অনিরাপত্তা, অনিশ্চয়তার শরণার্থী জীবন

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২২ at ৮:৩১ পূর্বাহ্ণ

মিয়ানমার থেকে ফিরে এলাম ব্যাংকক। দুইএকদিন এখানে থাকতে হবে। ব্যাংককে আমি সাধারণত একটা হোস্টেলে উঠি। পুরানো ব্যাংককের এই হোস্টেলের সামনের খোলা জায়গায় বসে থাকতে ভালোই লাগে। বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন বয়সীর ভ্রমণকারীদের সাথে পরিচয় হয়, গল্প হয়। এই হোস্টেলের সব কর্মচারীই থাইল্যান্ডে এসেছে নিজের দেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে বা জীবনের ঝুঁকি থেকে বাঁচবার জন্য। একটা পাকিস্তানি ছেলে রিসিপশানে বসে। ২৯/৩০ বছর বয়সী হবে বড়োজোর। প্রথম যেদিন জেনেছিলাম ও পাকিস্তানি, আমার ভেতরের জাতীয়তাবাদী চেতনা জ্বলে উঠেছিল। কথা বলারই ইচ্ছে হয়নি। আমার চেহারায় ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের ছাপ দেখে হয়ত ছেলেটা নিজ থেকেই কথা বলত। আসতে আসতে জেনেছিলাম, ওর পরিবার খ্রিস্টান বলে নানা অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে। এক পর্যায়ে মেরে ফেলার হুমকি পাওয়া শুরু করার পর ছেলেটি ওর বউবাচ্চা নিয়ে টুরিস্ট ভিসায় থাইল্যান্ড চলে আসে এবং থাকা শুরু করে। প্রায় ৫/৬ বছর আগে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরএ আন্তর্জাতিক সুরক্ষা চেয়ে আশ্রয় প্রদানের আবেদন করে। যে কেউ এসে নিজেকে শরণার্থী দাবি করলেই সে শরণার্থী হয়ে যায় না। একজন মানুষ কখন শরণার্থী হিসেবে গণ্য হবে তার সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড আছে। ইউএনএইচসিআর তার আবেদন যাচাই বাছাই করে আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকারের পর ছেলেটি এবং তার পরিবারকে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের মত থাইল্যান্ডও জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক ১৯৫১ সালের কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। যার ফলে একজন শরণার্থী হিসেবে মানুষের যেসব অধিকার পাওয়ার কথা তা দিতে থাইল্যান্ড বাধ্য নয়, আবার আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুসারে আন্তর্জাতিক সুরক্ষা চেয়ে আশ্রয়প্রার্থীদের জোর করে বিতাড়িতও করতে পারবে না। একজন শরণার্থীর সমস্যা সমাধানের তিনটি উপায় আছেপ্রথমটি হল, শরণার্থীকে স্বেচ্ছায় তার দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যেখানে সে তার সম্মান নিয়ে নিরাপদে থাকতে পারবে, যেমন মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতে আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশের শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরে এসেছিল। যদি নিজ দেশে ফিরে যাওয়া সম্ভব না হয় তাহলে শরণার্থী যে দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে সে দেশে তাঁকে সকল নাগরিক সুবিধা দিয়ে থাকার ব্যবস্থা করা, এই প্রক্রিয়ায় শরণার্থী একসময় বৈধভাবে সেদেশের নাগরিকত্ব লাভ করে, এশিয়ার এই অঞ্চলে শরণার্থীরা এসুবিধা পায় না। ইউরোপ এবং আফ্রিকার কিছু দেশ তাদের দেশে আগত শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দিয়ে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কিন্তু, যদি একজন শরণার্থী তার নিজ দেশে ফিরে যেতে না পারে বা না চায় এবং যেদেশে আশ্রয় নিয়েছে সেখানেও স্থায়ীভাবে থাকতে না পারে, তবে শরণার্থীদের জন্য শেষ উপায় হল তৃতীয় কোন দেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা। শরণার্থী নিজে এই ব্যবস্থা করতে পারে না। যে সব দেশ শরণার্থীদের নিজ দেশে পুনর্বাসনে আগ্রহী, ইউএনএইচসিআর তাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং পুরো প্রক্রিয়ায় শরণার্থীকে সহায়তা প্রদান করে। তবে হাতে গোনা কয়েকটি দেশে নিজ দেশে শরণার্থী পুনর্বাসন করেএর মধ্যে সবচেয়ে বেশি করে ইউএসএ এবং কানাডা। পাকিস্তানি ছেলেটার মত এমন প্রায় ৪০ টি দেশের মানুষ থাইল্যান্ডে আছে যারা আপেক্ষায় আছে কোন একদিন তারা পশ্চিমা কোন দেশে পুনর্বাসিত হবে। এদের বেশিরভাগ নিজেরা বাসা ভাড়া করেই থাকে। মিয়ানমারের কিছু শরণার্থী থাকে ক্যাম্পে, আর রোহিঙ্গাদের আটকে রাখা হয় বিভিন্ন সরকারি ডিটেনশান সেন্টারে বা শেল্টারে। থাইল্যান্ডের প্রতিবেশী দেশ কম্বোডিয়া থেকে আগত এক শরণার্থীর সাথে পরিচয় হয়েছিল, যে প্রায় ২১ বছর ধরে অপেক্ষা করছে পুনর্বাসনের অপেক্ষায়। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার, কম্বোডিয়া বা লাওস থেকে আসা শরণার্থীদের সুবিধা হল, এরা থাইল্যান্ডে বৈধভাবে কাজ করার এবং থাকার অনুমতি পায়। কিন্তু, অন্যরা এখানে অবৈধভাবে বাস করে। যতদিন পশ্চিমের কোন দেশে পুনর্বাসন না হচ্ছে, ততদিন তাদের অবৈধভাবে পুলিশী গ্রেফতারের ভয়েভয়ে দিন যাপন করতে হয়। আর এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে লেগে যায় বছরের পর বছর, আবার সবার ভাগ্যে জোটেওনা পুনর্বাসন। প্রতিবছর সারা পৃথিবী থেকে লাখ লাখ পুনর্বাসনপ্রার্থীদের মধ্য থেকে ১% এর কম পুনর্বাসিত হতে পারে।

অবৈধভাবে বাসকারী পুনর্বাসন প্রার্থীরা আমি যে হোস্টেলে আছি তেমন জায়গাগুলোতে কাজ করে। পাকিস্তানি ছেলেটার সাথে কথা বলে জানলাম, প্রতিদিন সে ভয়ে থাকে কখন পুলিশ এসে হোস্টেলে সার্চ করবে। ধরা পড়লে কয়েক মাস থেকে বছর গড়িয়ে যেতে পারে জেলে যতদিন ইউএনএইচসিআর ছাড়াতে না পারে। কিন্তু, এই প্রক্রিয়াও সরকারের ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। সবচেয়ে চিন্তা তখন বউবাচ্চা কীভাবে চলবে? সাধারণত এইসব পরিবারের মেয়েরা খুব একটা বাইরে কাজ করে না। শরণার্থী নারীদের জীবন এখানে গৃহবন্দি জীবন অনেকটা। পুলিশের ভয়, ভাষাগত সমস্যা এইসব কারণে ঘরের বাইরে নারী বের হয় না।

এক চীনা শরণার্থী নারী, যে অই হোস্টেলে কাজ করে, জানিয়েছিল তার ভয় কেবল পুলিশের নয়, তার ভয় নিজের নারীত্ব নিয়ে। রাতে কাজ থেকে ফেরার পথে ভয়ে ভয়ে ফিরতে হয়। যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের এখানে আইনের মাধ্যমে বিচার পাওয়া দুষ্কর।

শ্রীলংকার এক মেয়ে জানিয়েছিল, তাকে আশ্রয়ের জন্য থাইল্যান্ড আসতে হয়েছিল তার রাজনৈতিক প্রভাবশালী বাবার জন্য। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে তার বাবার পক্ষে দেশে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। তাড়াহুড়ো করে দেশ ছাড়ার সময় থাইল্যান্ডকেই তাদের সহজ মাধ্যম মনে হয়েছিল। সেও প্রায় ৮/৯ বছর আগের কথা। এখন তারা পালিয়েপালিয়ে জীবন যাপন করছে। বিয়ে করতে চাইলেও, নিজের দেশের মানুষ নেই। কাজের ক্ষেত্রে কম বেতনে কাজ করতে হয়।

হোস্টেলের বারান্দায় বসে এমন বাঁচার তাগিদে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানিতে দেশ ছেড়ে আসা মানুষের অসংখ্য গল্প শুনি। বছরের পর বছর শিক্ষাসুবিধা বঞ্চিত, স্বাস্থ্যসুবিধা বঞ্চিত, মানবেতর জীবন যাপন করে চলেছে হাজার হাজার মানুষ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতিসংঘ মহাসচিবের সফরের মধ্যেই কিয়েভে জোড়া বিস্ফোরণ
পরবর্তী নিবন্ধঈদ-রোজা-চাকরি-সংসার এবং নারী