এই করেছো ভালো নিঠুর হে !

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১০ জুলাই, ২০২১ at ৮:১৮ পূর্বাহ্ণ

দৈনিক আজাদী’র নারীপাতা’র নিয়মিত পাঠকদের কাছে মিনু নামটি খুব অচেনা লাগার কথা নয়। সেই যে তিলোত্তমা বন্দর নগরী, যেখানে অতিমারিকালেও একের পর এক বহুতল বিপণী বিতান, রেস্তোরাঁ, প্রমোদ কেন্দ্র গড়ে উঠছে, তার বুকের মাঝে ক্ষত হয়ে বেঁচে আছে ‘ছিন্নমূল’ বসতি। এই বসতির এক ছিন্নমূল নারী মিনু বেগম; কোন এক কুলসুমের অপরাধের দায় মাথায় দিয়ে নকল কুলসুম সাজিয়ে কারাগাওে পাঠানো হয়েছিল তাকে। তিন তিনটি বছর কারাভোগের পর মানবতাবাদী আইনজীবীর ঐকান্তিক চেষ্টায় মুক্তি পেল মিনু গেল মাসের ষোল তারিখে। কি ভাবছেন পাঠক? মাস না গড়াতে আবার তার কথা? তার গল্প? একজন ছিন্নমুল প্রান্তিক নারীর গল্প আর কত শোনা যায়, যখন নারী চিকিৎসক, নারী শিক্ষক, নারী প্রকৌশলী, নারী আইনজীবীর অপঘাতে মৃত্যুর খবরেও আমরা আজকাল খুব একটা বিচলিত হই না!
না, মিনুর গল্প আর শুনতে হবে না আমাদের। আজই শেষ। ঠিক যেন নটে গাছটি মুড়োল, মিনুর গল্প ফুরোল। মিনুর জীবনের চিত্রনাট্যের শেষ দৃশ্য রচিত হয়ে গিয়েছে ২৯ জুন, কারাগার থেকে মুক্তির সতের দিনের মাথায়। দ্রুতগামী ট্রাক মিনুকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় ২৮ এ। হাসপাতালে নেওয়ার পর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে মিনু ২৯ এ। স্থানীয় ও জাতীয় কাগজে জুন মাস জুড়ে বারবার তার ছবি ও গল্প ছাপা হওয়া সত্ত্বেও কেউ তাকে চিনতে পারেনি। হয়তো চেনার উপায় ছিল না; কে জানে! এর মধ্যে কেউ তার খোঁজও করেনি। খরচযোগ্য জীবন যার, তার খোঁজ নিয়ে কাজ কি! এখানেই শেষ নয়। অজ্ঞাতনামা বা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হয়ে যায় মিনুর মৃতদেহ। ৪ জুলাই খোঁজ পড়ে অভাগীর। জানা যায় সেই অজ্ঞাতনামাই বহুল আলোচিত মিনু।
১৭ জুনের কাগজে কারাগারের ফটকে মুক্ত মিনুর ছবি দেখে সবার আগে মনে হল- জীবন থেকে তিনটি বছর, একটি সন্তান (স্বামীর কথা নাইবা বলি) হারিয়ে যাওয়া মিনুর নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব কি আমরা নেব? সমাজসেবা অধিদপ্তর আছে আমাদের, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা অসংখ্য সংগঠন আছে দেশজুড়ে। নারীর অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনেরও অভাব নেই আমাদের দেশে। তবে কি গণমাধ্যমে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করা মিনুর জীবনের গল্প কাউকেই নাড়া দেয়নি? ভাইয়ের জিম্মায় মিনুকে ছেড়ে দিয়েই দায় শেষ সমাজের! সে ভাইয়েরও তো নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। পরিবার পরিজন নিয়ে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছে গরিবমারা লকডাউনের কালে। কারামুক্ত বোনকে দেখেশুনে রাখবে, তার যত্ন নেবে সে-সাধ্য কি তার! খবরে প্রকাশ, মিনু একজন মানসিক প্রতিবন্ধীও। জীবনের ওপর যে ঝড় বয়ে গিয়েছে, তারপর সে যে উন্মাদ হয়ে যায়নি তাই কি বড় কথা নয়? মানসিকভাবে সুস্থ থাকলেই তো অবাক হওয়ার কথা। কিন্তু পেট সেকথা মানবে কেন? অতঃপর ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে পথে বের হয় মিনু। ট্রাকই বা তাকে রেহাই দেবে কেন!
মিনুর অপঘাতে মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা, না হত্যাকাণ্ড তা তদন্ত সাপেক্ষ। সময়ই বলে দেবে। কিংবা হয়তো কোনদিনই জানা যাবেনা প্রকৃতই কি ঘটেছিল। আমরা সুশীল সমাজের নাগরিকগণ জানতেও চাইব না। তদন্তকারীগণও হয়তো আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। উন্নত ও আধুনিক সমাজের কাজ হতদরিদ্রদের উগড়ে দেওয়া, বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া। কারণ পোকামাকড়ের জীবন পাওয়া এই সব মানবসন্তানদের উপস্থিতি নগরের সৌন্দর্যহানি করে। তাইতো মিনুদের জন্য প্রাণ কাঁদে না কারও, আয়োজিত হয়না শোকসভা। শিশুকন্যাটির মতো মিনুও মরে বেঁচেছে। পৃথিবীতে রয়ে গেছে ওর দুই আত্মজ, কিশোরপুত্র। পিতৃমাতৃহারা দুই কিশোরের দায়দায়িত্ব আমাদের সমাজ গ্রহণ করবে, সে-ভরসা করি কি করে, যেখানে বাবা মায়ের জীবদ্দশায় ছিন্নমূলের অসংখ্য কিশোর পা বাড়িয়ে আছে অন্ধকার জগতে! হতদরিদ্র পরিবারের উঠতি বয়সী সন্তানদের ওপর ভর করে গড়ে ওঠা কিশোর গ্যাং কপাল খুলে দেয় অনেকের। ছিন্নমূল বস্তিতে নয়, তাদের বাস অভিজাত পাড়ায়। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ। তবে কম ভয়ংকর নয় মোটেও।
প্রকৃত অর্থে মিনুর বাঁচা মরায় এই সমাজের কারও কিছু এসে যায়না। তার সন্তানদেরও না। কারাগারের চার দেয়াল থেকে মুক্ত হয়ে বড় কারাগারেই ঠাঁই হয়েছিল মিনুর। অধ্যাপক এমেরিটাস সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছিলেন, “কারাগারের বাইরেও কারাগার আছে। সেখানে রাষ্ট্র কাজ করে, কাজ করে সমাজব্যবস্থা” (রাষ্ট্র ও কল্পলোক)। মিনুর জন্য এ-ই-ই বরং ভাল হল। ছোট কারাগার থেকে মুক্তির পর বড় কারাগার থেকেও মুক্তি মিলে গেছে তার।
মিনুর গল্প ছেড়ে এবার খাদিজা’র গল্প শোনা যাক। খুবই সংক্ষিপ্ত এ গল্পটি। পটিয়ার বড় উঠানের বসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী খাদিজা এই শহরে এসেছিলেন উন্নত চিকিৎসার আশায়। আত্মীয়ের বাড়িতে দিনকয় অবস্থান করে চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে সন্তুষ্টচিত্তে ঘরে ফিরছিলেন। চিকিৎসকের সঙ্গে শেষ সাক্ষাৎ করে, পরীক্ষা নিরীক্ষার যাবতীয় কাগজপত্র সঙ্গে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনছিলেন- কালই বাড়ি ফিরে যাবেন। ডাক্তার বাড়ি থেকে মেয়র গলিতে অবস্থানরত আত্মীয় বাড়ি যাবার সময় তাঁকে বহনকারী সিএনজিটি ছোট্ট একটি পাথরে ধাক্কা খেয়ে খেলনা গাড়ির মতো টুপ করে পড়ে যায় থৈ থৈ সাগরে! ভাবছেন, এই নগরে সাগর কোথায়? ঠিক তাই, গলির পাশে বয়ে যাওয়া চিকন খালে ভরা বর্ষায় সাগরের ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ। পথচারিরা পড়িমরি করে ছুটে আসে, ঝাঁপ দেয় পানিতে। উদ্ধার করে যাত্রীদেরকে। খাদিজার সহযাত্রীরা প্রাণে বেঁচে গেলেও নিস্তেজ হয়ে যান খাদিজা। প্রাণ হারান সিএনজি চালক; ঘরে তাঁর অপেক্ষায় স্ত্রী-কন্যা।
এই শহরে এমন মৃত্যুফাঁদ পায়ে পায়ে। নগর অধিপতিগণ প্রতি বর্ষায় আশ্বাস দেন, আষাঢ়ের গল্প শোনান। শ্রাবণ শেষে ভাদ্র আসতেই সবাই তা ভুলে যান। তবে কি দোষটা কেবল বর্ষারই? চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিয়ে কত শত নিবন্ধ রচিত হয়েছে স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকে! কোনকালেই ঘুম ভাঙেনি কর্তৃপক্ষের। তাই বলে সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্প থেমে নেই, থেমে নেই উন্নয়ন। নগর জুড়ে শত বিপণী। কিন্তু বন্দর এলাকায় উন্নত শপিং মলের অভাব, এতদঞ্চলের গণমানুষের ‘অভাব’ দূর করার জন্য ৪৯ কোটি টাকা ব্যয় করে জরুরী ভিত্তিতে অত্যাধুনিক শপিং মল নির্মিত হয়েছে, ঈদের পরই উদ্বোধন (দৈনিক আজাদী, ৫ জুলাই, ২০২১)। আশা করা যায় বন্দরের অধিবাসীদের আর অভাব থাকবে না।
আমাদের নগরবিদগণ রাশি-রাশি আকাশছোঁয়া অট্টালিকা নির্মাণ করেন নগরের আনাচে-কানাচে। রঙিন কাঁচ, ঝলমলে বাতি, আলোর ফোয়ারা দেখে একেকটা বাড়িকে স্বর্গ বলে মনে হয়। কিন্তু স্বর্গে পৌঁছানোর পথগুলো থাকে বড়ই নড়বড়ে, অরক্ষিত, অনিরাপদ। পানি নিষ্কাশনের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা থাকে না বললেই চলে। নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে স্বপ্নকুটিরে পৌঁছে যেতে ধনবানদের তেমন বেগ পেতে হয় না। কারণ তাঁদের ব্যক্তিগত যান শক্ত মজবুত, পাথর খণ্ডে ধাক্কা খেয়ে কুপোকাত হওয়ার মতো পলকা নয়। কিন্তু নড়বড়ে মধ্যবিত্তদের একমাত্র বাহন তিনচাকার যান; মানবসন্তান চালিত রিকশা কিংবা সিএনজি চালিত অটোরিকশা। প্রাণ হাতে নিয়েই উঠতে হয় এসব যানে।
এ সমস্যা থেকে পরিত্রাণের পথ কি ? শহরের সব রিকশা সিএনজিকে অদৃশ্য করে দিয়ে মধ্যবিত্তদের সবার হাতে ব্যক্তিগত গাড়ির চাবি ধরিয়ে দেওয়া? তা কিন্তু নয়। শহরের পথঘাটগুলো যানবাহন চলাচলের উপযোগী করা নগরবাসীর প্রাণের দাবি। এ-দাবি আজকের নয়; দশকের পর দশকের। অর্ধ শতক পার হয়ে গেল। কেউ কথা রাখেনি। নগরের বেশিরভাগ সড়কের বেহাল অবস্থার জন্য অর্থসংকট নয়, ইচ্ছের সংকটকেই দায়ী করা হয়। শহরটাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলে ইচ্ছের সংকট উবে যেতে সময় লাগে না। কিন্তু ভালোবাসার সময় কোথায়! নিজেদের জন্য ভালো ভালো বাসা নির্মাণ করেই স্বর্গসুখে বুঁদ হয়ে থাকেন কর্তাব্যক্তিগণ। খাদিজারা বেঘোরে মারা পড়ে পাখির মতো, পোকামাকড়ের মতো। আমরা দ্রুত ভুলে যাই অকিঞ্চিৎ মৃত্যুসংবাদ।
মিনু ও খাদিজাদের মৃত্যু আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমাজের দুরবস্থা, আইনের দুর্বলতা, উন্নয়নের অন্তঃসারশূন্যতা। মানুষতো মরবেই। কিন্তু একটি প্রাণের অপমৃত্যুতেও থমকে যাওয়ার কথা পৃথিবীর যত আয়োজন, যাবতীয় সাজসজ্জা। অথচ আমরা মানুষ সৃষ্টির সেরা জীবের তকমা ধারণ করে ক্রমাগত অমানবিক আচরণ করে চলেছি। মিনু, খাদিজারা কি যুগ যুগ ধরে মরেই প্রমাণ করে যাবে, একদিন ওরাও ছিল ?

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাঁশখালীতে ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫০ ব্যক্তির মাঝে চাল বিতরণ
পরবর্তী নিবন্ধচর্যার হরিণীদের গল্প শেষ হয়নি এখনও