ঈদ-রোজা-চাকরি-সংসার এবং নারী

মিতা দাশ | শনিবার , ৩০ এপ্রিল, ২০২২ at ৮:৩২ পূর্বাহ্ণ

দুপুর তিনটায় রোজার দিনে অফিস ছুটির পর হন্তদন্ত হয়ে বের হতে যাওয়ার মুখেই বসের জরুরি তলব। দ্রুত পায়ে বসের কাছে যাওয়া, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপচারিতার সময় সহকর্মী পুরুষ সবার মনোযোগ থাকলেও নারীদের মুখে ক্লান্তির ছাপ, মনে তখন বাসায় ফিরে ইফতার বানানোর চিন্তা, বাচ্চাদের খাবার নিয়ে নানান আবদার মেটানোর তাগিদে মন বেশ অস্থির হয়ে থাকে। মন তখন ছটফট করে কখন বাসায় পৌঁছাতে পারবে। তবু অফিসের কাজ শেষ করতে হয় বসের কথায় আরো সময় নিয়ে।

পুরুষেরা বাসায় ফিরে সাহায্যের হাত লাগালো কি আর না লাগালো উনাদের এত চিন্তা করতে হয় না। আর নারীদের প্রথমেই দেরি করে বাসায় ঢোকার জন্য কৈফিয়ত দিতে হয়,তারপর নিজের প্রতি যত্ন

না নিয়ে সবার জন্য মনে করে করে পছন্দের সব খাবার বানানো। রোদে পুড়ে আসা নারীদের ঝলসানো তীব্র গরমের মধ্যে আগুনে দাঁড়িয়ে রান্না করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সবার পছন্দের সব কিছু তৈরি করে দিতে হয়। তারপর ইফতারে নারী কিছু নাকে মুখে গুঁজে কি বিশ্রাম পায়!

আবারও খাবার পর সব গুছিয়ে রাখো, এঁটোগুলো ধুয়ে রাখো। রাতের খাবার কি হবে সেটা ভাবতে ভাবতে সবাই কি খেতে পারবে কিনা, সেটা ভেবে তার আয়োজন করো। দৌড়াতে দৌড়াতে নামাজে বসলেও আবার সেই সংসারের কাজের ঝামেলাগুলোই মাথায় ঘুরতে থাকে নারীদের । পুরুষেরা ইফতার করে একবার বিশ্রাম নেয়, নামাজ পরে এসে আবার কিছুক্ষণ বিশ্রাম আবার রাতের খাবার খেয়ে টিভি দেখা, মোবাইল নিয়ে বিনোদন নেয়া তো আছেই। কিন্তু চাকরি থেকে আসা নারীরা তখনও কাজের পর কাজ করেই যাচ্ছে। তাদের কোনও বিশ্রাম নেই।

ঘেমেনেয়ে তখনও রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে বাচ্চাদের দেখতে হচ্ছে। তাদের খাইয়ে দিয়ে তাদের ঘুমের ব্যবস্থা করে আবার ভোরে সেহরির সময় কি খাবে তার সব ব্যবস্থা করে রাখতে হচ্ছে। বিকেলের ইফতারের জন্য ছোলা ভেজাতে দিয়ে সব গুছিয়ে যখন শুতে যায়, তখন মাঝরাত।

এলার্ম দিয়ে শুলেও ভালো ঘুমাতে পারে না ভোরে যদি ঠিক সময় উঠতে না পারে সেই আতঙ্কে। তবু সবকিছু সহ্য করে যখন চোখটা ভালো করে ঘুমে ডুব দেয়ার সাথে সাথে বেজে ওঠে এলার্ম।

কেউ উঠে না কিন্তু নারীকে উঠতেই হয়। তিনি যে সংসারের কর্ত্রী।তবে কর্ত্রী শুধু কাজের বেলায়। বাকী সময়ে তিনি বড্ড অবাঞ্ছিত। পরিবারের পুরুষেরা আরো কিছুক্ষণ ঘুমাতে পারলেও নারীকে উঠে খাবার গরম করে বেড়ে টেবিলে সাজিয়ে সবাইকে ডেকে তুলে আনতে হয়।

আবারও সবাই খেয়ে উঠে গেলেও নারী কিন্তু তখনও ওদের মতো আবার নামাজ পড়ে ঘুমাতে যেতে পারে না। তিনি সব খাবার গুছিয়ে, প্লেট ধুয়ে, সব গোছগাছ করে, নামাজ পড়ে ঘুমাতে যেতে যেতে চিন্তা করে এখন ঘুমাতে গেলে সকালে চাকরিতে বের হতে দেরি হয়ে যেতে পারে। তাই একটু বিছানায় গড়িয়ে নিলেও আর ঠিক মতো ঘুমানো হয়ে ওঠে না।

আবার যথারীতি পরিবারের সবাই উঠার আগেই সেই নারীকে উঠে ঘরের, বাচ্চার সবার সব কাজ গুছিয়ে খাবার, ব্যাগ, জিনিসপত্র, ঘর গুছিয়ে, ইফতারের কিছু কাজ এগিয়ে রেখে বের হতে হয় চাকরিতে। তখন পুরুষেরা আস্তে আস্তে ওঠেন তাদের কাজে বের হওয়ার জন্য। তখন যদি হাতের নাগালে সব না পান তাহলে সেই দোষটাও কিন্তু ঘরের সেই পরিশ্রমী নারীর।

আমাদের পুরুষ সমাজ কি প্রতি ঘরে থাকা এসব নারীদের যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করে? পুরুষেরা কি নারীদের পাশে বন্ধু হয়ে, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়?

উত্তর হবে দুএকজন শুধুমাত্র। যারা একটু ব্যতিক্রম তারাই শুধু নারীদের পাশে দাঁড়ায়। বাকী সব পুরুষ দোষ ধরতেই ব্যস্ত।

তাদের কথা হয় বরং

এগুলো কি নাস্তা হলো?’

এসব খেতে খুব বাজে হয়েছে।’

রান্নার সময় মন কোথায় থাকে!’ ইত্যাদি ।

এমনকী ঘরে থাকা বৃদ্ধ শ্বশুরশাশুড়িও ভাবে ঘরে বউ হয়ে আসা নারীই সব করবে।

প্রথাগত এই ভাবনাগুলো বদলে ফেলার সময় এসেছে। বদলে গিয়ে দেখুন নারীর পাশে দাঁড়ানো আলাদা করে মহৎ কিছু নয়। এআপনার সংবেদনশীল মনের পরিচায়ক মাত্র। আসুন তাদের সাথে হাত মিলিয়ে কাজ করে তাদেরও কিছুটা বিশ্রামের সুযোগ করে দিই। অফিস, বাসা, কাজে ইফতার ও সেহরি, ঈদ সবক্ষেত্রে কিছুটা সাহায্যের মধ্য দিয়ে তাদেরও কিছুটা আরাম দিই।

তবেই হবে সাম্য, তবেই আসবে সুখ। সংসারেসংসারে বন্ধন হবে দৃঢ়। নারীদের যোগ্য সম্মান ও সহযোগিতা দিয়ে পাশে দাঁড়ান সকল পুরুষ সমাজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনিরাপত্তা, অনিশ্চয়তার শরণার্থী জীবন
পরবর্তী নিবন্ধনিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে অন্যের সাহায্য চাইছে সরকার