দ্বিতীয়বারের মতো নগরীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পরিবর্তে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল প্রাঙ্গণে নির্মিত অস্থায়ী শহীদ মিনারে আগামী ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের শ্রদ্ধা জানানো হবে। একইসঙ্গে নবনির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারকে কীভাবে দৃশ্যমান করা যায় এবং সহজে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো যায় তা নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করা হবে।
নবনির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ও আসন্ন বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল সকালে মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙের নিচতলায় অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গ, সাংবাদিক ও বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার প্রতিনিধিরা তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। সভায় নবনির্মিত শহীদ মিনার দৃশ্যমান নয় দাবি করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সংস্কৃতিকর্মীরা। একইসঙ্গে দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত আসন্ন বিজয় দিবসসহ অন্যান্য জাতীয় দিবসে এ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আপত্তি জানান। শহীদ মিনার দৃশ্যমান না হওয়ার জন্য নবনির্মিত মুসলিম ইনস্টিটিউট ও গণগ্রন্থাগার ভবনের সঙ্গে শহীদ মিনারকে যুক্ত করা ২১ ফুট উঁচু প্লাজাকে দায়ী করা হয়। এ প্লাজার কারণে নিচের সড়ক থেকে প্লাজার উপরে থাকা শহীদ মিনার দৃশ্যমান নয় বলে দাবি করা হয়। সেটা ভেঙে ফেলারও দাবি ওঠে।
পরে সভার সিদ্ধান্ত তুলে ধরে মেয়র বলেন, আপনারা মতামত দিয়েছেন যে, শহীদ মিনারটা দৃশ্যমান না করা পর্যন্ত ১৬ ডিসেম্বর এখানে পালন না করার জন্য। আপনাদের সঙ্গে আমিও একমত। ১৬ ডিসেম্বর আমরা মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলে অস্থায়ী শহীদ মিনারে করব এবারও।
কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি বলেন, সবার আলোচনায় দুটি বিষয় এসেছে। শহীদ মিনারকে দৃশ্যমান করা এবং দৃশ্যমান না হওয়া পর্যন্ত বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলো এখানে না করা। আমি বক্তব্যের সঙ্গে একমত। শহীদ মিনারটি যেভাবে নির্মাণ হয়েছে, এটা মানুষকে খুঁজে নিয়ে দেখতে হবে। না হলে কেউ জানতেও পারবে না চট্টগ্রামে একটি শহীদ মিনার আছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার আগে যদি সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে একটু কথা বলত, তাহলে এ সমস্যা হতো না। অথচ শহীদ মিনারের জায়গাটিও সিটি কর্পোরেশনের।
তিনি বলেন, এখন আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে, শহীদ বেদি উঁচু হতে হবে এবং এটা চারপাশ থেকে দৃশ্যমান হতে হবে। এজন্য কী করতে হবে সেই প্রস্তাবনা তৈরির জন্য একটি কমিটি করা হবে। কমিটিতে আমাদের বুদ্ধিজীবীরা থাকবেন, সব শ্রেণি–পেশার লোক থাকবেন। কথা বলতে গেলে বছরের পর বছর চলে যাবে। দ্রুত আমরা কমিটি গঠন করে কাজ শুরু করব।
মেয়র সাংবাদিকদের বলেন, এক বছরের মধ্যে শহীদ মিনার সংস্কার হওয়ার কথা ছিল এবং আমরা মনে করেছিলাম এবার ১৬ ডিসেম্বর এখানে পালন করব। কিন্তু এখানে অনেক অসঙ্গতি রয়ে গেছে। অপ্রশস্ত সিঁড়ি এবং অপ্রতুল জায়গার জন্য এখানে ফুল দিতে এসে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
তিনি বলেন, নবনির্মিত শহীদ মিনারের যিনি আর্কিটেক্ট উনাকেও ডাকব। এটা করার পেছনে নিশ্চয় উনার একটা ভাবনা আছে। একইসঙ্গে চট্টগ্রামের আরো বিশিষ্ট আর্কিটেক্টবৃন্দ আছেন তাদেরও ডাকব। উনাদের নিয়ে বসে কীভাবে এটাকে দৃশ্যমান করা যায় সেটা দেখা হবে। কারণ সবার দাবি একটাই, শহীদ মিনার দৃশ্যমান হতে হবে। এখন তো এটা দ্বিতীয়তলা হয়ে গেছে। দেখা যায় না, শহীদ মিনার কোথায় খুঁজে বের করতে হবে।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে কোনো স্মৃতিসৌধ নেই। তাই জাতীয় দিবসগুলো চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পালন করা হয়। সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পালন করা হয় বিজয় দিবসের কর্মসূচি। এরপর ২৭ ডিসেম্বর পুরনো কাঠামো ভাঙার কাজ শুরু হয়। একইসঙ্গে মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুল প্রাঙ্গণে অস্থায়ী শহীদ মিনার করে চসিক।
জানা গেছে, ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙ প্রকল্পের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ২০৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রকল্পের অগ্রগতি হয়েছে ৮৭ শতাংশ। আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এ প্রকল্পের আওতায় পুরনো শহীদ মিনারের আদল ঠিক রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন শহীদ মিনার ও উন্মুক্ত গ্যালারি। এছাড়া পুরনো পাবলিক লাইব্রেরি ভেঙে ১৫ তলা গণগ্রন্থাগার ভবন ও পুরনো মুসলিম হল ভেঙে নির্মাণ করা হয়েছে ৮ তলা ভবন।
২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধনের দিন চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙ প্রকল্পেরও উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামী ১৬ ডিসেম্বর নবনির্মিত শহীদ মিনারে বিজয় দিবস উদযাপন করা নিয়ে ১৮ নভেম্বর মতবিনিময় করেন মেয়র। এতে সংস্কৃতিকর্মীরা নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ছাড়া এ শহীদ মিনারে ফুল দিতে আপত্তি জানান। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল মতবিনিময় হলো।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেন, এই শহীদ মিনারের নকশা যিনি করেছেন উনাকে ডাকুন, আরও কয়েকজন স্থপতিকে ডাকুন। যেভাবে শহীদ মিনার করা হয়েছে, এখানে ওঠানামা বিপজ্জনক। ওঠানামার পথটা আরও প্রশস্ত করে কীভাবে করা যায় সেটা ভাবতে হবে। সামনের টানেলটা সরিয়ে এটাকে দৃশ্যমান করতে হবে। সাথে সবুজ বজায় থাকতে হবে। মেয়র সাহেব স্থপতিদের সঙ্গে বসে এটা ঠিক করুন। আমাদের অনুভূতির সঙ্গে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সাথে শহীদ মিনার জড়িত। কয়েকজন প্রকৌশলীকে নিয়ে এবং এখানকার কয়েকজনকে নিয়ে একটা কমিটি করা যেতে পারে। শহীদ মিনারকে উন্মুক্ত জায়গায় নিতে হবে। স্থপতি ও প্রকৌশলীরা বসলে ঠিক করা যাবে।
সভায় একুশে পদকপ্রাপ্ত কবি ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, আমাদের সমাধানের দিকে যেতে হবে। এখানে তিনটি স্থাপনা যুক্ত হয়েছে–শহীদ মিনার, পাবলিক লাইব্রেরি ও মুসলিম হল। তিনটি স্থাপনার মধ্যে শহীদ মিনারের আবেগ ও ইমপেক্ট ভিন্ন। সেটা এখানে হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হওয়ার কথা ছিল শহীদ মিনার। কিন্তু সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বহীন হয়ে গেছে। একটা কর্পোরেট শহীদ মিনার বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা গণমানুষের শহীদ মিনার চাই। এটা যে ইতিহাস ও জাতিকে ধারণ করে তা দেখতে হবে। সামনের স্থাপনা ভেঙে ফেললে আমার মনে হয় একটা সমাধান হয়ে যেতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ডা. মাহফুজুর রহমান বলেন, শহীদ মিনার এবং সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙ এ দুটোকে আলাদা করে ফেলা হোক। মেয়রের নেতৃত্বে একটি কমিটি হোক। কমিটি যাচাই বাছাই করে প্রয়োজনীয় প্রস্তাব করবে। প্লাজাটা ভেঙে দিলে ঠিক হবে। এখান থেকে প্রস্তাব গেলে প্রধানমন্ত্রী আপত্তি করবেন না। মুসলিম হল ও পাবলিক লাইব্রেরি আর শহীদ মিনার দুটো দুই পাশে থাক।
প্রকল্প পরিচালক লুৎফুর রহমান বলেন, এখানে ব্যক্তিগত মত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আপনারা লিখিত প্রস্তাব দিলে সেটা অনুমোদনের পর বাস্তবায়নের কাজ আমরা করব। ভাঙার সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে। যে কোনো পরিবর্তনের সিদ্ধান্তও সরকারিভাবে নিতে হবে। আমরা কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারি না।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বদরুল আলম খান বলেন, একটি কাঠামো হয়েছে, সেটি চাইলেই ভেঙে ফেলা সহজ। কিন্তু ভবিষ্যৎ ভাবতে হবে। এখানে ১৫ তলা স্ট্রাকচার হয়েছে। পরে যা–ই করি তখনও পাবলিক লাইব্রেরির ভবনের তুলনায় শহীদ মিনার বামন আকৃতির মনে হতে পারে। তখন কি আবার ১৫ তলা ভবন ভাঙার কথা বলা হবে? প্লাজার দুই অংশ আলাদা করতে পারব কিনা, এটা আমরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে স্থপতিরা নিলে ভালো হয়।
কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার বলেন, শহীদ মিনারে ইট–পাথরের অবগুণ্ঠন আমরা মেনে নেব না। আবৃত্তিশিল্পী অঞ্চল চৌধুরী বলেন, শহীদ মিনারের সামনে সুড়ঙ্গ বানানোর কী প্রয়োজন ছিল, আমরা জানি না। এখন শহীদ মিনারটা ফ্ল্যাটবাড়ির মতো হয়ে গেছে।
সভার সঞ্চালক নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দার বলেন, ওঠানামার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা এড়াতে বিদ্যমান অবকাঠামো ঠিক রেখে পশ্চিম পাশে শহীদ মিনারের সঙ্গে লাগোয়া একটি ১২ ফুট প্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করা যায়। তিনি বলেন, আপাতত সামনের সুড়ঙ্গ পথটা (প্লাজা) সরিয়ে ফেলার প্রস্তাব আমরা করতে পারি। এটা করলে শহীদ মিনারের সামনে ফাঁকা জায়গা থাকবে। ওঠানামার প্রশস্ত পথও পাওয়া যাবে। স্থপতিদের একটা প্যানেল করে এ বিষয়ে উনাদের মতামত নেয়া হোক।
নগর যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ বলেন, শহীদ মিনারে ঢোকার পথ কমপক্ষে ৩০ ফুট প্রশস্ত হতে হবে। আগে যে শহীদ মিনার ছিল, সেখানে প্রবেশের পথটা অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ ফুট ছিল।
কবি কামরুল হাসান বাদল বলেন, শহীদ মিনার নিয়ে যে সমস্যা তৈরি করা হয়েছে, রাস্তা নির্মাণ করে এর সমাধান হবে না। পুরো স্থাপনা ভেঙে ফেলতে হবে। সামনে টানেলের মতো যে প্লাজা করা হয়েছে সেটা ভেঙে ফেলা হোক। শহীদ মিনার আগে যেমন ছিল তেমন হতে হবে। দৃশ্যমান করতে হবে। রাস্তা থেকেই যাতে আগের মতো শহীদ মিনার দেখা যায়।
প্রায় একই কথা বলেন উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক শীলা দাশগুপ্তা। তিনি বলেন, এখন যেভাবে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে এর দুই পাশে রাস্তা নির্মাণ করলেও এটা দৃশ্যমান হবে না। শহীদ মিনার যদি দৃশ্যমান করা না হয়, তাহলে আমরা এখানে ১৬ ডিসেম্বর অর্থাৎ বিজয় দিবস পালন করব না। আগে এটা ভেঙে দৃশ্যমান করা হোক, তারপর এখানে জাতীয় দিবসগুলো পালন হোক।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফাহিম উদ্দিন, সাংস্কৃতিক সংগঠক দেওয়ান মাকসুদ আহমেদ, চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি মহিউদ্দীন শাহ আলম নিপু, উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সভাপতি ডা. চন্দন দাশ, সহসভাপতি সুনীল ধর, নাট্যকর্মী শেখ শওকত ইকবাল, সুচরিত দাশ খোকন, সিপিবি চট্টগ্রাম জেলার সহ–সাধারণ সম্পাদক নুরুচ্ছাফা ভূঁইয়া, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এম আর আজিম, কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী ও আতাউল্লা চৌধুরী, নৃত্যশিল্পী প্রমা অবন্তী ও অনন্য বড়ুয়া, প্রমা আবৃত্তি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ পাল, ছড়াকার সংসদের সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম মোদাচ্ছের আলী, শিল্পী দীপেন চৌধুরী, আবৃত্তিশিল্পী মিলি চৌধুরী, কণ্ঠনীড় আবৃত্তি সংগঠনের সভাপতি সেলিম রেজা সাগর, সঙ্গীতশিল্পী শিলা দাশ, নৃত্যশিল্পী শারমিন হোসেন, চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আলী প্রয়াস ও প্রকল্প পরিচালক লুতফুর রহমান খান।