ছিল ৪০, আছে ১০

চট্টগ্রামে ওষুধ কারখানা ।। কাঁচামাল আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিদেশে রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়া ঢাকাকেন্দিক ।। ১৬ বছরে বন্ধ হলো ৩০টি

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

দেশে ওষুধ শিল্পের বিকাশ প্রত্যাশা ছাড়াচ্ছে প্রতিদিন। ২৫ হাজার কোটি টাকার অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মিটিয়ে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের নানা দেশে। তবে সবকিছু ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়ায় চট্টগ্রামে উৎপাদনে থাকা চল্লিশটির মত কারখানার মধ্যে গত ১৬ বছরে অন্তত ৩০টি ওষুধ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে বিশ্বখ্যাত বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের (জিএসকে)ও রয়েছে। বাকি ১০টির মত কারখানা বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে বলে জানিয়েছে ওষুধ প্রশাসন।
সূত্র বলেছে, দেশে বর্তমানে দুই শতাধিক ওষুধ কারখানা রয়েছে। তবে পুরোদমে চালু আছে শ’ দেড়েক কারখানা। এসব কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে জীবন রক্ষাকারী বিভিন্ন ধরনের ওষুধ। বিশ্বের নানা দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে শিল্পগুলোতে তৈরি করা হয় ওষুধ। পরবর্তীতে তা দেশব্যাপী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়। বড় বড় কারখানাগুলোতে উৎপাদিত ওষুধ বিদেশে রপ্তানিও করা হয়। বর্তমানে দেশের ওষুধের অভ্যন্তরীণ বাজারের সিংহভাগই যোগান দিচ্ছে দেশীয় ওষুধ কোম্পানি। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ ওষুধ রপ্তানিও করা হয়। কিন্তু কাঁচামাল আমদানি থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ বা বিদেশে রপ্তানির পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় ঢাকা থেকে। সব কার্যক্রম ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় বহুমুখী সম্ভাবনা থাকার পরও চট্টগ্রামের ওষুধ কারখানাগুলো একে একে বন্ধ হয়ে গেছে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা দৈনিক আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামের গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (জিএসকে) সহ বেশ কিছু কারখানার ওষুধ অনেক জনপ্রিয় ছিল। বিশাল বাজার ছিল তাদের। কিন্তু কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের সম্ভাবনাগুলো হাতছাড়া হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটের বিসিক শিল্প এলাকায় ‘থেরাপিউটিকস বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামের ওষুধ কারখানা গড়ে তোলা হয় ১৯৮০ সালে। প্রায় একশ’ কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে তোলা কারখানাটিতে ১২ ধরনের ওষুধ তৈরি হতো। কারখানাটি পুঁজিবাজার থেকে বেশ অর্থ তোলে। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে। এতে কোম্পানির শেয়ার হোল্ডাররা ব্যাপক ক্ষতির কবলে পড়েন। ক্ষতিগ্রস্ত হন মালিক শ্রমিক সবাই। সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় চট্টগ্রামের ওষুধ শিল্পের সম্ভাবনা।
শুধু থেরাপিউটিকস নয়, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের (জিএসকে) বন্ধ হওয়ার মাধ্যমে চট্টগ্রামে ওষুধশিল্পের সম্ভাবনার কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয় বলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মন্তব্য করেন। অবশ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া ৩০টি কারখানার বেশ কয়েকটি মান ধরে রাখতে না পারায় বন্ধ হয়ে গেছে বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, ওষুধ কারখানা পরিচালনার সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এসব নীতিমান প্রণয়ন করেছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে গুড ম্যানুফেকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি)। এই নীতিমালা অনুসরণ না করে কোনো কারখানাই চালু থাকার সুযোগ নেই।
একটি ওষুধ কোন কাঁচামালে উৎপাদন হবে, কী পরিমাণ কাঁচামাল প্রয়োগ করতে হবে, উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মান, উৎপাদিন ওষুধের মান ও বিপণন ব্যবস্থা কেমন হবে- সবকিছুই জিএমপি নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত। চট্টগ্রামে এখন যেসব প্রতিষ্ঠান আছে, তারা জিএমপি নীতিমালা অনুসরণ করে উৎপাদন করছে। বিসিক শিল্প এলাকার ম্যাফনাজ ফার্মাসিউটিক্যালস ও নাসিরাবাদ শিল্প এলাকায় সিটি ফার্মাসিউটিক্যালস নামের কারখানা জিএমপির কারণে বন্ধ হয়ে যায় বলেও সূত্র জানায়।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, চট্টগ্রামে বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো হচ্ছে, গ্ল্যাঙোস্মিথক্লাইন (জিএসকে), থেরাপিউটিকস বাংলাদেশ লিমিটেড, ম্যাফনাজ ফার্মাসিউটিক্যালস, ইউনাইটেড ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, সিটি ফার্মাসিউটিক্যালস, স্ট্যান্ডার্ড ল্যাবরেটরিজ, ইস্টার্ন হার্বাল প্রোডাক্টস ও দেশ ল্যাবরেটরিজ, ওরিসন ফার্মাসিউটিক্যালস, জনতা ফার্মাসিউটিক্যালস, বিন্দু মাধব শাহ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড, শরত রক্ষিত ঔষধালয়, শান্তি আয়ুর্বেদীয় ঔষধালয়, এপসিস ফার্মাসিউটিক্যালস, প্রিমিয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস, ভাইটাল ফার্মাসিউটিক্যালস, ফ্লোরা ফার্মাসিউটিক্যালস, নিকন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, উদয়ন ফার্মাসিউটিক্যালস, ম্যাগ ল্যাবরেটরিজ ইত্যাদি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর বাইরে অনেকগুলো আয়ুর্বেদিক এবং ইউনানী ঔষধালয়ও বন্ধ হয়ে গেছে। ওষুধ প্রশাসনের দায়িত্বশীল সূত্র চট্টগ্রামে বর্তমানে দশটির মতো ওষুধ কারখানা চালু রয়েছে বলে জানিয়েছে। এগুলোর মধ্যে এলবিয়ন লাবরেটরিজ লিমিটেড, ইউনাইটেড কেমিক্যালস এন্ড ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, অরবিট ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড, রেকিট বেনকিজার বাংলাদেশ লিমিটেড, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, রয়েল ফার্মাসিউটিকালস লিমিটেড উল্লেখযোগ্য।
ওষুধ সেক্টরের উন্নয়নে সরকার বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে এবং এর সুফলও মিলছে বলে মন্তব্য করে দেশের শীর্ষ একটি ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে এ সেক্টরের। গার্মেন্টস সেক্টর থেকে অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ রয়েছে। বিশ্বের বিশাল রপ্তানি বাজারের খুব সামান্য একটি অংশ ধরতে পারলেও বাংলাদেশকে পেছনে ফিরে তাকাতে হতো না। হাজার হাজার কোটি ডলারের ওষুধ রপ্তানি করা যেতো। বর্তমানে ১৬০টির মতো দেশে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ওষুধ রপ্তানি হয় বলেও তিনি উল্লেখ করেন। ওষুধ পরীক্ষা থেকে শুরু করে মান নিয়ন্ত্রণ এবং আমদানি রপ্তানি কার্যক্রমসহ সার্বিক বিষয়গুলো সহজ করলে চট্টগ্রামে এই শিল্পের বিকাশে বড় সম্ভাবনা রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভয়-ভীতি ও নিপীড়ন ছাত্রদের দমানো যায়নি
পরবর্তী নিবন্ধখাগড়াছড়িতে নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি আটক ১