আত্মোপলব্ধিতে দিদা : ভালোবাসার ভিন্ন প্রকাশ

কুমুদিনী কলি | শনিবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

রান্নাঘরে পাঁচফোড়নের কৌটোটা যখনই দেখি, তখনই তোমার কথা বেশ মনে পড়ে। আমি বেশ টের পাই সাদা তেলে দেয়া পাঁচফোড়নের সেই ঘ্রাণ, ঘরময় সেই ঘ্রাণের ছড়িয়ে পড়া।

আমি চোখ বন্ধ করলেই তখন অনুভব করি তোমায়।

যে যে পদগুলো তোমার হাতে অমৃত মনে হতো, আমি সেসব পদ এখন খুব যত্ন করে রাঁধতে শিখেছি। আমি বড় হয়ে গেছি কিনা!

অথচ তুমি থাকতে আমি কক্ষণো বড় হয়ে উঠতে পারিনি। আমার হাতে আগুনের আঁচ লাগার ভয়ে তুমি সিঁটিয়ে থাকতে, অথচ সেটাকে আমি কখনো ভালোবাসা বলে মেনে নিতেই পারিনি। আজ বুঝতে শিখেছি কতটুকু নির্ভেজাল ভালোবাসায় মোড়ানো ছিলো আমার জীবন।

তোমার সেই পানের বাটা এখনও খুব যত্ন করে রেখেছে মা। প্রতিদিন তার যত্ন চলে, তুমি যেভাবে করতে! আমার পান খাওয়ার হাতেখড়ি তোমার কাছেই, কাঁচা সুপারি দিয়ে মিষ্টি পানে চুনের আলপনা, কীভাবে পানের খিলি বানাতে হয়, তাও শিখিয়েছিলে।

আমি সব নিতে পারিনি তখন, এই বয়সে সব পর্দা চোখের সামনে থেকে সরছেএকের পর এক!

কিন্তু ততদিনে আমার ভীষণ অপছন্দের সেই তুমি আর রইলে না কোথাও। কিন্তু কী আশ্চর্য দেখো, তুমি যাবার পর আমি তোমায় কী ভীষণ অনুভব করতে শিখলাম, অথচ তোমার জীবদ্দশায় কখনো বুঝতেই চাইনি তোমায়।

ভালেবাসার এই রূপটা ধরতেই পারিনি আমি। ভাবতাম তুমি আর এমন কী? সাদা থানে জড়ানো মাথা নিচু করে থাকা নিরীহ একজন মানুষ। মান অভিমান, সম্মান, তেজ, রাগ এসব কি আর তোমার আছে? যদি থাকতো তবে আমার এত এত অপমান ডিঙিয়ে ঠিক আমার কাছেই তুমি আসতে না, আমায় ভালোবাসতে না। আমার এমন আনাড়িপনা দেখে হয়তো তুমি মনে মনে হাসতে, ভাবতে একদিন ঠিক আমি বুঝে নেবো।

তাই হলো বুঝলে? এত এতগুলো বছর লেগে গেলো তোমার ভালোবাসাটুকুকে ভালোবাসা বলে চিনতে। কেনো বলোতো? আমি এত দেরীতে বড় হলাম! তোমার ঋণটুকু শোধ করতে না পারার দায় থেকে যাবে আমার সারাটা জীবন!

একবার কথাচ্ছলে তোমায় বলেছিলাম, ‘তোমার এই সাদা থানে জড়ানো শরীরটা নিয়ে কক্ষণো আমার স্বপ্নে তুমি এসোনা আবার, আমি ভয়েই মরে যাবো।’ সেই তুমি আজও আমার স্বপ্নের আনাচে কানাচে কোত্থাও নেই। এতবছর হয়ে গেলো একবারও তোমার চেহারাটা আমি আর খুঁজে পেলাম না।

সেদিন, সেই ভোরবেলা তুমি আমায় ডেকেছিলে খুব। আমি দরজার ওপাশে চুপচাপ ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে গেলাম কলেজের জন্য। এরপর তোমার শোধ নেবার পালা শুরু হলো।

বিকেল হতে না হতেই আমি এলাম হন্তদন্ত হয়ে, কিন্তু ততক্ষণে তুমি নাই হয়ে যাবার পথে।

সারারাত তুমি নিশ্চুপ, এত ডেকেও একটিবার তোমার কোনো সাড়া আমি পাইনি। পরের ভোরের আলোয় তুমি তোমার সমস্ত অভিমান নিয়ে আমার মতোই চুপচাপ বেরিয়ে গেলে, সংসার থেকে। আমি ভাবতেই পারিনি তোমারও এত অভিমান ছিলো! অকাল বৈধব্যের দায়ে সারাটা জীবন ঘরের চার দেয়ালে আটকে ছিলে। পৃথিবীর রূপরসছন্দে তোমার জীবনের এক সিকি আনাও রাঙাতে জানলে না। জানতেই পারলে না জীবন কী! একহাত ঘোমটার আড়াল সরিয়ে কখনো সূর্যোদয় দেখলে না, সূর্যাস্তও নয়। কখনো গায়ে মেখে নিলে না নরম চাঁদের আলো। বৃষ্টির জলে শরীর ভেজালে কেমন লাগে, বুঝতেই পারোনি কক্ষণো। তবে কীভাবে এতটা নিস্তেজ, নিরানন্দ জীবনেও এমন অপরিমিত ভালোবাসা লালন করে গেলে জীবনভর। আর কাউকে তো এভাবে ভালোবাসলে না, শুধু আমিই তোমার হয়ে রইলাম সারাজীবন।

আজ এত বছর পর ভালোবাসার স্বরূপ শিখতে গিয়ে মনে পড়লো তোমার কথা। তুমি দৃষ্টান্ত হয়ে রইলে আমার কাছে, ভালোবাসার। এত এত বছর হারিয়ে ফেলার পর, এখন আমি গর্ব করে বলতে পারি কেউ একজন আমায় এমন সোনায় মোড়ানো ভালোবাসা দিতে পেরেছিলো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফাগুনের আগুন দুপুর
পরবর্তী নিবন্ধমাতৃভাষার অধিকারকে বুকের রক্ত দিয়ে আপন করে নেওয়ার ইতিহাস শুধুমাত্র বাঙালির