অগ্নিযুগের অগ্নিকন্যারা আমাদের

মোহছেনা ঝর্ণা | শনিবার , ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৩৬ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার (১৯১১-১৯৩২)

বাংলার স্বাধীনতা আর বীরকন্যা প্রীতিলতা যেন একসূত্রে গেঁথে আছে। মাত্র ২১ বছর বয়সে দেশ মায়ের জন্য নিজের জীবনকে তুচ্ছ করতে শিখে যাওয়ার এই অদম্য শক্তি আমাদের অনুপ্রেরণা। মাষ্টারদা সূর্য সেনের যোগ্য অনুসারী প্রীতিলতার বাবা জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার এবং মা প্রতিভা ওয়াদ্দেদার। পড়ালেখায় মেধাবী প্রীতিলতা চট্টগ্রামের খাস্তগীর স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ইন্টারমিডিয়েটে ঢাকা বোর্ডে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং ছেলে-মেয়েদের মধ্যে সম্মিলিতভাবে পঞ্চম স্থান অধিকার করেন। সরকারের কুড়ি টাকা বৃত্তি নিয়ে কলকাতার বেথুন কলেজে দর্শন শাস্ত্রে অনার্সে ভর্তি হন। পরবর্তীতে বিপ্লবী কর্মকান্ডে যোগ দিতে গিয়ে অনার্স সম্পন্ন না করে ডিস্টিংশনে বিএ পাস করেন। ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের সময়কালীন প্রীতিলতা চট্টগ্রামের নন্দন কানন স্কুল( যা বর্তমানে অপর্ণাচরণ স্কুল নামে পরিচিত।) এর প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন। ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর প্রীতিলতার নেতৃত্বে ‘পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব’ এ সফল আক্রমণ শেষে ফেরার সময় শত্রুপক্ষের গুলিতে আহত হয়ে ধরা পড়ার আগেই নিজের সঙ্গে রাখা পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে এই বীর কন্যা। শারীরিক ভাবে প্রীতিলতা না থাকলেও তার আদর্শ এখনো এই বাংলার নারীদের জন্য সাহসের অনুপ্রেরণা।

কল্পনা দত্ত (১৯১৩-১৯৯৫)

বীরকন্যা কল্পনা দত্ত ছিলেন প্রীতিলতার সহযোদ্ধা। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের সেই মিশনে কল্পনা দত্তও ছিলেন। কিন্তু ক্লাব আক্রমণের মাত্র ক’দিন আগেই ১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২- এ ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনার জন্য আশ্রয়কুটির যাওয়ার পথে পুরুষবেশী কল্পনা পাহাড়তলীতে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। পুলিশের কড়া নজরদারির কারণে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারেননি। কল্পনার বাবা বিনোদবিহারী দত্ত, মা শোভানাবালা দত্ত। কল্পনা দত্তের ঠাকুরদা রায়বাহাদুর দূর্গাদাস চট্টগ্রামের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং স্বনামধন্য চিকিৎসক। ইংরেজ সরকার তাকে বেশ সমীহ করতেন। একারণে কল্পনা দত্তের বাড়ি অনেকদিন পুলিশের নজর থেকে নিরাপদ ছিল। কল্পনা দত্তও বেথুন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে গেলে বেথুন কলেজ থেকে চট্টগ্রাম কলেজে চলে আসেন। কল্পনা ছিলেন বিজ্ঞানের ছাত্রী। তাই কলকাতায় থাকা অবস্থায় তার দায়িত্ব ছিল সেখান থেকে বোমা তৈরির মালমশলা আনা এবং নিজ বাড়িতে বসে বারুদের খোল তৈরি করা। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন মামলায় (সাপ্লিমেন্টারি) তিন প্রধান আসামী ছিলেন মাষ্টারদা সূর্য সেন, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার এবং বিপ্লবী কল্পনা দত্ত। বয়স অল্প থাকায় কল্পনার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এ-সময় গান্ধীজি, রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্য কংগ্রেস নেতারা গভর্নরের সাথে দেখা করে কল্পনার মুক্তির চেষ্টা করেন। আট বছর কারাভোগের পর দেশবাসীর চেষ্টায় কল্পনা দত্ত মুক্তি পান।

ইন্দুমতী সিংহ (১৮৫৭-১৯৬৭)

চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের অন্যতম বিপ্লবী অনন্ত লাল সিংহ এর বড় বোন বীর কন্যা ইন্দুমতী সিংহ। ১৯১৯ সালের জালিওয়ানওয়ালাবাগে ইংরেজ কর্তৃক নিরাপরাধ নরনারী হত্যার প্রতিবাদে গর্জে ওঠে সারা বাংলার মানুষ। ১৯২০ সালে দেশবন্ধ চিত্তরঞ্জন দাশ এসেছিলেন চট্টগ্রামে। ১৯৩১ সালের ডিনামাইট ষড়যন্ত্র পরিকল্পনায় ছিলেন মাষ্টারদা সূর্য সেন, নির্মল সেন, গণেশ ঘোষ এবং অনন্ত সিংহ। এ-সময় ইন্দুমতী সিংহ ডিনামাইট যোগাড়ের ব্যাপারে সরোজকুমার দত্তের সাথে কাজ করেন। ১৯৩১ সালের ১৫ ডিসেম্বর কুমিল্লায় ইন্দুমতী সিংহ গ্রেফতার হন এবং পরবর্তীতে ছয় বছর রাজবন্দী হিসেবে হিজলি জেলে ছিলেন।

সাবিত্রী দেবী (১৮৮৭-১৯৪৭)

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের বীর নারীদের মধ্যে সাবিত্রী দেবীর ভূমিকা অন্যতম। পটিয়ার ধলঘাটে বিধবা সাবিত্রী দেবীর বাড়িটি বিপ্লবীদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত ছিল। বিপ্লবীদের কাছে এই বাড়িটির গোপন নাম ছিল “আশ্রম”। মাষ্টারদা সূর্য সেনের সাথে এই বাড়িতেই বীরকন্যা প্রীতিলতার দেখা হয়। সেদিনই পুলিশের সাথে সংঘর্ষে এ বাড়িতেই নিহত হন বিপ্লবী নির্মল সেন এবং অপূর্ব সেন। পলাতক বিপ্লবীদের বাড়িতে আশ্রয় দেয়ার জন্য পুত্রকন্যাসহ সাবিত্রী দেবীর চার বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হয়। এই জেলেই পুলিশের অত্যাচারে নির্মমভাবে নিহত হন সাবিত্রী দেবীর পুত্র রামকৃষ্ণ। মৃত্যুর আগে ছেলের মুখটি দেখতে দেওয়া হয়নি এই যোদ্ধা দেশপ্রেমিক মাকে।

প্রেমলতা দে

বিপ্লবী কালি দে’র স্ত্রী প্রেমলতা দে। পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের জন্য মাষ্টারদা যে দল নির্বাচন করেছিলেন সেখানে প্রেমলতাও ছিলেন। কিন্তু কল্পনা দত্ত পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার পরে ক্লাব আক্রমণ থেকে প্রেমলতাকেও বাদ দেয়া হয়। পরবর্তীতে এই বীরকন্যা আত্মহত্যা করেন।

সুহাসিনী গাঙ্গুলী( ১৯০৭- ১৯৬৫)

জন্মসূত্রে সুহাসিনী চট্টগ্রামের মেয়ে নন, কিন্তু ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের যুববিদ্রোহের বিপ্লবীদের সাথে তিনি গভীরভাবে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। সব বিপ্লবীর কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন পুটুদি নামে।
বীর কন্যাদের মধ্যে আরও ছিলেন কল্যানী দাস, বীণা দাশ, প্রমীলা দাস, অনিমা বিশ্বাস, নির্মলা চক্রবর্তী, অমিতা সেন, আশালতা সরকার, কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তা, চন্দ্রবাসী দেবী, আরতি দত্ত(দাশ), নিবেদিতা চৌধুরী (নাগ), রীণা সেনগুপ্ত, রাজলক্ষ্মী দেবীসহ আরও অনেকে। আশ্রয়দাত্রী হিসেবে অনেক নারী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মধ্যে ফয়জুন্নেসা নামে একজনের জানা যায়। তার বাড়ি ছিল ফতেয়াবাদের বড় দিঘির পাড়ে।
গৈরলা গ্রামের সৌদামিনী সেন, কৃষক আমজাদ আলীর স্ত্রী, কাতালগঞ্জের সুভাষিণী রায়, নয়াপাড়া গ্রামের বনলতা সেন, স্বর্গময়ী দস্তিদার (যার বাড়ির সাংকেতিক নাম ছিল ‘মাসীমার আশ্রয় কেন্দ্র’)।
পুরা বইটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে মুসলিম মেয়েদের অংশগ্রহণ তেমন চোখে পড়লো না। সে-ব্যাপারে লেখকের ব্যাখাটুকু মনে ধরলো। লক্ষণীয় যে, স্বদেশি আন্দোলনের সূচনাকাল থেকেই মুসলিম নারীদের অংশগ্রহণ ছিল তুলনামূলকভাবে কম। তার অন্যতম কারণ প্রায় সকল ক্ষেত্রে আন্দোলনে হিন্দু ধর্মীয় প্রতীক যেমন- ব্রত পালন, অরন্ধন, রাখী বন্ধন ইত্যাদির ব্যবহার। তবে এর পরেও অসহযোগ আন্দোলনের পাশাপাশি খেলাফত আন্দোলনে মুসলিম নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য।’
১৯৩০-১৯৩২ সালের আইন অমান্য আন্দোলনে সত্যাগ্রহীদের সঙ্গে কাজ করেছেন মুসলিম পরিবারের আরও চার নারী। তারা হলেন, শামসুন্নাহার বেগম, রওশন আরা বেগম, রাইসা বসু বেগম এবং বদরুন্নেসা বেগম।
বিপ্লবী কন্যাদের প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধা। এই বইয়ের দারুণ সংযোজন হচ্ছে বীর কন্যাদের ছবি। এত বছর পর এই বীর কন্যাদের ছবি সংগ্রহ করা নিশ্চয়ই বেশ শ্রমসাধ্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারীদের ভূমিকা জানার ক্ষেত্রে ‘ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে চট্টগ্রামের নারী’ বইটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস। ইতিহাসের এই বই ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে থাকবে নিশ্চিত। লেখক, প্রাবন্ধিক আনোয়ারা আলম এর প্রতি ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা যত্নসহকারে গবেষণালব্ধ ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ বইটি আমাদের পাঠের সুযোগ করে দেয়ার জন্য। বইটির প্রকাশনায়ও বেশ যত্নের ছাপ আছে। বইটির প্রকাশক খড়িমাটি প্রকাশন। প্রচ্ছদ করেছেন মোস্তাফিজ কারিগর।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকারাগারের ভিডিও ফাঁস কীভাবে, তদন্তে কমিটি
পরবর্তী নিবন্ধনন্দিত ও নিন্দিত এক নাম