মানবাধিকার সংগঠন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) দেওয়া জুন মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জুন মাসে দেশে ধর্ষণ ও গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা বেড়েছে। দলবদ্ধ ধর্ষণসহ নারীর প্রতি নির্যাতনও কমেনি এ মাসে। শারীরিক নির্যাতন, নিগ্রহ বেড়েছে। গত মে মাস থেকে দেশে অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। জুন মাসে তার সংখ্যা সামান্যই কমেছে। রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতের সংখ্যাও কমেনি।
গত সোমবার প্রকাশিত এ প্রতিবেদন দেশের শীর্ষ ২০টির বেশি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকের প্রতিবেদন এবং নিজেদের তথ্যানুসন্ধানের ভিত্তিতে তৈরি করেছে এমএসএফ। এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী এ মাসে ৩৬৩টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। যা গত মাসের তুলনায় ৫টি কম। এ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ৬৩টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৭টি, ধর্ষণ ও হত্যা ৪টি। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭ জন প্রতিবন্ধী কিশোরী ও নারী। গত মে মাসে দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল ৫৯টি।
চলতি মাসে ধর্ষণের শিকার ৬৩ জনের মধ্যে ১৯ শিশু ও ২৩ কিশোরী রয়েছে। অপরদিকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২ শিশু, ৭ জন কিশোরী ও ৮ জন নারী এবং ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়েছেন ১ জন কিশোরী ও ৩ জন নারী। ধর্ষণের চেষ্টা ২৭টি, যৌন হয়রানি ৩৯টি, শারীরিক নির্যাতনের ৫১টি ঘটনা ঘটেছে।এমএসএফের পরিসংখ্যান অনুযায়ী জুন মাসে অন্তত ৪১টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ১০জন নিহত ও ৪৭ জন গুরুতর আহত হয়েছে। গণপিটুনির শিকার ৩০ জনকে আহতাবস্থায় পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে। গণপিটুনিতে নিহতের মধ্যে ২ জনকে ডাকাতির অভিযোগে, ৩ জনকে সন্দেহজনক চুরির অভিযোগে, ১ জনকে খুনের অভিযোগে, ২ জনকে চুরির অভিযোগে এবং আরও দুজনকে শিশু নির্যাতন ও নারী ধর্ষণের অভিযোগে হত্যা করা হয়। অপরদিকে হত্যার অভিযোগে ১ জন, ৫ জনকে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে, ৩ জনকে যৌন হয়রানির অভিযোগে, ৪ জনকে ছিনতাইয়ের অভিযোগে, ১৭ জনকে নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মী হওয়ার অভিযোগে, ৪ জনকে ডাকাতির অভিযোগে এবং চুরি, চাঁদাবাজি, কটূক্তি, প্রতারণা, অপহরণ এ ধরনের অপরাধজনিত বিষয়ে সন্দেহজনকভাবে ১৫ জনকে গণপিটুনি দিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। গত মে মাসে গণপিটুনির ৩৪টি ঘটনায় ৭ জন নিহত হয়েছিল বলে এমএসএফের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সেই তুলনা জুন মাসে গণপিটুনিতে হত্যার সংখ্যা বেড়েছে।
একদিকে অর্থনৈতিক স্থবিরতা, অন্যদিকে নির্বাচনসহ নানা কারণে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দেশের ভঙ্গুর আইন–শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সংকট বাড়িয়ে তুলছে। সমাজে নিরাপত্তাহীনতার বোধ গভীর থেকে গভীর হয়েছে। উপরের পরিসংখ্যান দেশের সামাজিক অস্থিরতা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সামনে একটি বড় চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে। হত্যাকাণ্ডের এই ঊর্ধ্বগতির পেছনে রাজনৈতিক সহিংসতা একটি প্রধান কারণ, যেখানে আধিপত্য বিস্তার, প্রতিশোধ এবং চাঁদাবাজির মতো বিষয়গুলো রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপরাধ বৃদ্ধির তুলনায় তা নিয়ন্ত্রণের শক্তি দুর্বল। তুচ্ছ কারণে বড় ধরনের অপরাধ, মব সহিংসতা এবং আইনের বাইরে গিয়ে অভিযোগ নিষ্পত্তির চেষ্টা সমাজকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা, মানুষের মধ্যে সহনশীলতার অভাব, মানবিকতার চর্চার ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও বেকারত্ব অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধিও এই পরিস্থিতির জটিলতা বাড়িয়েছে। তাঁরা বলেন, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সিপিবি ও গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন নেতৃবৃন্দ বলেছে, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে জননিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত হয়নি, বরং অবনতির দিকে যাচ্ছে। জবাবদিহিমূলক বিচারিক প্রক্রিয়ার অভাব ও নারীকে অধস্তন হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতাকে উৎসাহিত করছে। কুমিল্লার মুরাদনগরে নারীর ওপর যৌন নিপীড়ন ও সহিংসতার ঘটনা প্রসঙ্গে তাঁরা এ কথা বলেছেন ।
তাই আইন–শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে মাঠ পর্যায়ে আরো সক্রিয় হতে হবে এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সমন্বয়হীনতা দূর করতে হবে। মব ভায়োলেন্স বন্ধ করে মানুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহনশীলতার চর্চা বৃদ্ধি এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ সংকটকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমাধানমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।