আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে মুসলিমদের অবদান

তামিরুল ইসলাম | শুক্রবার , ১২ নভেম্বর, ২০২১ at ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

সভ্যতার উন্নয়নে মুসলিমদের অবদান অনেক। মধ্যযুগে মুসলিম মনীষীরা চিকিৎসা, শিল্প, সাহিত্য, দর্শন আর আইনে অসামান্য অবদান রেখেছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় আন্দালুসিয়া (বর্তমান স্পেন) বাগদাদ, বুখারা ও সমরকন্দে এসব কিছুর প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ধরা হতো। তাদের মৌলিক আবিষ্কারের উপর ভিত্তি করে বর্তমান আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন হয়েছে। তাই বলা হয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভিত্তি রচনায় মুসলিম বিজ্ঞানীরা যে ভূমিকা পালন করেছেন; তাতে তারা অমর হয়ে আছেন।
আবুল কাসেম আল যাহরাওয়ি (জন্ম ৯৩৬- মৃত্যু ১০১৩ সন) : নবম থেকে একাদশ শতাব্দি পর্যন্ত ছিলো মুসলিম মনীষীদের চিকিৎসা বিজ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের স্বর্ণযুগ। সে সময় চিকিৎসা বিজ্ঞানে যারা অসমান্য অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে একজন হলেন আল যাহরাওয়ি। তার পুরো নাম আবুল কাসেম খালফ ইবনে আব্বাস আল জাহরাওয়ি আল আনসারী। লেটিন ভাষায় ‘আবুকাসিস’ নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন আন্দালুসিয়ান একজন মুসলিম চিকিৎসক, সার্জন এবং রসায়নবিদ। তাঁকে মধ্যযুগের তথা মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শল্য চিকিৎসক এবং আধুনিক সার্জারির জনক হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি ৯৩৬ সনে আন্দালুসের খলিফা আব্দুর রহমান আন-নাসেরের শাসনামলে কার্ডোভা শহরের ৮ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মাদিনাতুজ জাহরাহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা আব্বাস ছিলেন মদিনা মুনাওয়ারার বংশোদ্ভূত। তাই তাকে আল আনসারী বলা হয়। তাঁর বেড়ে উঠা ছিলো কার্ডোভা কেন্দ্রিক, যা তখনকার বিশ্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চারণভূমি ছিলো। কার্ডোভায় তখন পঞ্চাশটি হাসপাতাল আর সত্তরটি গণপাঠাগার ছিলো। এর মধ্যে শুধু খলিফার পাঠাগারেই ছিলো চার লক্ষেরও অধিক গ্রন্থ। তিনি তৎকালিন বিশেষজ্ঞদের কাছে চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। এই শাস্ত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহ তাকে একেবারে শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছে। যার কারণে তাকে খলিফা দ্বিতীয় আল হাকামের চিকিৎসক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। আর তিনিই সর্বপ্রথম আল জারাহিয়াহ বা সার্জারিকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে যুক্ত করে নতুন বিপ্লব ঘটান। তিনি কার্ডোভা শহরেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চিকিৎসা, অস্ত্রোপচার অধ্যয়ন, শিখানো এবং অনুশীলন করেন। তিনি খলিফা প্রাসাদে থাকাকালিন পঞ্চাশ বছর নিরলস পরিশ্রম করে ১০০০ সনের দিকে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ত্রিশ খণ্ড বিশিষ্ট কিতাবুত তাসরিফ রচনা করেন। তার এই বিখ্যাত গ্রন্থটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের নবদিগন্ত উন্মোচিত করে। যা ইউরোপে পরবর্তী পাঁচশ বছর পর্যন্ত মেডিকেল সায়েন্সের প্রধান পাঠ্যপুস্তক হিসেবে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হয়। আর তা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক প্রভাব ফেলে। তিনি এই গ্রন্থটিতে সার্জারির যন্ত্রগুলোর আকৃতি নিয়ে বিস্তারিত লিখেন আবার প্রতিটি যন্ত্রের ধরন তিনি এঁকে স্পষ্ট করে দেন। তারপর প্রতিটি যন্ত্রের ব্যবহার নিয়েও তিনি স্ববিস্তরে আলোচনা করেন। তাঁর আবিষ্কারের যন্ত্রগুলোর অধিকাংশই এখনো সার্জারিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাঁর এসব যন্ত্রপাতির আবিষ্কারের কারণে চিকিৎসা বিজ্ঞান তাঁর কাছে ঋণি। এই গ্রন্থের পিছনে তিনি সারাজীবন ব্যয় করেছেন বলা চলে। এতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নানা মৌলিক দিকের তথ্য সংযোজন করেছেন তিনি । সার্জারি থেকে শুরু করে মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, অফথালমোলজি, অর্থপেডিক্স, প্যাথলজি, দন্তবিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান ও শিশুচিকিৎসা সবকিছু স্থান পেয়েছে তাঁর এই গ্রন্থে। ত্রিশ খণ্ডের এই গ্রন্থটিতে নানা রোগ ও তার চিকিৎসা নিয়ে আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে প্রথম খণ্ডটি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রাথমিক বিষয়গুলো দিয়ে সাজিয়েছেন। একজন চিকিৎসকের প্রাথমিকভাবে যা কিছু শেখা প্রয়োজন তার সবকিছুই প্রথম খণ্ডটিতে সংযোজন করেছেন আল যাহরাওয়ি। আর এরপরের খণ্ডে তিনি প্যাথলজি রোগবিদ্যার সাথে মেডিসিন তৈরির সব তথ্য যোগ করেন। বিখ্যাত গবেষক জর্জ সারটন তাঁর এই গ্রন্থটিকে মেডিকেলের বিশ্বকোষ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর বাইরে অনেকে এই গ্রন্থটিকে মধ্যযুগের ফার্মাকোলজি বা চিকিৎসা বিজ্ঞানের বাইবেল হিসেবে উল্লেখ করেন। আল তাসরিফের শেষ এবং সবচেয়ে বড় খণ্ডটি শল্য চিকিৎসা বা সার্জারি নিয়ে রচিত। চিকিৎসক হিসেবে নিজের পুরো ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতাকে ‘ঙহ ঝঁৎমবৎু ধহফ ওহংঃৎঁসবহঃং’এই মহাগ্রন্থে একত্র করেন আল যাহরাওয়ি। আল তাসরিফ গ্রন্থটি সার্জারির এই খণ্ডটির কারণে ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করে। সে সময় নিউরোসার্জারিতে কোনো চিকিৎসক সাহস দেখাতো না। কিন্তু সে সময়ও আলযাহরাওয়ি নিউরোলজিতে সফল সার্জারি করে দেখিয়েছেন। নিউরোসার্জারিতে তিনি এমন কিছু প্রয়োগিক পদ্ধতি দেখিয়েছিলেন যা এখনো অনুসরণ করা হয়। হাইড্রোসেফালাস রোগের চিকিৎসা নিয়েও আল যাহরাওয়ি বিস্তারিত লিখে গিয়েছেন। এটি নবজাতক বাচ্চা আর বৃদ্ধদের হয়ে থাকে। এটিকে মাথায় পানি জমাও বলা হয়। তিনি বলেন নবজাতকদের নার্ভগুলোতে নানান তরল পদার্থে ভর্তি থাকে। তারপর ধীরে ধীরে মাথার আয়তন বাড়তে থাকে। এগুলো বিশেষ কিছু স্থানে সার্জারির মাধ্যমে বের করে ভালোভাবে ব্যান্ডজ করে দিলে নার্ভগুলো পুনরায় একীভূত হয়। তাছাড়া তিনি এমন ভাবে শল্য চিকিৎসা বা সার্জারির বর্ণনা দিয়েছেন যে, সাধারণ মানুষরাও বিষয়গুলো খুব সহজে বুঝে নিতে পারবে। ইউরোলজিতেও তিনি বেশ বিস্ময়কর অবদান রাখেন। তিনি প্রথম কাটা-চাটা ব্যতিত মূত্রথলি থেকে পাথর অপসারণের পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনিই সর্বপ্রথম হিমোফিলিয়া বর্ণনা করেন। দন্ত চিকিৎসায় যাহরাওয়ির অবদান অনেক। তিনি দাঁত অপসারণ, বাঁধায়েও বেশ অভিজ্ঞ ছিলেন। তারপর রুপা দিয়ে তা ভরাট বা প্রতিস্থাপন করতেন। দন্ত চিকিৎসায় তিনি দুইশ থেকেও অধিক যন্ত্র তৈরি ও ব্যবহার করে দেখিয়েছেন। এগুলোর অধিকাংশই এখনো ডেন্টাল সার্জারিতে ব্যবহার হয়। যাহরাওয়ি সর্বপ্রথম রক্ত বন্ধকরণ বা ড্রেসিং করতে তুলা ব্যবহার করেন। তিনি যৌননালি অপারেশনেরও সর্বপ্রথম শিক্ষা দেন এবং ট্রাচেস্টোমি বর্ণনা দেন। তিনিই প্রথম ক্যানোলা আবিষ্কার করেন।
ইবনে নাফিস ( জন্ম : ১২১৩- মৃত্যু ১২৮৮ সন) : বারোশ শতাব্দিতে এসে চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন কিছু বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। এই বিশ্লেষণগুলো পরবর্তী হৃদরোগ গবেষণায় চিকিৎসা বিজ্ঞানে অনেক পথ এগিয়ে নিয়ে যায়। আর সে সময় আন্দালুসিয়া আর বাগদাদের মতো দামেস্কেও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় অনেক হাজারো মানুষের সমাগম হতো। তখনকার সময়ে দামেস্কের চিকিৎসা বিজ্ঞানের রূপকার ছিলেন ইবনে নাফিস। তাঁর পুরো নাম আলী ইবনে হাজম ইবনে নাফিস আল কুরাশী (মৃত্যু ১২৮৮ সন)। তিনি দামেস্কের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ চিকিৎসক ছিলেন। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আশ-শামায়েল’ রচনা করেন। আর তাঁর এই গ্রন্থের শরহু তাশরিহিল কানুন অধ্যায়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এতে তিনি পালমোনারী সার্কুলেশন নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দেন। পালমোনারী সার্কুলেশন বা হার্টে রক্ত সঞ্চালন ছিলো তাঁর অন্যতম আবিষ্কার। আর তিনি চঁষসড়হধৎু পরৎপঁষধঃরড়হ এর বিস্তারিত বিশ্লেষণ করে তাঁর গ্রন্থে এর পাঠ্যরূপ দেন। পালমোনারী সার্কুলেশন এই বিষয়টি ইউরোপীয়ান চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা মাইকেল সারভেটাস (মৃত্যু ১৫৫৩ সন) এর আবিষ্কার বলে দাবি করে। কিন্তু ইবনে নাফিসের আশ-শামায়েল গ্রন্থটি এর স্পষ্ট প্রমাণ বহন করছে। পশ্চিমা বিশ্ব ইবনে নাফিসের আরো অনেক আবিষ্কারকে নিজেদের করে নেয়। যেমন পালমোনারী সার্কুলেশনের বিষয়ে ঘটেছে, অথচ তাঁর গ্রন্থের ‘শরহু তাশরিহিল কানুন’ এ এই আবিষ্কারগুলো এখনো বিদ্যমান। তাঁর এই গ্রন্থটি পরবর্তী তিনশ শতাব্দি মেডিকেল সায়ন্সের সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত থাকে। তারপর ১৫৪৭ সনে ইবনে নাফিসের গ্রন্থটি লেটিন ভাষায় অনুবাদ করা হয়। আ্যালগো ১৫৪৭ সনে ইবনে নাফিসের আশ-শামায়েলের লেটিন ভাষায় প্রথম অনুবাদ ইতালীর ভেনিস শহরে প্রকাশ করেন। তারপর ইউরোপের তিনজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে নাফিসের পালমোনারী সার্কুলেশন যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তার অনুরূপ বর্ণনা করেন। তারা হচ্ছেন সারভেটাস (মৃত্যু ১৫৫৩ সন) স্পেনের চিকিৎসা বিজ্ঞানী কলম্বো (মৃত্যু ১৫৫৯ সন) ইতালীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানী পাধুয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হারভে (মৃত্যু ১৬৫৮সন) ইংল্যান্ডের চিকিৎসা বিজ্ঞানী। কিন্তু এদের কেউ ইবনে নাফিসের পালমোনারী সার্কুলেশন আবিষ্কারকে তাঁর নামে উল্লেখ করেনি। মুসলিমরা এরকম হাজারো মনীষীদের কারণে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব লাভ করেছে। এদের মধ্যে মেডিসিন আবিষ্কারক চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনাও অন্যতম। ইতিহাস নানান পেক্ষিতে এসব বিজ্ঞানীদের বারবার স্মরণ করে। স্বজাতীর ইতিহাসকে অবজ্ঞার অর্থই হলো নিজের অস্থিত্বকে অস্বীকার করা। সুতরাং আমাদের উচিৎ নিজেদের ইতিহাসকে মনেপ্রাণে লালন করা। আর এগুলোকে চর্চায় রাখা।
লেখক : শিক্ষার্থী, হাটহাজারী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএসএসসি ও দাখিল পরীক্ষার্থীরা যা করবে, যা করবে না
পরবর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা