নন্দিত ও নিন্দিত এক নাম

রিতু পারভী | শনিবার , ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ

বিশ্ব রাজনীতিতে তুমুল নন্দিত এবং নিন্দিত একটি নাম অং সান সু চী যিনি বারবার এসেছেন বিশ্ব রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মিয়ানমারের রাজনীতির বরপুত্র অং সান সু চীর সমগ্র জীবন জুড়ে সামরিক জান্তাাদের বিরুদ্ধে, মিয়ানমারের জনগণের অধিকার আদায়ে লড়াইয়ের ইতিহাস। পিতা অং সান, দাদী সু আর মাতা খিন চী’র নাম নিয়ে অনন্য ব্যক্তিত্ব অং সান সু চী জীবনের বেশিরভাগ সময় গৃহে অন্তরীণ অবস্থায় কাটিয়েছেন, লড়েছেন মানবাধিকারের জন্য।
দু’বছর বয়সে সু চী তাঁর পিতা, আধুনিক বার্মার জনক অং সানকে হারান। ব্রিটিশ শাসকের হাত থেকে বার্মাকে মুক্ত করার নায়ক, তাঁর পিতা অং সান ছিলেন ডি ফ্যাক্টো বা স্বাধীন বার্মার অনানুষ্ঠানিক প্রধান। আততায়ীর হাতে পিতার মৃত্যুর পর মাতা খিন চী মিয়ানমারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। তিনি ভারতীয় মিশনের এ্যাম্বাসেডরের দায়িত্ব নিয়ে নয়াদিল্লীতে বসবাস শুরু করলে সু চী সেখানে এক কনভেন্টে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৪৫ সালের ১৯ জুন ব্রিটিশ বার্মার রেঙ্গুনে জন্মগ্রহণকারী সু চী’র কৈশোর আর যৌবনের প্রথম অংশ কাটে ভারতের দিল্লীতে।
দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৯৬৪ সালে রাজনীতি বিষয়ে স্নাতক সম্পূর্ণ করেন। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাজনীতি, দর্শন আর অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। অক্সফোর্ডে পড়াকালীন সময়েই তাঁর সাথে পরিচয় হয় মাইকেল হ্যারিসের সাথে এবং পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে তাঁরা আবদ্ধ হন বিবাহবন্ধনে।
জীবনের অনেকখানি সময় দেশের বাইরে কাটালেও সু চী মিয়ানমারে ফিরে আসেন ১৯৮৭ সালে অসুস্থ মা’কে দেখতে। দেশে ফিরেই তিনি জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। সামরিক জান্তাদের অমানবিক অত্যাচারে অস্থির দেশের অবস্থা দেখে সু চী নিজেও অস্থির হয়ে পড়েন এবং এর তীব্র প্রতিবাদ করেন।
৮৮ সালের গণআন্দোলনের সময় সু চী চলে আসেন রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। পিতা, স্বাধীন মিয়ানমারের জনক, অং সান এর কারণে জনগণের অফুরান ভালবাসাও অর্জন করেন সু চী এবং তাঁকে বানানো হয় ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির সাধারণ সম্পাদক। নির্বাচনে ৮১% ভোট পেয়ে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি জিতে গেলেও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে সামরিক শাসক অস্বীকৃতি জানালে বিশ্বজুড়ে এর তীব্র নিন্দা জানানো হয়। ইতমধ্যে গৃহে অন্তরীণ হন নেত্রী সু চী।
গৃহে অন্তরীণ হওয়া সু চী’র জীবনের এক করুণ ইতিহাস। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময় তাঁকে অন্তরীণ অবস্থায় কাটাতে হয়। স্বামী মাইকেল হ্যারিস ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু শয্যায় থাকলেও সু চী দেশ ত্যাগ করে তাঁর কাছে যেতে পারেননি কারণ এতে আশংকা ছিল তাঁকে আর প্রবেশ করতে দেয়া হবে না দেশে। আবার মাইকেল হ্যারিসকেও অনুমতি দেয়া হয়নি মিয়ানমার প্রবেশের। রাজনীতির কারণে করুণ বিচ্ছেদ হয় এই দম্পতির। সু চী তাঁর দুই পুত্রের সাথেও বাস করতে পারেননি রাজনীতির কারণে। দীর্ঘ সময় গৃহে অন্তরীণ থাকার কারণে সু চী অসুস্থ হয়ে পড়েন বারবার। নিম্ন রক্তচাপ, স্বল্প ওজনের সু চী রাজনীতির কারণে সহ্য করেন বিবিধ যন্ত্রণা।
২০১৫ সালের জাতীয় নির্বাচনে সু চী’র দল ৮৬% আসন পেয়ে সংসদের নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করলে সরকার গঠনের অনুমতি পান। মিয়ানমারের রাজনীতিতে সুবাতাস বওয়া শুরু করলেও অতি সম্প্রতি সামরিক অভ্যুত্থান সে যাত্রাকে দারুণভাবে ব্যহত করেন।
২০২০ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন ঘিরেই শুরু হয় অসেন্েতষ। সেই অসন্তোষকে কেন্দ্র করেই সামরিক জান্তারা আবার আসীন হয় চালকের ভূমিকায়, ১ ফেব্রুয়াারি ২০২১ এ পুনরায় অন্তরীণ করা হয় সু চী’কে। বিশ্ব রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আবার একবার উঠে আসে অং সান সু চী এবং তাঁর দেশ মিয়ানমার।
রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, মানবাধিকার কর্মী ও লেখক অং সান সু চী সারা বিশ্বে ভীষণভাবে নিন্দিত ও সমালোচিত হন রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাঁর অবস্থানের জন্য। ২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সু চী’র মৌনতা মানবাধিকার কর্মীদের বিস্মিত করে। কঠোর সমালোচনা হয় বিশ্বজুড়ে। এ সময়ের এক সাক্ষাতকারে তিনি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের জনগণ কি না তা তিনি জানেন না বলে জানান। একই ঘটনা ঘটে ২০১৫ তে রোহিঙ্গা শরণার্থী ইস্যুতে। তাঁর নীরবতা শান্তিতে তাঁর নোবেল পুরস্কার অর্জনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। রাখাইনের দাঙ্গা, নির্যাতনের ঘটনা তিনি অস্বীকার করলে সারা বিশ্বে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় উঠে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার, শাখারভ পুরস্কার সহ মানবতার জন্য অনেক পুরস্কার অর্জনকারী অং সান সু চী’র সকল অর্জনকে ম্লান করে দেয় রোহিঙ্গা প্রশ্নে তাঁর ভূমিকায়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅগ্নিযুগের অগ্নিকন্যারা আমাদের
পরবর্তী নিবন্ধবাহারছড়ায় অগ্নিকাণ্ডে ৭ বাড়ি ভস্মীভূত