ধর্ষণ মূলত যৌন সন্ত্রাস। অথচ অন্য অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধীকে সামাজিক হেনস্তার মুখোমুখি হতে হলেও ধর্ষণের ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নারীকে হেনস্তা এবং আরও বেশি মানসিক নিপীড়নের মুখোমুখি হতে হয়। ‘আচরণ ভালো নয়, নারীর চরিত্রহীনতা ও কাপড়ের দোহাই’এর মতো আজগুবি এবং অগ্রহণযোগ্য যুক্তি হাজির করে এই সমাজে ধর্ষণকে বৈধ করার চেষ্টা করে। নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন না আসলে আইন করেও ধর্ষণ বন্ধ করা যাবে না।

শিশু সুরক্ষা সমাজকর্মী

প্রবেশন কার্যালয়, সমাজসেবা অধিদপ্তর. চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকজন রোকেয়া আফজাল
পরবর্তী নিবন্ধপ্রহরের শুদ্ধ উচ্চারণ কর্মশালা শুরু ১৬ এপ্রিল