অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে শেষের পথে

কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং দুই বিদেশী প্রতিষ্ঠানের ফেলে যাওয়া কাজ শেষ করছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ।। প্রতিদিন গড়ে ২৫ টন পলিথিন অপসারণ

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

নানা প্রতিকূলতা এবং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতার পরও শুধুমাত্র অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরেই শেষ হতে চলেছে কর্ণফুলী নদীর ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প। আগামী কিছুদিনের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হলেও ইতোমধ্যে প্রকল্পের সুফল মিলতে শুরু করেছে। প্রতিদিন গড়ে ২৫ টন পলিথিনসহ বিপুল পরিমাণ ময়লা আবর্জনা অপসারণের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে চলেছে বহুদিন ধরে চলে আসা বিশাল এই কর্মযজ্ঞ। দুই দুইটি বিদেশী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান কাজ ফেলে দিয়ে চলে যাওয়ার পর দেশীয় একটি কোম্পানিকে দিয়ে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প সম্পন্ন করা হচ্ছে।
সূত্র জানিয়েছে, জোয়ার-ভাটার কর্ণফুলী নদীর যে চরিত্র তাতে প্রতি দশ বছর পর এখানে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প পরিচালনার পরামর্শ রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। কর্ণফুলী নদী ভরাট হওয়ার প্রবণতা বেশি। খুবই অল্প সময়ে নদীতে চর জেগে ওঠে। একটি খুঁটি পুঁতে রাখলেও তা ঘিরে তৈরি হতে থাকে বালুচর। কিন্তু নানা ধরনের জটিলতায় কর্ণফুলী নদীতে ড্রেজিং কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল না বহুদিন ধরে। সদরঘাট থেকে বাকলিয়ার চর পর্যন্ত এলাকায় ৮টি খাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য ও আবর্জনা কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। প্রতিদিন শত শত টন বর্জ্য নদীতে পড়ার ফলে ভরাট হয়ে যায় নদী। জেগে ওঠে চর। বিশেষ করে পলিথিনের জঞ্জালে নদীর তলদেশে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ পরিস্থিতি। নদীর প্রশস্ততা কোথাও কোথাও ৮০০ মিটার থেকে কমে ৪০০ মিটারে ঠেকেছে। চর জেগে উঠার কারণে ব্যাহত হয় স্বাভাবিক নৌ চলাচল। সদরঘাট এলাকাসহ বন্দরের ১ ও ২ নম্বর জেটি স্বাভাবিক নাব্যতা হারায়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২০০৯ সালে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প হাতে নেয়।
আন্তর্জাতিক দরপত্রসহ নানা প্রক্রিয়া শেষ ২০১১ সালে মালয়েশিয়ার মেরিটাইম এন্ড ড্রেজিং কর্পোরেশন নামের একটি কোম্পানিকে ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ দেয়া হয়। তারা বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে কাজ শুরু করলেও কিছুদিন পর চট্টগ্রামের প্যাসিফিক মেরিন নামের একটি কোম্পানির কাছে কাজটি হস্তান্তর করে চলে যায়। কিন্তু দেশী- বিদেশী দুই কোম্পানি নানাভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এক পর্যায়ে প্রকল্প ফেলে গা ঢাকা দেয় স্থানীয় কোম্পানিও। মালয়েশিয়ান কোম্পানিও চলে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়া এবং ড্রেজিংয়ের নামে নদীর বিভিন্ন অংশ ভরাট ও বালি বিক্রি করার কারণে বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়ে কর্ণফুলী। কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল
ড্রেজিংসহ সব আয়োজনই মুখ থুবড়ে পড়ে।
পরবর্তীতে ২৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়ার চর ড্রেজিং’ নামে প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২৫০ মিটার চওড়া এলাকায় ড্রেজিং পরিচালনার উদ্যোগে পৃথক একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যাতে নদী থেকে ৪২ লাখ ঘনমিটার বালি ও মাটি উত্তোলনের টার্গেট ধরা হয়।
ডিপিএম পদ্ধতিতে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর মাধ্যমে চীনের বিশ্বখ্যাত কোম্পানি চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেডকে দিয়ে কাজ শুরু করে। চায়না কোম্পানি কাজ শুরু করলেও অল্পদিনের মধ্যে তাদের আশাভঙ্গ হতে শুরু করে। নদীর তলদেশের পলিথিন জঞ্জাল তাদের সব আয়োজন ভুণ্ডুল করে দেয়। নদীর তলদেশে ২১ ফুট পুরু পলিথিন আস্তর চীনা প্রকৌশলীদেরও বুদ্ধি ফেল করে দেয়। পলিথিন স্তরের কারণে ড্রেজার দিয়ে কাজই করা সম্ভব হতো না। এমনকি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ৩২ ইঞ্চি ব্যাসের শক্তিশালী কাটার সাকশন ড্রেজার এনেও কাজ করতে পারেনি। এক বছরেরও বেশি সময়ে মাত্র ত্রিশ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করেছিল চায়না হারবার।
প্রকল্পের কাজ নিয়ে যখন চীনা কোম্পানি দিশেহারা তখন বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম প্রকল্পটির ব্যাপারে নতুন একটি পরামর্শ দেয়। বুয়েটের বিশেষজ্ঞ টিম বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রিপোর্ট দেয় যে, নদী থেকে ৫১ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালি উত্তোলন করতে হবে। এতে প্রকল্প ব্যয় ৬৩ কোটি টাকা বাড়বে। এই বৃদ্ধি অনুমোদন করে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ৩০২ কোটি টাকা।
কিন্তু নানাভাবে চেষ্টা করেও কাজ করতে না পেরে এক পর্যায়ে চায়না হারবারও চলে যায়। তারা কাজ করতে পারবে না বলেও জানিয়ে দেয়।
পরবর্তীতে প্রকল্পের মূল ঠিকাদার বাংলাদেশ নৌবাহিনী ই-ইঞ্জিনিয়ারিং নামের দেশীয় একটি কোম্পানিকে দিয়ে কাজ শুরু করে। প্রকল্পটির পরতে পরতে সমস্যা ও বাধা-বিপত্তি থাকা সত্ত্বেও বন্দর কর্তৃপক্ষ, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠান ই-ইঞ্জিনিয়ারিং নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে।
করোনা পরিস্থিতি, তেলের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও প্রকল্পের কাজ নিরবছিন্ন ভাবে চালু রাখা হয়। প্রকল্পের কাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে সম্পন্ন এবং নদীর তলদেশের পলিথিনের পাহাড় অপসারণের স্বার্থে বিশ্বসেরা আই এইচ সি ব্রান্ডের তিনটি কাটার সাকশন ড্রেজার প্রকল্প এলাকায় নিয়ে আসা হয়। এ ছাড়া লংবুম এঙকেভেটর, শর্ট-বুম এঙকেভেটর, ভাসমান বার্জসহ গ্র্যাব ড্রেজার, এম্ফিবিয়ান ড্রেজার সহ কত ধরনের ইক্যুইপমেন্ট যে কর্ণফুলী নদীতে নামানো হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। বিশ্বের সেরা সব ড্রেজিং ইক্যুইপমেন্ট ব্যবহার করে ই ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকল্পটির কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে।
প্রকল্প পরিচালক এবং বন্দরের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার আরিফ গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ করে আনতে পেরেছি। ইতোমধ্যে প্রায় ৯৪ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের বাকি কাজগুলোও খুবই দ্রুততম সময়ে শেষ করা হবে। তবে ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের সুফল মিলতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, কর্ণফুলী নদী ফিরে পেয়েছে তার স্বাভাবিক গতি, বৃদ্ধি পেয়েছে নাব্যতা। সচল হয়েছে ৪০০ মিটার জেটি। এই জেটির কারষে বন্দর কর্তৃপক্ষ বার্ষিক আয় করছে ৮০ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের কারণেই সদরঘাটের ৩টি লাইটারেজ জেটি সার্বক্ষণিক সচল রয়েছে। এর ফলে স্বাভাবিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহের দরুণ কর্ণফুলী নদীর বন্দর চ্যানেলের নাব্যতাও বৃদ্ধি পেয়েছে, ঝুঁকি কমেছে শাহ আমানত সেতুর। পূর্বে যেখানে শাহ আমানত সেতুর শুধুমাত্র দুটি পিলারের মধ্য দিয়ে পানি প্রবাহিত হত, সেখানে বর্তমানে চারটি পিলারের মধ্য দিয়ে পানির অবাধ প্রবাহ চলছে। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীতে আগের থেকে অনেক বেশি লাইটারেজ জাহাজ নোঙর করতে পারছে। নতুন ফিশারি ঘাট সংলগ্ন এলাকায় আগে ঘাট থেকে ২শ থেকে ৩শ মিটার দূর থেকে নৌকা এবং ট্রলার ভিড়িয়ে মাছ আনলোড করতে হতো। এখন সেখানে নৌযান সরাসরি ঘাটে নোঙর করে মাছ আনলোড করছে। এর ফলে প্রচুর অর্থ ও সময় সাশ্রয় হচ্ছে। নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনেও প্রকল্পটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলছে, একটি গণমুখী যুতসই প্রকল্প যে সমাজে নানাভাবে অবদান রাখতে পারে তার সফল উদাহরণ কর্ণফুলী ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্প।
ক্যাপিটাল ড্রেজিং প্রকল্পের পরিচালক কমান্ডার আরিফ বলেন, ‘আমাদের মূল কার্যক্রম শেষ হতে চলেছে। তবে ড্রেজিং কার্যক্রম বন্ধ হবে না। নদীতে বর্তমানের অবস্থা ধরে রাখতে আগামী তিন বছর নিয়মিত কার্যক্রম চলবে। নদীর বুকে আর কোনো চর দেখা যাবে না। আমরা সব চর কেটে মাটি তুলে ফেলেছি।’
তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতির প্রাণপ্রবাহ কর্ণফুলী নদী। এই নদীকে রক্ষা করতে ড্রেজিং কার্যক্রম নিয়মিত পরিচালনা করতে হবে। একই সাথে নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে। নদীর তলদেশ থেকে যা তোলা হচ্ছে তার ৮০ শতাংশই পলিথিন উল্লেখ করে কমান্ডার আরিফ বলেন, পলিথিনের এই জঞ্জাল নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে চড়া মূল্য দিতে হবে। পলিথিন সহ বিভিন্ন বর্জ্য যাতে নদীর তলদেশে আবারো পাহাড় সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সকলকে সজাগ থাকতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপুলিশ আক্রান্ত হলে নিজেকে রক্ষার অধিকার থাকবে না?
পরবর্তী নিবন্ধশঙ্খচরে আগাম শীতকালীন সবজির চাষ