ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তাৎপর্য ও শিক্ষা

মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান | রবিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২২ at ৭:৫২ পূর্বাহ্ণ

আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে তার বিধান প্রচারের জন্য যুগে যুগে অনেক নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। প্রত্যেক নবী-রাসূলগণ তাদের আপন আপন যুগে আদর্শ ও শ্রেষ্ঠ মানব ছিলেন। আর আমাদের নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সমস্ত নবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম মর্যাদার অধিকারী। তিনি সকল যুগের ও সকল মানুষের জন্য সর্বশেষ নবী হিসেবে প্রেরিত। পৃথিবীর জমিনে তার শুভাগমন উপলক্ষেই পালিত হয়ে থাকে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (দ.)। তাঁর আগমনের দিন শুধু মুসলমানদের জন্য নয় বরং সমস্ত সৃষ্টিজগতের জন্যই আল্লাহর রহমত ও নেয়ামত প্রাপ্তির দিন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেছেন, আমি আপনাকে জগৎসমূহের রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি (সূরা আম্বিয়া-১০৭)।
আজ থেকে চৌদ্দশত বছর পূর্বে সমগ্র বিশ্ব যখন অন্যায় অবিচার, জুলুম ও নানা কুসংস্কারে নিমজ্জিত হয়েছিল, মানুষের মর্যাদা ধুলায় মিশে গিয়েছিল ঠিক তখনই আল্লাহ তায়ালা হেদায়তের আলোকবর্তিকা হিসেবে পৃথিবীর বুকে পাঠিয়েছেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। তিনিই সর্বপ্রথম পৃথিবীর বুকে এমন এক সভ্যতা স্থাপন করেছেন যা চির সুন্দর, চিরসবুজ এবং সমুজ্জ্বল আলোকধারায় উদ্ভাসিত। তার উসিলায় সৃষ্টি হয়েছে সমগ্র সৃষ্টি জগৎ।
ঈদে মিলাদুন্নবী এটি একটি যৌগিক শব্দ। ঈদ অর্থ হলো- উৎসব। মিলাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল জন্মদিন বা জন্ম সময়। আল্লামা ইবনে মানযুর বলেন, মিলাদ হলো যে সময়ে সে জন্মগ্রহণ করেছে সে সময় এর নাম। (লিসানুল আরব-৩/৪৬৮)। নবী অর্থ হলো অদৃশ্যের সংবাদদাতা। এখানে নবী বলে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং ‘ঈদে মিলাদুন্নবী’ এর অর্থ হলো প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভ আগমন উপলক্ষে শরীয়ত সম্মত পন্থায় আনন্দ বা খুশি উদযাপন করা। মীলাদুন্নবী উদযাপন করা হলো নবীজির প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।
ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা পবিত্র কুরআন দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, (হে নবী) আপনি বলুন। এটি আল্লাহর (ফদল ও রহমত পেয়ে) অনুগ্রহে ও তাহার দয়ায়; সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক। এটিই উত্তম সে সমুদয় থেকে যা তারা সঞ্চয় করেছে। (সূরা ইউনুস -৫৮)। মুফাসসিরকুল শিরোমনি হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এবং হযরত দাহহাক (রহ.) বলেন, উক্ত আয়াতে ‘ফদল’ অর্থ কোরআন আর ‘রহমত’ এর অর্থ হলো হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। প্রিয় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রহমত হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা নিজেই এরশাদ করেছেন, আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত স্বরূপই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া-১০৬)। সুতরাং প্রমাণিত হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রহমত ও সৃষ্টি জগতের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বিশাল নেয়ামত। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কোরআনে নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য নির্দেশ দিয়ে বলেন, তোমাদের উপর অবতীর্ণ আল্লাহর নেয়ামতের আলোচনা করো যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে তখন তিনি তোমাদের অন্তরে মহব্বত-ভালোবাসা সৃষ্টি করে দিয়েছেন। অতঃপর তোমরা তার প্রদত্ত নেয়ামতের বদৌলতে পরস্পর ভাই হয়ে গিয়েছ। আল্লাহর সেই নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে শরিয়ত সম্মত উপায়ে যে সমস্ত অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়ে থাকে সেটিই হলো ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ।
প্রিয় নবী ৫৭০খৃঃ ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের সময় পৃথিবীতে শুভাগমন করেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজেই তার পবিত্র জন্মদিনের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে প্রতি সপ্তাহে সোমবার রোজা পালন করতেন। হযরত আবু কাতাদা আল আনসারী (রা.) বলেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার দিন রোজা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেন, এই দিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এই দিনেই আমি নবুয়াত পেয়েছি। (সহীহ মুসলিম-খ.২/পৃ.৮১৯)।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নবুওয়াত প্রকাশ হওয়ার পর নিজের পক্ষ থেকে নিজেই আকিকা করেছেন। (ইমাম বাইহাকী, আস সুনানুল কুবরা-১৯২৭৩)। অথচ জন্মের সপ্তম দিনে তার আকিকা করা হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (রহ.) বলেন, নিশ্চয়ই নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দাদা আবদুল মুত্তালিব জন্মের সপ্তম দিনে আকিকা করেছিলেন। আকিকা দু’বার করার বিধান নেই। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয়বার আকিকা পালন উপলক্ষে ছাগল যবেহ করে আল্লাহ তাআলার শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছেন। কেননা আল্লাহ তাআলা তাকে ‘রাহমাতুল্লিল আলামিন’ এবং উম্মতের নিকট সম্মানিত করেই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। এভাবে তিনি আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে নিজের উপর দরুদ শরীফ পাঠ করতেন। অতএব রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শুভাগমন উপলক্ষে মুসলিমদের একত্র হওয়ার মাধ্যমে খানা খাওয়ানো, অন্যান্য ইবাদত পালন এবং ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করা আমাদের জন্যও মুস্তাহাব। (ইমাম সুয়ুতী, হুসনুল মাকসাদ। পৃষ্ঠা-৬৫)
সৃষ্টি জগতের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নিয়ামত হল রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমন। এই দিনকে স্মরণ করে আল্লাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করার জন্যই ঈদে মিলাদুন্নবীর নানা শরীয়ত সম্মত অনুষ্ঠানাদি পালন করা হয়ে থাকে। উম্মতের জন্য প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনের চেয়ে বড় আল্লাহর রহমত কী হতে পারে? প্রত্যেক মুমিনের উচিত আল্লাহর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা এবং এই দিনে নফল ইবাদত পালন, কোরআন তেলাওয়াত করা, দরূদ শরীফ পাঠ, শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা, সেমিনার- সিম্পোজিয়াম ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগী পালন করা।
হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, হযরত মুয়াবিয়া (রা.) বলেছেন, একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের একটা মজলিসে পৌঁছেন। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানে বসে কী করছিলে? তারা বলল, আমরা আল্লাহর স্মরণে ও তিনি আমাদের হেদায়েত দান করেছেন এবং আপনাকে প্রেরণ করে আমাদের উপর যে ইহসান করেছেন তার শুকরিয়া আদায় করার জন্য বসেছি। তিনি বললেন সত্যি কি তোমরা এই জন্য বসেছ? তারা বললেন, আল্লাহর শপথ! আমরা এ জন্যই বসেছি। তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে মিথ্যাবাদী মনে করে তোমাদের কাছ থেকে শপথ নেইনি। বরং এজন্য যে, জিব্রাইল (আ.) আমাকে এসে সংবাদ দিলেন যে, আল্লাহ তা’আলা তোমাদের ব্যাপারে ফেরেশতাদের সামনে গৌরব প্রকাশ করেছেন। (সুনানে নাসায়ী-৫৪২৬)। সুতরাং বুঝা গেল সাহাবাগণ একত্রিত হয়ে নবীজীকে বিষয়বস্তু বানিয়ে বৈঠক করতেন। এটিকেই আমরা মিলাদুন্নবী বলে থাকি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন সর্বশেষ নবী। তারপরে আর কোনো নবী আসবে না। তার আদর্শই পৃথিবীতে কেয়ামত পর্যন্ত জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার উপর অবতীর্ণ হয়েছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন যা অনাদিকাল পর্যন্ত মানবজাতির হেদায়েতর মূল উৎস হয়ে থাকবে। নবীজী হলেন মানবতার মুক্তির সর্বোত্তম দিশারী। মানব সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ, আদল ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি ছিলেন আদর্শ শিক্ষক, আদর্শ সেনাপতি, পরোপকারী এবং আদর্শ রাষ্ট্রনায়ক। তার মধ্যে সত্যবাদীতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারিতা ইত্যাদি সৎগুণাবলির সংমিশ্রণ ঘটেছিল। তার বিশ্বস্ততার জন্য আরবের লোকেরা তাকে ‘আল-আমিন’ বলে সম্বোধন করেছিল। ‘হারবুল ফিজার’ নামক অন্যায় যুদ্ধ দেখে তার হৃদয়ে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়েছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতে শান্তিকামী যুবকদেরকে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক শান্তি সংঘ। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে তার চরিত্র সম্পর্কে ঘোষণা দিয়েছেন- ‘ইন্নাকা লাআলা খুলুকিন আজিম’। অর্থ, নিশ্চয় আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ চারিত্রিক গুণাবলীর উপর অধিষ্ঠিত (সূরা আল কলম-৪) অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘লাকাদ কা-না লাকুম ফী রাসূলিল্লাহী উসওয়াতুন হাসানাহ’ অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব-২১)। পৃথিবীতে আজকে মানবতার মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত, মানুষ নানা অপরাধ প্রবণতায় জর্জরিত। সুদ-ঘুষ, মদ-জুয়া, মিথ্যাচার, প্রতারণা সহ নানা অপকর্মের দাপটে সমাজ বিপর্যস্ত। খোদাদ্রোহী, ইসলাম বিদ্বেষী, নবিদ্রোহীরা অব্যাহতভাবে ইসলাম ও কোরআনের অবমাননা করেই যাচ্ছে। মানবতার এই চরম দুর্দিনে মুসলমানদের জন্য একমাত্র করণীয় হলো প্রিয় নবীজির আদর্শ অনুসরণ ও অনুকরণ। অন্য ধর্মের মনীষীরাও আজ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে একমাত্র হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পথ অনুসরণের মাধ্যমেই আজকের বিশ্ব তার নানা সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারে। তাই আমাদের উচিত প্রিয় নবীজিীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি ও হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা প্রকাশ করে তার জীবনাদর্শ অনুসরণের সচেষ্ট হওয়া। উক্ত আদর্শকে আঁকড়ে ধরলেই সুন্দর শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। বিপন্ন মানবতা তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে।
লেখক: সিনিয়র শিক্ষক , চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল
এন্ড কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকোরআনের কিছু অংশ মানা আর না মানা-এমন ব্যক্তিদের জন্য রয়েছে ভয়ানক আযাব
পরবর্তী নিবন্ধকোজাগরী পূর্ণিমা ও লক্ষ্মীপূজা আজ