বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রাষ্ট্র ইরান থেকে অবৈধভাবে দুই জাহাজ এলপিজি আমদানি করার অভিযোগ নিয়ে ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানকারী জাহাজ দুইটির এলপিজি নিয়ে ওঠা অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বন্দর কর্তৃপক্ষ মেম্বারের (হারবার) নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি টিম জাহাজ দুইটি পরিদর্শন করেছে। নৌ পরিবহন উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে দেয়া আবেদনে এলপিজি অপারেটর্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) অভিযোগ করেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে আমদানি নিষিদ্ধ রাষ্ট্র ইরান থেকে এলপিজি নিয়ে দুইটি জাহাজ অবস্থান করছে। চিঠির সাথে লোয়াবের পক্ষ থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণপত্রও যুক্ত করা হয়েছে। লোয়াবের অভিযোগ সংঘবদ্ধ একটি চক্র গত জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত ২ লাখ ৫৬ হাজার ২৫২ টন এলপিজি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রাষ্ট্র থেকে অবৈধভাবে আমদানি করেছে। এর মাধ্যমে ১৭৫ মিলিয়ন ডলার দেশের বাইরে পাচার করা হয়েছে। চট্টগ্রামের বহুল বিতর্কিত এক শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে পরিচালিত এসব অবৈধ আমদানিতে ইসলামী ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, আল–আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক এবং অন্যান্য কয়েকটি ব্যাংক এলসি খোলার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছে। ইতোপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংককে বিষয়গুলো জানানো হলেও পাত্তা দেয়া হয়নি বলেও চিঠিতে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
সূত্র বলেছে, দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার বেড়েছে। গৃহস্থালি, বাণিজ্যিক এবং শিল্পকারখানায় গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এলপিজি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃত এলপিজি বোতলজাত করে দেশব্যাপী বাজারজাত করা হচ্ছে। দেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ১৪ লাখ টন এলপিজির চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে মাত্র দুই শতাংশ এলপিজি ইস্টার্ণ রিফাইনারিতে উৎপাদিত হয়। চাহিদার বাকি অংশ তুরস্ক, কাতার এবং আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করে বাজারে দেয়া হচ্ছে। দেশের এলপিজি শিল্পের সাথে জড়িতদের সংগঠন এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) নৌ পরিবহন উপদেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে দুইটি জাহাজের নাম উল্লেখ করে দেয়া এক চিঠিতে অভিযোগ করে, চট্টগ্রামের একটিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রাষ্ট্র ইরান থেকে অবৈধভাবে এলপিজি আমদানি করে বাজারজাত করছে। চিঠিতে বলা হয়, ইরান থেকে এলপিজি আমদানি করে প্রথমে ইরাকে পাঠানো হচ্ছে এবং পরবর্তীতে ইরাকি বন্দর থেকে পণ্য লোডের তথ্য প্রদর্শন করে বাংলাদেশে আমদানি করছে। চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রাম বন্দরে আসা ‘জি ওয়াইএমএম’ নামের একটি জাহাজকে এই অবৈধ আমদানির কাজে ব্যবহারের অভিযোগ এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় ‘জি ওয়াইএমএম’ নামের যে জাহাজটি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করেছিল তার রেজিস্ট্রেশন নম্বর (আইএমও নম্বর: ৯১৩৯৬৯৬) এবং ‘জে টাইগার’ নামে অন্য একটি জাহাজের রেজিস্ট্রেশন নম্বরও একই।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের বিল অব এন্ট্রি এবং ইমপোর্ট জেনারেল মেনুফেস্ট (আইজিএম)সহ বিভিন্ন কাগজপত্রের কপি সংযুক্ত করে বলা হয়, বাংলাদেশের এক বা একাধিক কোম্পানি ‘জি ওয়াইএমএম’ নামের জাহাজে ইরাক থেকে ২০ হাজার ১০০ মেট্রিক টন এলপিজি ইরাকের খর আল জুবায়ের বন্দর থেকে লোডিং দেখিয়ে আমদানি করেছে। এ ব্যাপারে ইরাকের বসরা গ্যাস কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায় তারাই একমাত্র অনুমোদনপ্রাপ্ত ইরাকি কোম্পানি যেটি উম কাসর পোর্টের মাধ্যমে এলপিজি রপ্তানি করে থাকে। কিন্তু তারা রপ্তানির জন্য ‘জে ওয়াইএমএম’ জাহাজে কোনো এলপিজি লোড করেনি। এছাড়া তারা খর আল জুবায়ের বন্দর থেকেও রপ্তানির জন্য কোনো এলপিজি লোড করেনি। ইরাকের বসরা গ্যাস কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত নিশ্চিতকরণের সার্টিফিকেটও চিঠির সাথে সংযুক্ত করা হয়। চিঠিতে বলা হয়, নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রাষ্ট্র থেকে আমদানি করা এলপিজির প্রধান উপাদান প্রোপেন ও বিউটেনের (গন্ধ) সঠিক সংমিশ্রণ না থাকায় গুণগত মানে ত্রুটি থাকে। যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। বাংলাদেশে আমদানিকৃত এলপিজিতে অবশ্যই ‘গন্ধ’ মিশাতে হয়। যাতে রান্নাঘরে কোনো কারণে লিক হলে টের পাওয়া যায়। ইরান থেকে আমদানিকৃত এলপিজিতে গন্ধের সঠিক ব্যবহার থাকে না বলেও সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়া অবৈধ এবং নানা অনিয়মের মাধ্যমে একটি চক্র এলপিজি আমদানি করায় বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে।
এলপিজি অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (লোয়াব) প্রেসিডেন্ট আজম জে চৌধুরী স্বাক্ষরিত পত্রটি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড়ের সৃষ্টি হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে অবস্থানকারী জাহাজ ‘জে ওয়াইএমএম’ এবং ক্যাপ্টেন নিকোলাস নামের জাহাজ দুইটিতে অবৈধভাবে আমদানিকৃত এলপিজি রয়েছে।
ঘটনাটি তদন্তে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মেম্বার হারবারের নেতৃত্বে একটি টিম বহির্নোঙরে গিয়ে গতকাল জাহাজ দুইটি পরিদর্শন করে এসেছে।
বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি একটি অভিযোগপত্র পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, একটি টিম জাহাজ দুইটি পরিদর্শন করে এসেছে। তবে অভিযোগটি সত্য না মিথ্যা সেই সম্পর্কে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি।