বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং স্বাগতিক নিউজিল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়ার পর বাংলাদেশের মেয়েদের সামনে আসে পাকিস্তান। আর ম্যাচের আগের দিন অধিনায়ক নিগার সুলতানা বলেছিলেন, পাকিস্তানকে হারাতে চান তারা। পাকিস্তানকে হারিয়ে মাঠের কাজ শেষ করে নিগারের কণ্ঠে গর্বিত উচ্চারণ, ‘আজ ইতিহাস গড়ার দিন।’ পাকিস্তানকে ৯ রানে হারিয়ে মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ পেয়েছে প্রথম জয়ের দেখা। মাইলফলকে পৌঁছে উচ্ছ্বসিত নিগার বলেন, আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। বিশ্বকাপে আমাদের প্রথম জয়। আজকে ইতিহাস গড়ার দিন, আমরা গড়েছি। এই মোমেন্টাম আমরা টুর্নামেন্ট জুড়ে বয়ে নিতে চাই। বাংলাদেশের একটি পরিবর্তন এ দিন কাজে লেগে যায়। পেস বোলিং অলরাউন্ডার লতা মন্ডলের জায়গায় একাদশে আনা হয় লেগ স্পিনিং অলরাউন্ডার ফাহিমা খাতুনকে। সেই ফাহিমাই দারুণ বোলিংয়ে ঘুরিয়ে দেন ম্যাচের মোড়। নিগার জানান, হ্যামিল্টনের উইকেটের আচরণ ভাবনায় রেখেই ফাহিমাকে একাদশে আনা হয়। এখানকার দুটি ম্যাচ আমি দেখেছি। খেয়াল করেছি, স্পিনাররা এখানে সুবিধা পায়। আমার মনে হয়েছে, সে যদি নিজের সেরাটা দিতে পারে, আমরা তাকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে পারি।
গত নভেম্বরে জিম্বাবুয়েতে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে পাকিস্তানকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। এবার হারাল মূল আসরেও। এই জয়ের বিশ্বাসকে সঙ্গী করেই এবার সামনে এগিয়ে যেতে চান নিগার। তিনি বলেন, আমরা পাকিস্তানকে খুব ভালো করে জানি। পরস্পরের সঙ্গে অনেক খেলেছি আমরা। সবশেষ স্মৃতিও দারুণ, বাছাইপর্বে ওদেরকে শেষ ওভারে হারিয়েছিলাম। আজকের জয়ও রোমাঞ্চকর। মেয়েরা কঠোর পরিশ্রম করেছে। এখন সামনে এগিয়ে যেতে চাই। জয় সবসময়ই আত্মবিশ্বাস জোগায়। এ রকম কিছুই আমরা চাচ্ছিলাম। এই মোমেন্টামই আমরা চাচ্ছিলাম। আমাদের দলটি ভালো, ক্রমে উন্নতি করছি। আমরা জানি যে আমাদের সামর্থ্য আছে।
সেডন পার্কে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা বাংলাদেশ গতকাল সোমবার হ্যামিল্টনের ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে ৫০ ওভারে তোলে ২৩৪ রান। ওয়ানডেতে এটি তাদের সর্বোচ্চ দলীয় রান। টানা দ্বিতীয় ফিফটিতে ফারজানা হক করেন ৭১, অধিনায়ক নিগার সুলতানার ব্যাট থেকে আসে ৪৬। তৃতীয় উইকেটে দুজনের দুর্দান্ত জুটির রান ৯৬। বাংলাদেশ ইনিংসের সেরা জুটি গড়ে তোলেন দলের সবচেয়ে ধারাবাহিক ব্যাটার ফারজানা ও অধিনায়ক নিগার। ১২৪ বলে ৯৬ রানের এই জুটি ভাঙে নিগারের বিদায়ে। ফাতিমা সানার অফ কাটারে বাংলাদেশ অধিনায়ক এলবিডব্লিউ হন ৬৪ বলে ৪৬ রান করে। একাদশে ফিরে ওপেনার শারমিন আক্তার খেলেন ৪৪ রানের ইনিংস। শেষ দিকে দ্রুত রান তুলতে পারা ফাহিমা খাতুন আউট হন প্রথম বলেই। ইনিংসের শেষ দিকে রিতু মনি ও সালমা খাতুনও খুব দ্রুততায় রান তুলতে পারেননি। সম্ভাবনা জাগিয়েও তাই আড়াইশ ছুঁতে পারেনি বাংলাদেশ।
পাকিস্তান ২৩৫ রানের লক্ষ্যে নেমে রান তাড়ায় শুরুটা করে দুর্দান্ত। নাহিদা খান ও সিদরা আমিন উদ্বোধনী জুটিতেই দলকে নিয়ে যান শতরানের কাছাকাছি। রানের গতি খুব ভালো না হলেও দলকে ভালো ভিত গড়ে দেন দুজন। ৯১ রানের উদ্বোধনী জুট ২৪তম ওভারে ভাঙেন রুমানা আহমেদ। ৪৩ রান করে নাহিদা খান স্টাম্পে টেনে আনেন বাইরের বল। দ্বিতীয় উইকেটে সিদরা আমিন আরেকটি ভালো জুটি গড়েন বিসমাহ মারুফের সঙ্গে। এই জুটিতে আসে ৬৪ রান। বোলিংয়ে শুরুটা ভালো করতে না পেরে ফিল্ডিংয়েও কিছুটা খেই হারায় বাংলাদেশ। সিদরা আমিন প্রথমবার জীবন পান ২৩ রানে, সালমা খাতুনের বলে। এরপর ৪৮, ৫৪ ও ৬০ রানে সুযোগ দেন তিনি, প্রতিবারই রিতু মনির বলে। কোনোটিই নিতে পারেনি বাংলাদেশ। বিশেষ করে, ৬০ রানের সময় সহজতম ক্যাচ ছাড়েন ফারজানা। বারবার বেঁচে গিয়ে সিদরা এগিয়ে যান শতরানের পথে। তবে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়ায়। দ্বিতীয় স্পেলে ফেরা জাহানারা আলমকে স্লগ করতে গিয়ে পাকিস্তান অধিনায়ক বিসমাহ আউট হন ৩১ রানে। এরপর লেগ স্পিন দিয়ে পাকিস্তানকে পর্যদুস্তু করে বাংলাদেশ। ওমাইমা সোহেলকে ফেরানোর পর ফাহিমা পরপর দুই বলে আউট করেন বিপজ্জনক আলিয়া রিয়াজ ও ফাতিমা সানাকে। পাকিস্তানের আরেক ভরসা নিদা দারকে শূন্যতেই শেষ করেন রুমানা। ৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে পাকিস্তান অনেকটা ছিটকে পড়ে পথ থেকে।
সিদরা আমিন তবু চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু পাকিস্তানকে বিশ্বকাপে প্রথম সেঞ্চুরি উপহার দেওয়ার পর তিনি বিদায় নেন রান আউটে। পাকিস্তান যেতে পারে ২২৫ রান পর্যন্ত। ৪১ ওভার শেষেও ৮ উইকেট বাকি ছিল পাকিস্তানের, বলপ্রতি রান করলেই চলত। স্রেফ ৫২ রান দরকার ছিল পাকিস্তানের। কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত অধিনায়কত্বে নিগার সুলতানা কাজে লাগান দুই লেগ স্পিনার রুমানা আহমেদ ও ফাহিমা খাতুনকে। ফাহিমা দ্রুত ৩ উইকেট নিয়ে নেন। অপর প্রান্তে জাহানারা আলম ও রুমানা আহমেদও নেন উইকেট। বাংলাদেশ ৫ রানের মধ্যে ৫ উইকেট নিলে এই ধাক্কা আর সামাল দিতে পারেনি পাকিস্তান। বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে ফাহিমার নেয়া ৩ উইকেট তাকে ম্যাচ সেরার মর্যাদা এনে দেয়।
ছেলেদের ক্রিকেটে প্রথম বিশ্বকাপে ১৯৯৯ সালে স্কটল্যান্ডকে হারানোর পর পরাক্রমশালী পাকিস্তানকে হারিয়েছিল বাংলাদেশ। মেয়েরাও প্রথম বিশ্বকাপে হারাল পাকিস্তানকে। ওয়ানডেতে পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের টানা তৃতীয় জয় এটি, তিনটিই দেশের বাইরে।