অচেনারে হয় চেনা

শরণার্থী, নারীবাদ এবং একজন নারী ভ্রমণকারীর গল্প

রূপা দত্ত | শনিবার , ১৮ জুন, ২০২২ at ১২:১৩ অপরাহ্ণ

চ্যাংমাইয়ে আমাদের থাকার জায়গা হয় শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে হান ডং নামক এলাকার নতুন গড়ে ওঠা এক আবাসিক এলাকায়। সুপাকারন নামের ষাটোর্ধ্ব এক নার্স তার বাড়িতে আমাদের থাকতে দেন। ইয়ান্নিক যোগাযোগ করেছিল সুপাকারনের সাথে কাউচসারফিং নামক ভ্রমণ বিষয়ক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। আমাদের আগে আর কেউকে সুপাকরন রাখেননি উনার বাড়িতে। ফলে, উনার যাতে ভ্রমণকারীদের নিয়ে ভাল অভিজ্ঞতা হয়, সেই একটা দায়িত্ব এসে পড়ে আমাদের উপর। ছিমছাম সুন্দর সাজানোগোছানো আবাসিক এলাকা। আবাসিক এলাকার গেইট থেকে বের হলে একটা মফস্বলভাব, অনেকটা শহরের কাছের গ্রামের মতো। গাড়ির রাস্তা প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে। এলাকার শান্ত ভাবটা মনে শান্তি এনে দিল।

সুপাকরন পেশায় নার্স। উনাকে দেখে উনার বয়স কিছুতেই বোঝা যায় না। খুব কম কথা বলেন। আমরা যে বাড়িটায় আছি, সেটি উনার নিজের বাড়ি। খালি পড়ে থাকে। উনি থাকেন কাছেই উনার স্বামীর সাথে অন্য একটা বাড়িতে। ব্যক্তিগতভাবে থাইল্যান্ডে কাউচসারফিং-এর মাধ্যমে এই প্রথম থাকছি। এর আগে ইন্দোনেশিয়াতে থেকেছি। আর নিজের বাসায় ভ্রমণকারীদের থাকতে দিয়েছি। ভ্রমণকারীদের এই মাধ্যম যখন শুরু হয়েছিল অনেক বছর আগে, এর উদ্দেশ্য ছিল এক জায়গার ভ্রমণকারী অন্য জায়গার ভ্রমণকারীদের সাহায্য করবে, ভ্রমণকারীরা স্থানীয়দের সাথে থেকে সেই জায়গার মানুষ, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবে এবং সবচেয়ে বড় কথা বিনা খরচে থাকবে। থাকার জন্য কোনও টাকা দিতে হয় না। একসময় এই প্লাটফর্মটি ব্যবহার করবার জন্য কোনও টাকা লাগত না। আবার নিরাপত্তার জন্য এদের নিজস্ব ব্যবস্থা ছিল, কোনও ভ্রমণকারী অনিরাপদ বোধ করলে তারা জানাতে পারত। যদিও এই ব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে খুব একটা কার্যকর ছিল না কারণ পুরো যোগাযোগ হত অনলাইনের মাধ্যমে। কিন্তু, একজন হোস্ট কেমন মানুষ সেটা জানা যায় হোস্টের প্রোফাইলে অন্য ভ্রমণকারীদের লেখা মন্তব্য থেকে। একটু বুঝিয়ে বললে আমরা যখন সুপাকরনের প্রোফাইল দেখি, তখন সেখানে অন্য কোনও ভ্রমণকারীর মন্তব্য ছিল না, কারণ আমরাই প্রথম উনার বাড়িতে ছিলাম।

উনার নিজের সম্পর্কে সেখানে লেখা ছিল। আমরা নির্ধারিত থাকার সময় শেষ হবার পর, কাউচসারফিং থেকে আমাদের কাছে ম্যাসেজ আসে আমাদের কেমন লেগেছে সুপাকরনের আতিথেয়তা। সেখানে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা লিখি, আমার একইভাবে সুপাকরনের কাছেও জানতে চাওয়া হয়েছে আমাদেরকে উনার কেমন লেগেছে, আমরা কি উনার বাড়ির নিয়মকানুন মেনে চলেছি কী না। এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এই যে একে অপরের সম্পর্কে মন্তব্য করল, সেটা নির্দিষ্ট সময় পর উভয়ের প্রোফাইলে যুক্ত হবে। কেউ কারো বক্তব্য পছন্দ না করলে সেখানে মন্তব্য করতে পারবে, কিন্তু একবার প্রোফাইলে মন্তব্য যুক্ত হয়ে গেলে ফেসবুকের মত আবার ঠিক করে মুছে পুনরায় লেখার সুযোগ নেই। ফলে, ভ্রমণকারী কারো বাড়িতে থাকার আগে তার সম্পর্কে করা অন্যদের মন্তব্য পড়ে নিতে পারে আবার হোস্টও যাকে থাকতে দেবে তার সম্পর্কে অন্যরা কি বলেছে সেটি জেনে নিতে পারবেন। এভাবে, পৃথিবীর নানা প্রান্তের অচেনা ভ্রমণকারীরা একে অপরের চেনা হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে থাকাকালীন আমার পক্ষে কোনও ভ্রমণকারীকে আমার বাসায় রাখা সম্ভব হয়নি কারণ আমার ধারণা ছিল কাউচসারফিং কেবল বিদেশিদের জন্য। আর আমাদের ছোট্ট বাসায় কেমনে একটা বিদেশিকে থাকতে দেব! কিন্তু, পরবর্তীতে নিজে থাকতে গিয়ে জেনেছি, আমার ঘরে থাকার ব্যবস্থা কেমন সেটাও প্রোফাইলে পরিষ্কার বলে দিতে হয়, সেটা পড়ে কারো ইচ্ছে হলে থাকার জন্য অনুরোধ করতে পারে। আর কাউচসারফিং দেশি-বিদেশি সকল ভ্রমণকারীর জন্য। বিদেশি বলে আলগা খাতির নাই। পরিচিত, আবার পরিচিতের পরিচিত অনেকেই আমাদের বাসায় এসে থাকতেন। এমনও হয়েছে আমার পরিচিতের পরিচিত থাকার জায়গা ছিল না বলে মাসখানেকও ছিল আমাদের বাসায় কিন্তু আমার সাথে দেখা হয়নি, কারণ আমি অন্য শহরে থাকতাম। পারিবারিকভাবেই চেনা-অচেনা মানুষদের থাকতে দেয়ার প্রচলন আমাদের বাসায় ছিল। আর বাংলাদেশীরা তো অন্য এলাকায় কোন কাজে গেলে হোটেলে থাকে না, বরং আত্মীয়স্বজন, পরিচিত বন্ধুবান্ধব কিংবা পরিচিতের পরিচিতদের বাসা-বাড়িতেই থাকে। যদিও ছেলেদের ক্ষেত্রে এখন হয়ত কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে, হয়ত এখন এলাকায় আবাসিক হোটেল থাকলে সেখানেই ওঠে, কিন্তু মেয়েদের ক্ষেত্রে এখনও আগের মতোই। আমার এক প্রাক্তন সহকর্মীর কথা মনে পড়ল। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করে টেকনাফে খুব ভালো পজিশনে চাকরি করছিল। কিন্তু, চাকরির কারণে কখন কখন কক্সবাজারে হোটেলে থাকতে হতো। অফিসই সব ব্যবস্থা করে দিত।

কিন্তু, এই কথা তার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে জানাজানি হবার পর, তারা তার চাকরি নিয়ে প্রশ্ন করা শুরু করল। তাদের কথায়, একা একটা মেয়ে হোটেলে থাকে, তার মানে মেয়ের চরিত্র খারাপ। কিন্তু, সেই আত্মীয়েরা জানত না, একা একটা মেয়ের হোটেলে রুম পায় না অফিসের ব্যবস্থা ছাড়া, অথবা পরিচিত রেফারেন্স ছাড়া। ওই একই সময়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা ছিল বেশ অস্বস্তিকর। আমিও অফিসের কারণে একবার হোটেলে ছিলাম, সেটা ছিল প্রথম একা থাকা। আমার পুলিশ কর্মকর্তা বন্ধু এল আমার সাথে দেখা করতে এবং নিরাপত্তা নিয়ে আশ্বস্ত করতে। যতক্ষণ সে আমার রুমে ছিল, আমার রুমের দরজা খোলা রেখে তার সাথে কথা বলতে হয়েছিল এবং হোটেলের একজন রুম পরিষ্কার করার লোক গোয়েন্দার মতো কিছুক্ষণ পর পর এসে চেক করে যাচ্ছিল। ঘটনা এখানেই শেষ না, হোটেল কর্তৃপক্ষ এই ঘটনা আমার অফিসে জানিয়েছিল, এবং আমার ইউরোপিয়ান সুপারভাইজার খুব অবাক হয়ে আমাকে ফোন করে জানতে চাইল কেন হোটেলে কর্তৃপক্ষ আমার গেস্ট এসেছে সেটা ওকে জানিয়েছে। এই অবস্থা যে খুব একটা এখন বদলেছে তা নয়। কক্সবাজারে এখন অনেকে চাকরি করেন বলে হয়ত হোটেলে রুম পেতে এতটা ভোগান্তিতে পড়তে হয় না, কিন্তু এত সহজও নয়। অনেকের ধারণা কক্সবাজারে যারা কাজ করে তারা খালি টাকা উড়ায় আর ফুর্তি করে। কিন্তু, ক্যাম্পের কঠিন পরিবেশে অগণিত প্রতিকূলতাকে মেনে নিয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শরণার্থীদের নিয়ে কাজ করা কতটা মানসিক চাপ তৈরি করে, সেটা ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন। যাই হোক, আত্মীয়-স্বজনের কথা থেকে বাঁচবার জন্য, আবার সেই সহকর্মী শেষ পর্যন্ত চাকরি ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

বলছিলাম, কাউইচসারফিংয়ের মাধ্যমে কি করে অচেনা মানুষগুলোর সাথে সম্পর্ক তৈরি হয়। থাইল্যাণ্ড আসার পর আমি প্রথম যে ভ্রমণকারীকে আমার বাসায় থাকতে দিই, উনিও ছিলেন ষাটোর্ধ্ব এক গ্রীক ভদ্রলোক, যে সাইকেলে করে বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছিল। উনার প্রোফাইলে লেখা ছিল উনি বাংলাভাষা জানেন কিন্তু কখনও বাংলাদেশে ছিলেন না, এটা আমার জন্য খুব আকর্ষণীয় ছিল। সেই সুদূর গ্রীসের এক লোক, সে কেন বাংলা শিখল সেটা জানার আগ্রহে আমি উনাকে হোস্ট করেছিলাম। উনার নাম লেখা ছিল, কন্সটেন্টাইন। উনি দেখতে কিছুটা আমার মৃত নানা ভাইয়ের মতো ছিলেন বলে উনাকে আমি গ্র্যান্ড’পা ডাকার অনুমতি পেয়েছিলাম। পরে জেনেছিলাম, বাংলাদেশের ময়মনসিংহের এক আধ্যাত্মিকের কিছু লেখার ইংরেজি অনুবাদ পড়ে উনি এত অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন যে, পরবর্তীতে শান্তি নিকেতনে বাংলা শেখেন শুধুমাত্র সেই আধ্যাত্ত্বিকের লেখা পড়বার জন্য। ওনার ‘কন্সটেন্টাইন’ নামটা নিজের দেয়া। নাম নিয়ে বলছিলেন, উনি নিজের নাম খুঁজে বেড়াচ্ছেন, পারিবারিক যে নাম সেটা তো কেবল ডাকার জন্য, সেটা তাঁর পরিচয় নয়। উনার সাথে করে আমি আশেপাশের অনেক জয়গা ঘুরেছি। উনি ব্যাখ্যা করে আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানের অর্থ, বুঝিয়েছিলেন ‘মন’ আর ‘হৃদয়ে’র পার্থক্য। নির্বাক ধ্যান কি, থাইল্যান্ডের কোথায় ধ্যান করা যায় সেটাও জেনেছিলাম কন্সটেন্টাইনের কাছ থেকেই। পরে খবর নিয়ে দেখি, ধ্যানের জন্য থাইল্যান্ডে অনেক সুযোগ আছে। যেখানে ধ্যান করার জন্য, আত্মিক উন্নয়নের চেষ্টার জন্য টাকা দিতে হয় না, নিজের সময় দিতে হয় কেবল। গ্রীসের শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে কথা হয়েছিল আমাদের। উনি জানালেন একটা দ্বীপ, দেশ আর্থিক সমস্যার মধ্যে থেকেও হাজার হাজার শরণার্থীদের জায়গা দিতে পেরেছিল কেবল সেখানকার অধিবাসীদের আন্তরিকতার কারণে।

কিন্তু, সময়ের সাথে সাথে ওদের ভেতরেও শরণার্থী বিদ্বেষ শুরু হয়েছে ক্রমাগত শরণার্থী যাওয়ার ফলে। কেবল তো শরণার্থী নয়, উনি জানালেন বাংলাদেশ বা এমন আরও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা দেশ থেকে মানুষ অবৈধভাবে যাচ্ছে কাজের জন্য। আবার চীনের থাবাও পড়েছে গ্রীসে। চীনা কোম্পানিগুলো কাজ শুরু করার পর সেখানকার কাজের পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সব মিলিয়ে, ইতিহাসে যে প্রভাবশালী দেশের কথা আমরা জানি, সেখানকার মানুষ ভালো নেই। আমার বাসা থেকে চলে যাবার পর কন্সটেন্টাইনের খবর নিতে গিয়ে জানলাম, উনি সাইকেল ছেড়ে নৌকায় চড়ে বসেছেন আফ্রিকার উদ্দেশ্যে। সেটাও খুব মজার ঘটনা। ঘুরতে ঘুরতে উনি চলে গেলেন সিঙ্গাপুর। সেখানে এক ভ্রমণকারীর সাথে পরিচয়, যে বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে পালতোলা নৌকা নিয়ে। তার পরবর্তী গন্তব্য আফ্রিকার দেশ মাদাগাসকার, যেটি সিঙ্গাপুর থেকে কাছে। বেশ হয়ে গেল! কন্সটেনটাইন নিজের সাইকেল প্যাক করে রওনা হয়ে গেলেন মাদাগাসকার। উনি কখনও বলেননি ওনার পেশা কি ছিল, কেবল বলেছেন উনি ‘নিজের সন্ধান’ করছেন। আমার মোটা মাথায় তখন কিছুতেই ঢোকেনি ‘নিজের সন্ধান’ আবার কি জিনিস! কিছুদিন আগে কাউচসারফিংয়ে উনার প্রোফাইলে দেখলাম উনার পেশা কি ছিল সেটা লিখেছেন, হয়তো আমার মতো অনেক মাথামোটার প্রশ্ন এড়াতে। দেখে আমার চোখ কপালে উঠেছিল, কন্সটেন্টাইন ছিলেন নাসার একজন প্রকৌশলী, সেখান থেকে বের হয়েছেন আত্মার সন্ধানে।

** এই ভ্রমণ গল্প ২০১৭ সালের।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবিতা ও আবৃত্তির চর্চা তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রকৃতিনির্ভর টেকসই জীবনব্যবস্থা