আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার যেমন চলছে, তেমনি তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ইন্টারনেটের কারণে যেমন যোগাযোগ বেড়েছে, তেমনি নানা ধরনের সুবিধা পাচ্ছে মানুষ। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটা বিশাল অংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং এই ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তবে ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা যেভাবে বেড়ে যাচ্ছে সেই অনুপাতে সচেতন গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ছে না। যার কারণে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় অনেক ব্যবহারকারী জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধের জালে। বলা যায় সুবিধার পাশাপাশি একইসঙ্গে বাড়ছে সাইবার ক্রাইম, উদ্বেগ। ‘উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, জঙ্গিবাদ, গুজব, মিথ্যা খবর, কিশোর অপরাধ, আত্মহত্যা, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, ব্যাংক ডাকাতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসা’ সবই হচ্ছে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তা মোকাবিলা করা প্রশাসনের পক্ষে জটিল হয়ে পড়েছে। গত ১০ জুন দৈনিক আজাদীতে ‘অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানি বাড়ছে’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যমের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও হয়রানির ঘটনা বাড়ছে। প্রেমের সম্পর্ক ভাঙা বা ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের জের ধরে অনেক নারীর ফেইসবুক আইডি হ্যাক করা হচ্ছে, যৌন নিপীড়নমূলক বার্তা পাঠানো হচ্ছে। অনেকের ছবি বা নাম ব্যবহার করে ভুয়া আইডি তৈরি করে হেনস্তা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হকের বিশেষজ্ঞ মতামত তুলে ধরা হয়েছে। তিনি ইন্টারনেট নিয়ে জানাশোনা তুলনামূলক কম থাকা এবং সরল বিশ্বাসের কারণে নারীরা অনলাইনে সহিংসতার সহজ লক্ষ্যে পরিণত হন বলে মনে করেন। তিনি বলেন, বাস্তবের বাইরের জগতে নারীদের বিচরণ কম। অনেকে অনলাইনে বন্ধু গড়তে নিরাপদ বোধ করেন। সরল বিশ্বাস থেকেও প্রতারণার শিকার হন। আবার নিজের আইডির ক্ষেত্রে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা সম্পর্কেও অনেক নারী কম জানেন। অন্যদিকে নিপীড়ক পুরুষেরা অফলাইন, অর্থাৎ বাস্তব জগতের মতো অনলাইনেও সক্রিয় থাকে। মাসুম নামে এক হ্যাকারকে গ্রেপ্তারের পর নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) জানতে পেরেছে, ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, বিশেষ করে নারীদের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাক করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন তিনি। এ ক্ষেত্রে ‘ফিশিং লিংক’ (কাউকে ধোঁকা দিয়ে হ্যাক করতে অনলাইন মাধ্যমে পাঠানো লিংক) ব্যবহার করতেন তিনি।
সাম্প্রতিক এক জরিপে বলা হয়েছে, এক বছরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে হয়রানিতে পর্যবসিত হয়েছেন ১৭ হাজারের বেশি নারী। সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইবার অপরাধ নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। সাইবার অপরাধ সমাধানের জন্য সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। অপরাধ মোকাবিলার সঙ্গে যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রয়োজন সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য দেশব্যাপী ইতিবাচক প্রচারণা।
অতি সমপ্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে যোগাযোগ ও প্রযুক্তির বিকাশে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি তা মোকাবিলা করা পুলিশের জন্যও চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, বিশ্বায়নের এই যুগে সহিংস চরমপন্থা ও আন্তর্জাতিকভাবে সংঘটিত অপরাধগুলো জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার জন্য একটি বিশাল হুমকি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নত প্রযুক্তি ও নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থা এ ধরনের অপরাধী নেটওয়ার্কগুলোকে শক্তিশালী করেছে। সাইবার ক্রাইম, মানি লন্ডারিং, মুদ্রা জালিয়াতি ও সন্ত্রাসে অর্থায়নের মত নতুন চ্যালেঞ্জের উদ্ভব হচ্ছে। তাদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ গোটা বিশ্বে সুদূরপ্রসারী অস্থিতিশীল প্রভাব ফেলে। এই প্রেক্ষাপটে পুলিশিং কার্যক্রম চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠেছে।
গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্টারনেট ব্যবহার করতে গিয়ে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে ৬৭.৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের শিকারে সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে তারা। এই অপরাধের শিকার নারীর হার ১৬.৩ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে অনলাইনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি। ছবি বিকৃত করে অনলাইনে অপপ্রচারের শিকার হওয়া নারীর হার ১১.২ শতাংশ। সংঘটিত অপরাধের চেয়ে জরিপে মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়েছে পর্নোগ্রাফি। এই অপরাধ ২.২৫ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.০৫ শতাংশে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে পর্যাপ্ত ফরেনসিক ডিভাইস নেই এবং এ বিষয়ক ল্যাবও তেমন গড়ে ওঠেনি। ফলে সাইবার অপরাধের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। কেউ কেউ সন্দেহজনকভাবে গ্রেফতার হলেও উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে এসে ভুক্তভোগীকে আবার হুমকি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে অপরাধ দমনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে আরো সক্রিয় হতে হবে।