পথ চলতে গিয়ে চোখে পড়ে বিয়ের বরের সাজানো গাড়ি বর নিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎ করে গাড়ির সামনে পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে ‘কিছু হিজড়া’, তারা বিভিন্ন রকেমের অশ্লিল অঙ্গভঙ্গি করে বিশাল অংকের চাঁদা দাবি করে। এতে সাথে থাকা পরিবার পরিজন নিয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। এদেরকে সন্তুষ্ট না করে বিয়ের বরের গাড়ি যেতে পারবে না। বিয়ের জন্য সাজানো বাড়ি বা গায়ে হলুদের জন্য সাজানো বাড়িতে চাঁদার জন্য সংঘবদ্ধ হামলা নিত্য ঘটছে। বর্তমানে হিজড়াদের চাঁদাবাজি থেকে বাদ যাচ্ছে না অফিস আদালত। তাদেরকে নিয়মিত মাসোহারা না দিয়ে অফিস চালানো কষ্টকর। বিভিন্ন সিএনজি স্টেশন, পেট্টোল পাম্প বা ট্রাফিক সিগন্যাল সর্বত্র এদের চাঁদাবাজি লক্ষ্যণীয়। এদের চাহিদা অনুযায়ী চাঁদা না দিলে অস্বস্থিকর পরিস্থিতির মাঝে পড়তে হয়, যা পথচলা ভদ্রলোক বা স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের জন্যই খুবই বিব্রতকর।
চাঁদাবাজিতে হিজড়াদের সাথে সাধারণত হিজড়ারূপী কিছু সুযোগ সন্ধানি চাঁদাবাজদের উপস্থিতিও দেখা যায়। তাঁরা হিজড়া সেজে চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও এদের কাছে অসহায় এছাড়া তাদের সহযোগিতা পাওয়া যায় না। চাহিদামতে চাঁদা না পেলে মুহূর্তের মধ্যে অসংখ্য হিজড়ার উপস্থিতি বিভিন্ন অশ্লিল অঙ্গভঙ্গি এবং চিল্লাচিল্লি হৈ হুল্লোড়, পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ ধারণ করে। অনেক সময় রক্তাক্তের ঘটনাও ঘটে।
অনেক স্থানে নগর বা মহানগরে জায়গা জমি দখল বাণিজ্যে ও হিজড়াদের ব্যবহার করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র এ জনগোষ্ঠীকে যেভাবে কিছু সুযোগ সন্ধানি চক্র ব্যবহার করছে তা একটি সমাজ ব্যবস্থার জন্য শুভ লক্ষণ নয়। হিজড়া ছাড়াও বেদে বা বাইদ্যানিরা একই পন্থায় নগরে চাঁদাবাজি করে চলছে। বর্তমানে যেভাবে বিভিন্ন মহানগরে হিজড়াদের চাঁদাবাজি ভয়ানকরূপ ধারণ করেছে এ থেকে পরিত্রাণ জরুরি। বর্তমানে সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের জন্য এবং ভীষণ ৪১ বাস্তবায়নের প্রয়োজনে সমাজের এ জনগোষ্ঠীর জন্য সূদুর প্রসারি ও বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। হিজড়াদের বা সমাজের অবহেলিত এ জনগোষ্ঠীর জীবন মান উন্নয়নের প্রয়োজনে কিছু বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এদেরকে বিভিন্নভাবে কাজে লাগিয়ে মূল জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চলছে। ভারতে অনেক তৃতীয় লিঙ্গের লোককে বিচার বিভাগ সহ প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হচ্ছে।
হিজড়া সম্প্রদায় বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ। আবহমানকাল থেকেই এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর। এ লক্ষ্যে এ জনগোষ্ঠীর মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, তাদের জন্য সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিতকরণ, তাদের পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষা ব্যবস্থা, বাসস্থান, জীবনমান উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সর্বোপরি তাদেরকে সমাজের মূল স্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্তকরণের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় ২০১২–১৩ অর্থবছরে ‘হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি’ বাস্তবায়ন শুরু হয়। পরবর্তীতে ২০১৩–১৪ অর্থবছরে ২১টি জেলায় তা সম্প্রসারণ করা হয়। ২০১৫–১৬ অর্থবছর হতে ৬৪টি জেলায় হিজড়া জনগোষ্ঠীর ভাতা, শিক্ষা উপবৃত্তি এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রতিবছরই এ কার্যক্রমের আওতায় উপকারভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সমাজসেবা অধিদফতরের প্রাথমিক জরিপ মতে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১১ হাজার। ২০২১–২২ অর্থবছর হতে এ কর্মসূচির ভাতা ও শিক্ষা উপবৃত্তির নগদ সহায়তায় জিটুপি পদ্ধতিতে উপকারভোগীর মোবাইল হিসাবে প্রেরণ করা হচ্ছে।
২০১৯ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসম্বলি ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন বা ডিজিজেস (আইসিডি–১১) এর একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে, মানসিক ও আচরণগত ব্যধিগুলোর অধ্যায় থেকে ট্রান্সজেন্ডার–সম্পর্কিত বিভাগগুলো বাতিল করে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ প্যানেলও এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে, ‘হিজড়ারা’ মানসিকভাবে যেমন সুস্থ, তাঁদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যও প্রাকৃতিকভাবে স্বাভাবিক। কিন্তু অজ্ঞাতজনিত সামাজিক কুসংস্কার এই অসহায় জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে আছে।
ভ্রান্ত ধারণার বলি হয়ে তাঁরা কখনো স্বেচ্ছায়, কখনোবা বলপ্রয়োগের কারণে নিজ পরিবার থেকেও নির্বাসিত হন। মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের আঁতুড়ঘর পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অদৃশ্য অথচ দুর্ভেদ্য দেয়ালের আড়ালে বেড়ে ওঠার ফলে তাঁদের কাছে সামাজিক ও মানবিক মূল্যবোধের পরিচয় অধরাই থেকে যায়। তাই অনেক ক্ষেত্রেই সক্ষমতা থাকার পরও কেউ তাঁদের কাজে নিয়োগ দিতে চান না। কিন্তু মূল্যবোধের ঘাটতি তো আর ক্ষুধার কমতি ঘটানো। তাই সাধারণত দেখা যায় পেটের তাগিদে তাঁরা পথে ঘাটে, বাজারে, যানবাহনে হাত পাতে, চাঁদা তোলে। কিন্তু এটি এখন তাদের পেশায় পরিণত হতে চলেছে। এখানেই আমাদের ভীত হওয়ার কারণ।
রাষ্ট্র ও সমাজ যেহেতু তাঁদের বোধের বিকাশে ভূমিকা রাখেনি, তাই যৌক্তিক কারণেই তাঁদের আচরণগত অসংলগ্নতার দায় সভ্য সমাজের ওপরই বর্তায়। অথচ সমাজের কারও কারও আচরণদৃষ্টে মনে হয়, এই লিঙ্গ বৈচিত্র্যময় মানব সন্তানেরা ইতর প্রাণীর চেয়েও নিকৃষ্ট। সরকার ২০১৪ সালের ২২ জানুয়ারী লিঙ্গ বৈচিত্রময় এই জনগোষ্ঠীকে ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখন তাঁরা সব ধরনের সরকারি–বেসরকারি নথিপত্রে ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষ হিসেবে পরিচিত হচ্ছেন। জীবনমান উন্নয়নকল্পে সরকার সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৫০ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সী অসচ্ছল ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষদের জন্য মাসিক বিশেষ ভাতা এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে ‘হিজড়া’ শিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে তাঁদের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকারের দেয়া এসব সুবিধাদি গ্রহণে তাঁদেরকে উৎসাহিত করে সাধারণ জীবন যাপনের দিকে আকৃষ্ট করা প্রয়োজন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন’ সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠীর মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো আমার বিবেচনায় মোটেও যথেষ্ট নয়। এযাবৎকালের সবচেয়ে নিখুঁত ও অন্তর্ভূক্তিমূলক বৈশ্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচিত হয় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি), যার ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে লিঙ্গ সমতাসংক্রান্ত লক্ষ্য এসডিজি–৫ এর মূল বক্তব্য হচ্ছে ‘লিঙ্গ সমতা অর্জন করা এবং সকল নারী ও কন্যাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা’। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এসডিজি–৫ এর ৯টি টার্গেট এবং ১৪টি ইন্ডিকেটরের কোথাও ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষদের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। অথচ এসডিজির মূল স্লোগান হচ্ছে ‘কেউ বাদ যাবে না’। এসডিজি–৫ নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করার সুযোগ রয়েছে।
এ জন্য হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কর্মরত সংস্থাগুলোকে নিয়ে সমন্বিতভাবে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। যাতে ‘হিজড়া’ লিঙ্গের মানুষেরা তাদের নিজ নিজ পরিবার, সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠার সুযোগ পান। বিশ্বের বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা, এনজিও ও সমাজ সচেতন প্রতিষ্ঠান সমূহ সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য বিভিন্নভাবে কাজ করলেও হিজড়াদের নিয়ে কোনও ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বা সমাজ সেবামূলক সংগঠন কোন কর্মসূচি নিয়েছেন এটি আমার নজরে আসেনি।
‘হিজড়া’ বা তৃতীয় লিঙ্গের এ জনগোষ্ঠী আমাদের সমাজের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। এদেরকে যারা বিপথগামী করে ফায়দা লুটছে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা উচিত।
‘হিজড়া’ বা তৃতীয় লিঙ্গের এ গোষ্ঠীকে আলাদা আইডিন্টেটি বা পরিচয় পত্র প্রদান করে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ে দাবি। একটি সুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়নে সমাজের অবহেলিত এ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। এ বিষয়ে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা প্রয়োজন। লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক–শিল্পশৈলী