তেত্রিশ বছর পর অনুষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ জাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু ভিপি এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের মাজহারুল ইসলাম জিএস পদে নির্বাচিত হয়েছেন। ভোট গ্রহণের প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হল থেকে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মো. মনিরুজ্জামান। ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী আব্দুর রশিদ জিতু ৩৩৩৪ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামী ছাত্রশিবিরের আরিফুল্লাহ আদিব ২৩৮৯ ভোট পেয়েছেন।
অপরদিকে সাধারণ সম্পাদক পদে মাজহারুল ইসলাম ৩৯৩০ ভোট পেয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বাগছাসের প্রার্থী আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম পেয়েছেন ১২৩৮ ভোট। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের (এজিএস) দুটি পদেই ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রার্থী ফেরদৌস আল হাসান ২৩৫৮ ভোট এবং আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা ৩৪০২ জয় পেয়েছেন। ২৫টি সম্পাদকীয় পদের মধ্যে ২০টিতেই জিতে নিয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল। এর মধ্য দিয়ে ডাকসুর পর আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের নিয়ন্ত্রণ নিল ইসলামী ছাত্রশিবির, যারা এর আগে কখনো জাকসুতে কোনো পদ পায়নি। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
ডাকসু নির্বাচনের দুদিনের মাথায় ঢাকার অদূরে সাভারের এই ক্যাম্পাসের ভোটগ্রহণ নিয়ে সারা দেশের মানুষের আগ্রহ ছিল। ফলাফল ঘোষণার আগে মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই–আগস্টের আন্দোলনে শহীদ এবং সহকারী অধ্যাপক জান্নাতুল ফেরদৌসের আত্মার মাগফেরাত কামনায় এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। জাকসুর ফলাফল ঘোষণার আগে ২১টি হল সংসদের ফলাফল ঘোষণা করেন সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তা।
প্রায় ১২ হাজার শিক্ষার্থীর এই ক্যাম্পাসে বৃহস্পতিবার দিনভর ভোট শেষে প্রায় ৬৮ শতাংশ ভোট পড়ে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়। ভোট গণনা শুরু হয়েছিল বৃহস্পতিবার রাত ১০টা থেকে। এই দীর্ঘ সময় পর ফলাফলের ঘোষণা এলো। ভোটগ্রহণে অনিয়ম–বিশৃঙ্খলার অভিযোগের পর অধিকাংশ প্যানেলের বর্জন, দীর্ঘ সময় ধরে ভোটগণনার কাজের মধ্যে নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা এক শিক্ষকের মৃত্যুর মতো ঘটনা লেখা থাকবে এ নির্বাচনের আমলনামায়।
তবে মূল বিপত্তি ঘটেছে অভিযোগ থেকে মুখ রক্ষার জন্য ওএমআর মেশিনের বদলে হাতে ভোট গুনতে গিয়ে। জামায়াত সংশ্লিষ্ট এক কোম্পানি থেকে ব্যালট পেপার ও ওএমআর মেশিন কেনার অভিযোগ উঠলে নির্বাচন কমিশন ভোট গণনার কাজটি মেশিনের বদলে হাতে করার সিদ্ধান্ত নেয়। আর তা করতে গিয়েই লেজেগোবরে দশা হয়।
২৫ পদের ২০টিতেই শিবিরের জয় : জাকসু নির্বাচনে ভিপি পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী আব্দুর রশিদ জিতু ও জিএস পদে ছাত্রশিবির মনোনীত প্যানেলের মো. মাজহারুল ইসলাম নির্বাচিত হয়েছেন। এজিএস (ছাত্র) পদে ফেরদৌস আল হাসান ও এজিএস (ছাত্রী) পদে আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা নির্বাচিত হয়েছেন। তারা দুজনই ছাত্রশিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থী।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত ফলাফলে দেখা যায়, জাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদে শীর্ষ চারটি পদের মধ্যে ৩টিসহ মোট ২৫টি মধ্যে ২০টি পদে বিজয়ী হয়েছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের প্রার্থীরা। অন্য পদগুলোতে নির্বাচিতরা হলেন শিক্ষা ও গবেষণা সম্পাদক আবু ওবায়দা ওসামা (শিবির প্যানেল), পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মো. শাফায়েত মীর (শিবির প্যানেল), সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক মো. জাহিদুল ইসলাম (শিবির প্যানেল), সাংস্কৃতিক সম্পাদক মহিবুল্লাহ শেখ জিসান (স্বতন্ত্র), সহ–সাংস্কৃতিক সম্পাদক মো. রায়হান উদ্দীন (শিবির প্যানেল), নাট্য সম্পাদক মো. রুহুল ইসলাম (শিবির প্যানেল), ক্রীড়া সম্পাদক মাহমুদুল হাসান কিরন (স্বতন্ত্র), সহ–ক্রীড়া সম্পাদক (নারী) ফারহানা আক্তার লুবনা (শিবির প্যানেল), সহ–ক্রীড়া সম্পাদক (পুরুষ) মো. মাহাদী হাসান (শিবির প্যানেল), তথ্য–প্রযুক্তি ও গ্রন্থাগার সম্পাদক মো. রাশেদুল ইসলাম লিখন (শিবির প্যানেল), সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক আহসাব লাবিব (গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ–বাগছাস), সহ–সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (নারী) নিগার সুলতানা (শিবির প্যানেল), সহ–সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (পুরুষ) মো. তৌহিদ হাসান (শিবির প্যানেল), স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক সম্পাদক হুসনী মোবারক (শিবির প্যানেল) এবং পরিবহন ও যোগাযোগ সম্পাদক মো. তানভীর রহমান (শিবির প্যানেল)। এছাড়া কার্যকরী সদস্য (নারী) পদে ৩ জন নাবিলা বিনতে হারুন, ফাবলিহা জাহান, নুসরাত জাহান ইমা এবং কার্যকরী সদস্য (পুরুষ) পদে তিনজন মো. তরিকুল ইসলাম, আবু তালহা, মো. আলী চিশতী নির্বাচিত হয়েছেন। বিজয়ী সদস্যদের মধ্যে মো. আলী চিশতী বাগছাস সমর্থিত প্যানেলের। বাকি ৫ জন শিবির সমর্থিত প্যানেলের।
জানা যায়, এবারের নির্বাচনে ১১ হাজার ৭৫৯ জন ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ভোট দেন। কেন্দ্রীয় সংসদের ২৫টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ১৭৭ জন প্রার্থী। এর মধ্যে সহসভাপতি (ভিপি) পদে ৯ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে আটজন এবং যুগ্ম সম্পাদক (এজিএস) পদে ১৬ জন প্রার্থী রয়েছেন। নারী প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ছয়।
ভোটগ্রহণ শুরুর পর কারচুপির অভিযোগ তুলে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলসহ পাঁচটি প্যানেল নির্বাচন বর্জন করে। বর্জনকারীদের মধ্যে রয়েছে প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের সম্প্রীতির ঐক্য, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের সংশপ্তক পর্ষদ এবং স্বতন্ত্রদের অঙ্গীকার পরিষদ। এছাড়া ছাত্র ফ্রন্টের একটি বিভাজিত অংশ এবং কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীও ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন।
কে এই জিতু : জাকসু নির্বাচনে ভিপি নির্বাচিত হয়েছেন আব্দুর রশিদ জিতু। জিতু জাবির ‘গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন’ প্ল্যাটফরমের আহ্বায়ক। কোটা সংস্কার আন্দোলনের আগে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও আন্দোলনের সময় সর্বপ্রথম ছাত্রলীগের হাতে মার খেয়ে আহত হন।
আরিফ সোহেল আটক হলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে ফার্স্ট ম্যান হিসেবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগরের আন্দোলন পরিচালনা করেন। পরে অনিয়মের অভিযোগ তুলে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক পদ থেকে পদত্যাগ করে গণঅভ্যুত্থান রক্ষা আন্দোলন নামে প্ল্যাটফরমের সূচনা করেন এবং এই প্ল্যাটফরম থেকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দেন।
নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারায়নি, বললেন জিএস : নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে শেষ হওয়া জাকসু নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারায়নি বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত সমন্বিত শিক্ষার্থী জোটের নবনির্বাচিত জিএস মাজহারুল ইসলাম। জয়ী হওয়ার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবনের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা মনে করছি না যে, এই নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আপনারা দেখতে পাবেন, প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের ভোট দিয়েছেন।
মিছিল নয়, সিজদায় শুকরিয়া জানাবে ছাত্রশিবির : জাকসু নির্বাচনে নিজেদের প্যানেলের একচেটিয়া বিজয়ে আনন্দ মিছিল না করার কথা জানিয়েছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। সংগঠনটি বলেছে, বিজয় উদযাপনে মিছিল করার পরিবর্তে তারা সিজদার মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া জানাবে।
১৯৭২ সালে শুরু হওয়া জাকসু নির্বাচনের এবারের দশম আয়োজন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসাহ ছিল শুরু থেকে। ছাত্র সংগঠনগুলোও ভোটের দাবিতে সোচ্চার ছিল। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন পরিস্থিতিতে কয়েক দফা পেছানোর পর জাকসু নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হয় ১১ সেপ্টেম্বর। ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাগছাস, বাম–প্রগতিশীল ও স্বতন্ত্রদের অন্তত সাতটি প্যানেলসহ অনেকেই স্বতন্ত্র প্রার্থী হন।












