ঈদ ঘিরে হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর হিড়িক

নানা প্রণোদনা দিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বঞ্চিত সরকার

হাসান আকবর | শুক্রবার , ২৯ মার্চ, ২০২৪ at ৫:১০ পূর্বাহ্ণ

ঈদকে সামনে রেখে বাড়ছে প্রবাসী আয়। একই সাথে করে বাড়ছে হুন্ডিও। ঈদের বাড়তি খরচ মেটানোর জন্য হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর হিড়িক পড়েছে। বৈধ চ্যানেলে এসব টাকা দেশে না আসায় সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা থেকে। নানাভাবে প্রণোদনা দিয়েও শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবে হুন্ডি ঠেকাতে পারছে না। হুন্ডির সাথে সরকারের যেনো এক অসম প্রতিযোগিতা চলছে। সরকারি প্রণোদনার চেয়ে বেশি দর দেয়ায় দেশের শত শত কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি কারবারীদের হাতে চলে যাচ্ছে। চোরাচালানসহ নানা অপকর্মে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রবাসীদের কষ্টার্জিত আয়।

সূত্র জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের নানা দেশে প্রায় এক কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি চাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্য করছেন। এদের মধ্যে উন্নত দেশগুলো থেকে কম আসলেও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে প্রচুর রেমিটেন্স আসে বাংলাদেশে। বর্তমানে বছরে গড়ে ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে আসে। দেশে রেমিট্যান্স হিসেবে অর্থ আনতে হলে তা অবশ্যই ব্যাংকিং চ্যানেলে আনতে হয়। কোন প্রবাসী যদি তার অর্জিত আয় ব্যাংকিং চ্যানেলে না দিয়ে কোন ব্যক্তি বিশেষের হাতে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠান তাহলে সেই টাকা দেশের কোন কাজে লাগে না। এই টাকা রেমিট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকে যুক্ত হয় না। হুন্ডির টাকা চোরাচালানীরা নানাভাবে ব্যবহার করে। ব্যাংক রেটের চেয়ে বাড়তি টাকা দিয়ে হুন্ডিওয়ালারা প্রবাসীদের বিভ্রান্ত করে। তারা লাখ লাখ প্রবাসীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা দেশে পাঠানোর নাম করে নিয়ে নেয়। প্রবাসীরাও নগদ লাভের কথা চিন্তা করে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান। কোন ধরনের ঝুট ঝামেলা না থাকা, ঘরে বসে টাকা পাওয়া, ব্যাংকের চেয়ে বেশি টাকা পাওয়াসহ নানা কারণে প্রবাসীদের অনেকেই ব্যাংকিং চ্যানেল থেকে হুন্ডিকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে।

হুন্ডির মাধ্যমে প্রেরিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসে না। শুধু ম্যাসেজ বা ফোনকল আদান প্রদান হয়। দেশীয় টাকা দিয়ে হুন্ডির টাকা পরিশোধ করা হয়। হুন্ডিওয়ালারা বৈদেশিক মুদ্রাগুলো বিদেশেই রেখে দেয়। বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই বিদেশে থেকে যাওয়ায় সেটা আর দেশের কোনো কাজে লাগে না। স্বর্ণ চোরাচালান, অবৈধ অস্ত্র ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অবৈধ কাজে হুন্ডির টাকা ব্যবহৃত হয়। সরকার ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানোর উৎসাহ দিচ্ছে। কিন্তু হুন্ডিওয়ালারা সরকারের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিনিময় হার আরো বাড়িয়ে দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা হাতিয়ে নিচ্ছে। সরকারের সাথে প্রতিযোগিতা করে বছরের পর বছর ধরে হুন্ডিওয়ালারা প্রবাসীদের কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স হাতিয়ে নিচ্ছে। আবার অনেক প্রবাসী দেশে আসার সময় বেশ ভালো অংকের বৈদেশিক মুদ্রা সাথে নিয়ে আসেন। এগুলো ব্যাংকে গিয়ে চেঞ্জ করা হলে টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবেশ করে। কিন্তু খোলা বাজারে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই ব্যাংকে না গিয়ে বিদেশ থেকে আনা টাকা খোলা বাজারে বিক্রি করে দেয়। ফলে এই টাকাও আর ব্যাংকিং চ্যানেলে যায় না, হুন্ডির মতো ভয়াবহ হয়ে উঠে।

ঈদকে সামনে রেখে হুন্ডির তৎপরতা চরমভাবে বেড়েছে। আগ্রাবাদের কার্ব মার্কেটের তৎপরতাও। প্রতিদিন প্রবাসীদের লাখ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা খোলা বাজার এবং হুন্ডি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে। এই প্রবণতা আশংকাজনক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে বলেও সূত্রগুলো জানিয়েছে।

মার্কেন্টাইল ব্যাংকের নগরীর একটি শাখা ব্যবস্থাপক গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা আসার পরিমান আগের তুলনায় কমে গেছে। আমার শাখায় এখন মাঝে মধ্যে দুয়েকজন আসেন।

প্রায় একই কথা বললেন, ইসলামী ব্যাংকের একজন ম্যানেজারও। তিনিও আগের চেয়ে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমেছে বলে মন্তব্য করেন। ঈদকে সামনে রেখে রেমিট্যান্সের যে প্রবাহ থাকার কথা ছিল তা নেই বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

এদিকে চলতি মাসের প্রথম ২৫ দিনে প্রায় ১৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে বলে উল্লেখ বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, রোজার শুরু থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। প্রবাসী মানুষগুলো দেশের পিতা মাতা ও স্বজনদের কাছে টাকা পাঠিয়েছেন। ঈদ সামনে নিয়েও অনেকেই টাকা পাঠাচ্ছেন। এতে করে প্রবাসী আয়ে একটি গতি এসেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

তিনি ২৫ দিনে প্রায় ১৮ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১১৫ টাকা হিসেবে) দেশে এসেছে। প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্স বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশি। রোজা এবং ঈদকে সামনে রেখে বাড়তি রেমিট্যান্স আসছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১০ কোটি মার্কিন ডলার। গত মাসে ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল ২১৬ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার। মার্চে তা বাড়বে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, বিগত ২০২২২৩ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল দুই হাজার ১৬১ কোটি ৭ লাখ ডলার। আগের ২০২১২০২২ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল দুই হাজার ১০৩ কোটি ১৭ লাখ ডলার। ২০২০২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল দুই হাজার ৪৭৭ কোটি ৭৭ লাখ ডলার। ২০২০২০২১ সালেই এযাবতকালের সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসার রেকর্ড রয়েছে। হুন্ডি ঠেকানো গেলে রেমিট্যান্সের পরিমান আরো অনেক বৃদ্ধি পেতো বলেও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকারেরা মন্তব্য করেছেন। তারা বলেন, সরকার প্রণোদনা দিলেও ব্যাংক রেট থেকে হুন্ডির রেট চড়া হওয়ায় হুন্ডিওয়ালাদের সাথে সরকারের এক অসম প্রতিযোগিতা চলছে। এর থেকে বেরুতে না পারলে প্রবাসীদের অর্জিত সব আয় কখনোই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যুক্ত হবে না। বেপরোয়া হুন্ডি রেমিট্যান্স প্রবাহে ছন্দপতন ঘটাচ্ছে বলেও তারা উল্লেখ করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকল্পের সাশ্রয়ী ২২৮ কোটি টাকায় কেনা হচ্ছে আরো ৩৫ মিটারগেজ কোচ
পরবর্তী নিবন্ধঘর থেকে বের করে টেক্সি চালককে কুপিয়ে হত্যা