পাকিস্তানী অত্যাচারী শাসকরা পাকিস্তান ভেঙে পূর্বপাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ হোক এটি তারা কোন সময় চায়নি এমনকি কল্পনাও করতে পারেনি। তাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সুদীর্ঘ নয়মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ভারত ও রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো তখন স্বাভাবিকভাবে তাদের মধ্যে স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুর উপর তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হলো। পাকিস্তানীরা বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছিল, পারেনি। আবার সুদীর্ঘ নয়মাস সংগ্রামকালে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলাতে চেয়েছিল, কবরও খোঁড়া হয়েছিল, তারপরও কুটনৈতিক চাপে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসিতে ঝুলাতে পারেনি। স্বাভাবিকভাবে তাদের ক্ষোভ আরো তীব্রতর হয়। তাই আর কোন পথ খুঁজে না পেয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা তারা গ্রহণ করে এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা সফল হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তারিখে।
মুক্তিযুদ্ধের শেষপ্রান্তে এসে পাকিস্তানের বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের উপর এবং মিত্রবাহিনীর উপর আঘাত হানার জন্য বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠায়। যেহেতু ভারত রাশিয়ার সঙ্গে বেশ কয়েকমাস আগে চুক্তিতে আবদ্ধ ছিল সেহেতু রাশিয়াও সপ্তম নৌবহরের অগ্রযাত্রাকে থামাবার জন্য রাশিয়ান নৌবহর পাঠায়। অপর দিকে রাশিয়া জাতিসংঘে বাংলাদেশের পক্ষে ভেটো প্রয়োগ করে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সপ্তম নৌবহরকে ফেরৎ নিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধু হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতারাও অসম্ভব ক্ষুব্ধ হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর অতঃপর শুরু হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার যৌথ পরিকল্পনা।
পাকিস্তানী আইএসআই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ যৌথভাবে তৎপরতা শুরু করলো। কোন দেশের নেতাকে হত্যা করতে হলে সেই দেশের মধ্যে খুনী খুঁজতে হবে। এ যাবৎকালে সব দেশেই খুনীদের খুঁজে বের করেছে এই সব সংগঠনগুলো।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে আমরা জানি আওয়ামী লীগ নেতা প্রবাসী মুজিব সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ছিলেন খোন্দকার মোস্তাক আহমেদ। মুক্তিযুদ্ধকালীন এক পর্যায়ে এসে পাকিস্তানের সঙ্গে ঢিলেঢালা কনফেডারেশন করার প্রস্তাব দিয়েছিলো পাকিস্তানী নেতাদের পরামর্শে। তাঁর পরামর্শ গৃহীত হয়নি। এজন্যি তিনি ছিলেন ক্ষুব্ধ, ক্রোধান্বিত ও ক্ষোভ জর্জরিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। খোন্দকার মোস্তাক বসে নেই। সিআইএর তৎপরতা দেখে নিজেই সিআইএর কাছে আত্মসমর্পণ করলো। সাবাস কেল্লাফতে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের শুরু থেকেই প্রতিনিয়ত বিরোধীতা করেছে। সাম্রাজ্যবাদের দোসর হিসেবে আরো সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল ইরান, পশ্চিম জার্মানী, চীন, সৌদি আরব, লিবিয়া, সুদানসহ বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র। সিআইএ এর সঙ্গে মোস্তাকের যোগাযোগ হয় হেনরি কিসিঞ্জারের ডান হস্ত স্যান্ডার্স এর মাধ্যমে প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে।
খোন্দকার মোশতাকের ১৯৭১ সালে অক্টোবর মাসে জাতিসংঘে যাবার ছলে বিপ্লবী সরকারের বিরুদ্ধে পাল্টা সরকার গঠনের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে পড়লে ভারত সরকার তাঁকে নজরবন্দী করে রাখে এবং এই প্রেক্ষাপটে পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলী চাষীকে তাজউদ্দিন সরকার তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করে। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যা পর্যন্ত চক্রান্তে মোস্তাক গং সক্রিয়ভাবে জড়িত হয়ে পড়ে এবং সেই মাহবুব আলম চাষীর সঙ্গে বহু বাঘা বাঘা সাংবাদিক ও ব্যক্তিবর্গ এই চক্রান্তে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিল বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়।
দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধু দায়িত্বভার গ্রহণের কিছুদিন পর হঠাৎ করে কিছু রাজনীতিবিদ দেশে বিভিন্নভাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টিতে সক্ষম হন। ভারত বিদ্বেষী মনোভাব চাঙ্গা করা, মৌলানা ভাসানীর নূতন পতাকা ওড়ানোর স্বপ্ন, পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির উত্থান, হক-কথা নামক পত্রিকার আত্মপ্রকাশ, মুসলিম বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য মৌলানা ভাসানীর নিকট জুলফিকার আলী ভুট্টোর পত্র প্রেরণ, পরাজিত মৌলবাদী দেশদ্রোহী জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, পিডিপি সহ নৈপথ্য মৌলবাদ ধর্মান্ধ অপশক্তির উত্থান, হুকুমতে রব্বানী প্রতিষ্ঠা, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এক শ্রেণির বর্ণচোরা বুদ্ধিজীবীদের উস্কানি, বাংলাদেশকে ভিয়েতনাম বানানোর হুমকী, ছাত্রলীগের দ্বিধাবিভক্তি, নূরে আলম সিদ্দিকীর গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হুংকার, আ.স.ম আবদুর রবের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভয়ংকর কর্মসূচি উত্থাপণ এবং ছাত্রলীগের ভাঙনের ফলে শ্রমিক, কৃষক, মুক্তিযোদ্ধা ফ্রন্টে ব্যাপক ভাঙন ইত্যাদিতে সমগ্র দেশ অস্থিরতার অমানিশায় নিমজ্জিত হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে মানসিকভাবে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনে কাজ করবেন নাকি এই অস্থিরতার মোকাবেলা করবেন। সবকিছুই ঘটে চলেছিল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মদদে। দেশ খাদ্য সংকটে নিমজ্জিত হং এবং আমেরিকার পাঠানো চখ-৪৮০ জাহাজ সহায়তা না দিয়ে ফেরৎ চলে যায়। ১৯৭৪ সালে স্মরণাতীত কালের ব্যাপক বন্যায় ফসলহানি, দেশে জরুরি অবস্থা জারী, জাসদের সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাকশাল গঠন ইত্যাদি সেই সংকটময় অবস্থার সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। বামপন্থী, কট্টর বামপন্থী দলগুলোর গেরিলা যুদ্ধেল প্রস্তুতির মাধ্যমে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যা, ডাকাতি, রাহাজানি করে ত্রাসের পরিস্থিতি সৃষ্টি বাংলাদেশ নামক সদ্য শিশু রাষ্ট্রকে ধূলায় মিশিয়ে দেয়ার বিদেশি এজেন্ডা বাস্তবায়নে মীরজাফর দলেরা তাদের যথাসাধ্য চেষ্টার উন্মত্ত প্রয়োগ করা ইত্যাদিতে দেশটি চরম অরাজকর পরিস্থিতিতে নিমজ্জিত হয়। নাশকতামূলক এই সব কাজে বাংলাদেশ বিরোধী শক্তি যার যার অবস্থান থেকে দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসার জন্য তাদের হীনপ্রচেষ্টা অব্যাহত গতিতে চালাতে থাকে। আওয়ামী লীগের মধ্যেও উপদলীয় কোন্দল বেড়ে যেতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধু অসুস্থ থাকালীন সময়ে সূর্যসেন হলের ৭ (সাত) নেতার হত্যাকাণ্ড দেশের মধ্যে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তির উপর এতে আঘাত আসে। এরই মধ্যে গুপ্তচর বৃত্তির আনাগোনার মধ্য দিয়ে শত্রুদের হাত শক্তিশালী হতে থাকে। শুরু হলো ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগারের পালা। বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে ইতিহাসের জঘন্যতম মিথ্যাচার শুরু হলো। দুর্ভিক্ষাবস্থার সৃষ্টিও করলো। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর মহত্তম উদারতার সুযোগ সন্ধানী ব্যক্তিরা আনুগত্য প্রকাশ করাতো দূরের কথা, উল্টো তারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে অনেকের নাম উল্লেখ করা যায় যাদেরকে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের বহু সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। বাংলাদেশ বিরোধী বহু শক্তিধর ব্যক্তিকে ক্ষমা করে রাষ্ট্রের উচ্চ পদে বসিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজের সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন এটা স্বীকার করতে হয়। সব মিলিয়ে বঙ্গবন্ধু যাদেরকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছিলেন তারা বঙ্গবন্ধুর দুর্দিনে একেবারেরই এগিয়ে আসেনি।
শুরু হলো ষড়যন্ত্র। প্রথমে ভুট্টো সাহেব আসেন পাকিস্তান থেকে। পরে আসেন হেনরি কিসিঞ্জার। বাংলাদেশের অভ্যুদয় বা স্বাধীনতা ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের জন্য বিড়ম্বনা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কিসিঞ্জার নিজের পরাজয় বলে ধরে নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা শুরু করে। কিসিঞ্জার ১৯৭৪ সালের ৩০ অক্টোবর ১৯ মিনিটের জন্য ঢাকায় আগমন করেন। এর আগে ১৯৭৪ সালের ২৪ জুন ঢাকায় ভুট্টোর আগমন এবং করাচীতে এক সাক্ষাৎকারে ভুট্টোর দম্ভোক্তি “বাংলাদেশে অচিরেই পরিবর্তন ঘটবে”। কাবুলে চীনা নেতাদের সাক্ষাতের পর ভূট্টো কাবুলের মিলিটারী একাডেমীতে এক ভাষণে বলেছিলেন, “ঝড়ড়হ ংড়সব পযধহমবং ধৎব মড়রহবং ঃড় নব ঃধশবহ ঢ়ষধপব রহ ঃযরং ৎবমরড়হ”. ৪ আগস্ট ১৯৭৪ এর বৃটিশ হাইকমিশনারের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের সাক্ষাৎ, মোশতাকের ইয়ান ও আফগানিস্তান সফর, ইরান-আফগান হয়ে জেদ্দা যাওয়া, ইরান ও কাবুলে চীনা নেতাদের সাক্ষাৎ, জেদ্দায় পাকিস্তানী দলের বৈঠক ইত্যাদি একই সূত্রে গাঁথা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, যেসব ব্যক্তি স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্নভাবে যথা পুলিশ প্রশাসন, সাধারণ প্রশাসন বা বিভিন্ন স্তরে থেকে বিরোধিতা করেছিল তাদেরকে বঙ্গবন্ধু প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বে বসিয়েছিলেন। এ রকম বহু ব্যক্তির নাম গবেষণার মাধ্যমে বের করা সম্ভব। সেই সব ব্যক্তিদের সি.আই.এ তালিকাভুক্ত করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরিবেশ তৈরীতে কাজে লাগিয়েছিল। অথচ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্বার্থে দক্ষ ব্যক্তি হিসেবে তাদেরকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। (চলবে)
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, চ.বি পদার্থবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান