অগ্নিঝুঁকিতে নগরের পাঁচ ওয়ার্ড

অগ্নিকান্ডের ৪৭ শতাংশ আবাসিক এলাকায়, ২৭ শতাংশ বাণিজ্যিকে ।। বহুতল ভবনগুলোর প্রায় ৯৭ শতাংশ ঝুঁকিতে ।। বেশিরভাগ ভবনে মানা হচ্ছে না বিল্ডি কোড ।। সরু রাস্তায় বাড়ছে ঝুঁকি

মোরশেদ তালুকদার | বৃহস্পতিবার , ৮ জুন, ২০২৩ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

নগরের পাঁচটি ওয়ার্ড অগ্নিকাণ্ডের অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া শহরের আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত বহুতল ভবনগুলোর প্রায় ৯৭ শতাংশ আগুনের ঝুঁকিতে আছে। এসব ভবনের মধ্যে ৯৩ শতাংশের অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত ছাড়পত্র নেই। এছাড়া বেশিরভাগ ভবন বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুসরণ না করায় বাড়ছে ঝুঁকির কারণ। পাশাপাশি শহরের যেসব এলাকার রাস্তা সরু সেখানে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ সরু রাস্তার ফলে অগ্নিনির্বাপণে আসা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সেখানে পৌঁছুতে সমস্যা হয়।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রণীত ‘মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ফর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ বা চট্টগ্রাম শহরের আপদকালীন কর্মপরিকল্পনায় এসব তথ্য উঠে আসে। এতে অগ্নিকাণ্ড ঝুঁকির কারণ, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি, অগ্নিকাণ্ডের আপদ মোকাবিলায় সক্ষমতা এবং অগ্নিকাণ্ড ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়।

অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে ২ নং জালালাবাদ, ৪ নং চান্দগাঁও, ১৬ নং চকবাজার, ৩২ নং আন্দরকিল্লা এবং ৩৬ নং গোসাইলডাঙ্গা। ফায়ার সার্ভিস আওতাধীন এলাকায় অগ্নিকাণ্ড ঘটার সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া যেসব জায়গার আগুনের ঝুঁকি আছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সরু রাস্তা, বিপত্তি বিধির অভাব এবং অপরিকল্পিত বস্তি, যথাযথ অগ্নি নির্বাপক উপকরণ এবং জরুরি প্রস্থান ছাড়া ভবন।

কর্মপরিকল্পনার তথ্য অনুযায়ী, নগরের সিইপিজেড এলাকা, উত্তর কাট্টলী এলাকা, ভেড়া মার্কেট বস্তির পাশে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ছাড়া বায়েজিদ, কালুরঘাট ও বন্দর এলাকায় ফায়ার সার্ভিস আওতাধীন এলাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সাম্প্রতিক সময়ে ঘটেছে। কর্মপরিকল্পনায় ২ হাজার ৫৪১টি অগ্নিকাণ্ডের বিশ্লেষণ করে দেখানো হয় অগ্নি দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ ৪৭ শতাংশই ঘটেছে আবাসিক এলাকায়। এছাড়া ২৭ শতাংশ বাণিজ্যিক এলাকায় ঘটেছে।

কর্মপরিকল্পনায় সতর্ক করে বলা হয়, নগরে অগ্নিঝুঁকির সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রধান কারণগুলো হলো বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট স্পার্কিং, গ্যাস সিলিন্ডার লিকেজ ইত্যাদি। আগুনের উৎপত্তি প্রাকৃতিক বা মানবিক যে কোনো মাধ্যমেই হতে পারে। ফলে খুব অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্যু এবং সম্পত্তির ক্ষতি হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে আগুনের তীব্রতাও পরিবর্তিত হয়। এছাড়া ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বায়েজিদ ফায়ার স্টেশনের আওতাধীন এলাকায়। ২০১৬ সালে সিইপিজেড স্টেশন এলাকায় দ্বিতীয় সর্বাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালে চন্দনপুরা ফায়ার স্টেশন বায়েজিদ স্টেশনের পরে দ্বিতীয় সর্বাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটে। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালে ৮৩ জন আহত এবং ১৫ জন মারা যান বলে উল্লেখ করা হয়।

মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ফর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের তথ্য অনুযায়ী, সিইপিজেডের ভবন এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং অনেক আবাসিক ভবনে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আগুনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া হাসপাতালেই পুরোপুরি অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। এছাড়া অধিকাংশ বিদ্যালয়ে অগ্নি নিরাপত্তার কোনো পরিমাপক যন্ত্র নেই। শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ ও মক ড্রিলের ব্যবস্থা নিয়মিত দেওয়া হয় না।

কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়, বেশিরভাগ বিল্ডিং অগ্নিকাণ্ড নিরাপত্তার জন্য বিএনবিসি নিয়ম পুরোপরি অনুসরণ করছে না। মানুষের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞানের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে বঞ্চিত বসতি যেমন বস্তি এলাকায় এই বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞানের বেশি অভাব। কিছু ওয়ার্ড অপরিকল্পিত সংকীর্ণ সড়ক ব্যবস্থা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিস ট্রাকের প্রবেশপথে বাধা সৃষ্টি করে, অগ্নিকাণ্ডের সময় বা অন্য জরুরি অবস্থার সময় ফায়ার সার্ভিসের যানবাহন এবং অ্যাম্বুলেন্সের চলাচলও পরিচালনায় দেরি হয়।

এতে বলা হয়, এছাড়া শহরের যেসব এলাকার রাস্তা সরু অর্থাৎ সরু রাস্তার কারণে ফায়ার সার্ভিসের ট্রাক যেতে পারে না সেগুলো অতি দ্রুত বড় না করলে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তথা ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বাড়বে। স্থানীয় লোকজন প্রশিক্ষিত না হওয়ায় আগুন লাগলে স্বাভাবিকভাবে আগুন নেভাতে পারবে না। ফলে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তথা ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি অনেকাংশেই বাড়বে। কাছাকাছি জলাশয় পাওয়া না গেলে অবিরাম জল সরবরাহ করা সম্ভব হবে না। তাই মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী সিটি এলাকায় জলাধার সংরক্ষণে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে কঠোর অবস্থানে যেতে হবে। বস্তি এলাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, তাই বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের এই বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও ট্রেনিং অতি দ্রুত দেয়া উচিত। নতুবা বস্তি এলাকাগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তথা ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বাড়তেই থাকবে।

কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুক। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভ দ্যা সিলড্রেন ও ইপসা কর্মপরিকল্পনাটি প্রণয়নে সহযোগিতা করে।

অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুক অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি হ্রাসে পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, ত্রুটিপূর্ণ ও অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ পর্যবেক্ষণ, মেরামত ও পরিবর্তন করতে হবে। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিষয়ক জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও অনুশীলনমূলক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। ভবনের স্থায়ী অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, ফায়ার লিফট, ফায়ার কমান্ড স্টেশন স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বহুতল ভবন যদি ছয়তলার উপরে হয়, তাহলে সামনে ৩০ ফুট প্রশস্ত জায়গা থাকতে হবে। সিঁড়ি হতে হবে কমপক্ষে ছয় ফুট প্রশস্ত। প্রতি ৫৫০ বর্গফুটের মধ্যে একটি করে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে নামছে পর্যটক বাস
পরবর্তী নিবন্ধযাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার