আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | সোমবার , ২ অক্টোবর, ২০২৩ at ৪:৪২ পূর্বাহ্ণ

শরৎকাল। কখনো আকাশে কমলা লেবুর উজ্বলতায় কনকপ্রভা রোদ, কখনো হঠাৎ ঝম্‌ঝম্‌ বা রিমঝিম সুরে বৃষ্টির পরশ। অনেক বছর আগে লন্ডনে দেখেছিলাম গ্রীষ্মকালে ঝল্‌মল্‌ রোদের মাঝে হঠাৎ ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হতো। সেখানে সেজন্য প্রায় সবাই ছাতা অথবা রেনকোট সাথে নিয়ে বাইরে বের হতো। আমাদের দেশে ছাতা ব্যবহারের অভ্যাস আজকাল শহরে তেমন দেখা যায় না। কারণ এদেশে সুবিধা আছে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে রাস্তার পাশে দোকান রেঁস্েতারাতে আশ্রয় নেয়া যায় অথবা চট্‌ করে রিক্সা ভাড়া করা যায়। যখন কলেজে চাকরি করতাম তখন ছুটির সময় বর্ষা বা শরৎ ঋতুতে হঠাৎ রোদ সরে গিয়ে বৃষ্টি শুরু হতো। রিক্সা সহজে পাওয়া যেতো না কারণ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেশি। ছাত্রীরা চলে গেলে তখন অধ্যাপিকারা সবাই বাসায় ফেরার জন্য ব্যস্ত হতেন। দারোয়ানরা রিক্সা বা ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে আসতো। আমার রিক্সায় চড়তে খুব ভালো লাগতো। সন্তানদের স্কুল কলেজ থেকে আনানেয়া করতে গাড়ি ব্যস্ত থাকতো। তাই আমি প্রায়দিন রিক্সায় যেতাম। আমার সুবিধা ছিল অধ্যাপক মাহমুদা আপা চকবাজারে থাকতেন এবং অধ্যাপক সামসুন্নাহার আপা চান্দগাঁওতে। তারা আমাকে দেবপাহাড়ে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতেন। রিক্সায় আমরা খুব ফুরফুরে মেজাজে থাকতাম। রিক্সায় হুড ব্যবহার করতাম না। আমাদের কলরব হাসির ঝলকানিতে পথচারীরা অনেক সময় অবাক হয়ে দেখতো। কারণ তখন চট্টগ্রামের নারীরা খুবই রক্ষণশীল। কিন্তু মহিলা কলেজের আমরা কয়েকজন অধ্যাপক ছিলাম সব সময় মনের দিক থেকে তরুণ। তাই আমাদের মনে হতো ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। প্রাক্তন মন্ত্রী জনাব নোমান সাহেবের স্ত্রী তাসমিন আপা জামাল খান রোডের বাসায় থাকতেন (তখনো নোমান সাহেব মন্ত্রী হন নি)। প্রায় সময় তাসমিন আপাকে (গল্প করার জন্য একসাথে যাওয়া) বাসায় নামিয়ে আমি দেবপাহাড়ের বাসায় চলে যেতাম। হরতালের সময় অনেক দিন তাসমিন আপা আর আমি হেঁটে হেঁটে কলেজে আসতাম। জীবন তখন (১৯৮৪৯০) খুব সাধারণ ছিল। হাঁটতে আনন্দ লাগতো (হরতালে রাস্তা ফাঁকা) অথবা রিক্সায় সহকর্মীদের সাথে গল্প করে পথ ফুরাতে ভাললাগতো। চট্টগ্রামে সে সময় বিশেষ করে বিকেল তিনটাচারটার সময় মানুষ জন, রিক্সা, ট্যাক্সি, গাড়ির সংখ্যা খুবই কম ছিল। রাস্তা মসৃণ। কোথাও পানিতে রিক্সা বা গাড়ি আটকে থাকতো না। নিরিবিলি পরিবেশে বৃষ্টির রিমঝিম সুরে অন্তরে যেন সুরের মূর্ছনা গুঞ্জন করে উঠতো। সেন্ট মেরী’স স্কুল পার হলে রাস্তার দু’পাশে ঘন সবুজ গাছপালা ঝোপঝাড়। মাঝে মাঝে দু’একটা বাসা। রাস্তা দুপুরে একদম নির্জন থাকতো। এই পথে একা রিক্সায় যেতে শরীর ভয়ে ছম্‌ ছম্‌ করতো। কারণ সে সময় হাইজ্যাকারের ভয় ছিল। স্বাধীনতার পর মনে হয় সাতাত্তর আটাত্তর সালের পর থেকে চট্টগ্রামের নিরিবিলি রাস্তায় অনেকে ছিনতাইয়ের শিকার হতেন। (স্বাধীনতার আগে “ছিনতাই” শব্দটি শুনি নি)। কতদূর গেলে চট্টগ্রাম কলেজে বা মহসিন কলেজের গেটের পাশে কলেজের শিক্ষার্থীদের দেখা যেতো। তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতাম।

এ বছরে বর্ষা শুরু হয়েছে দেরিতে। তাই শরৎকালে প্রায়ই যখন তখন বৃষ্টি হচ্ছে। অনেক দিন অসুস্থ ছিলাম। প্রায় এক মাস কোথাও বের হই নি। তাই ভাদ্র মাসের শেষে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চারদিক সোনা রোদে ঝলমল করছে। ভাবলাম আজ আর বাসায় থাকবো না। একাই বের হবো। কিন্তু বিকেলে হঠাৎ আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেলো। ঝমঝম বৃষ্টি শুরু হলো, কিছুক্ষণ পর বৃষ্টি থেমে গেলো কিন্তু রোদ আর দেখা গেলো না। ভালই হলো বিকেলের হালকা আলো আর মেঘের কালো রং যেন প্রাকৃতিকে অপরূপ করে তুলেছিল। সত্যি বাংলাদেশের আবহাওয়া ও প্রাকৃতিক পরিবেশ খুব চমৎকার। এরকম সুন্দর একটি দেশকে ভালো না বেসে কি পারা যায়? তবে কেন মানুষ যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলে শহরকে নোংরা, কুৎসিত বানিয়ে রেখেছে। আবর্জনা পরিষ্কার করে শহরকে সুন্দর রাখার জন্য দায়িত্ববান জনপ্রতিনিধিরা কোথায় অবস্থান করেন। শুনেছি আজকাল ধনী ব্যক্তিরা কেউ দেশে থাকেন না। লন্ডন, ফ্রান্স, সিংগাপুর, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি মনোরম দেশে ঘর বাড়ি ক্রয় করে সেখানেই প্রায় সময় বসবাস করেন। ওনাদের ছেলেমেয়েরা বিদেশের স্কুল কলেজে পড়ে। ঠিকই তো রাস্তায় জ্যাম, জলাবদ্ধতা, সন্ত্রাস ইত্যাদি থেকে মুক্ত সুন্দর পরিবেশে বসবাস করাই শ্রেয়। সাধারণ মানুষের উপায় নেই। জলাবদ্ধতা, রাস্তার প্রচন্ড জ্যাম, ডেঙ্গু ইত্যাদির সাথে বাস করতেই হচ্ছে। কষ্ট হলেও সাধারণ মানুষের দেশের প্রতি গভীর মমতা। এদেশের ষড়ঋতু, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নদী সাগর অনেক সাধারণ মানুষের মনে আজও প্রচুর আনন্দ দান করে। তাই প্রতিদিন রচিত হচ্ছে কত গান, কবিতা, গল্প নাটক বা বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান। আবার, ডেঙ্গু, বন্যা, আগুন ও দুর্ঘটনায় দেখা যায় সাধারণ মানুষরাই প্রথমে ছুটে আসেন বিপদগ্রস্ত মানুষের উদ্ধারের জন্য।

বিকেলের আলোআঁধারের স্নিগ্ধ পরিবেশে বের হলাম। কোথায় যাবো? চট্টগ্রামে এখন বেড়াবার অনেক বিনোদন কেন্দ্র হয়েছে। কিন্তু সবই শহর থেকে দূরে। সমুদ্রের তীরে মেরিন ড্রাইভ আমার খুব ভালো লাগে। মসৃণ রাস্তা। সমুদ্র দেখতে দেখতে পতেঙ্গা যাওয়া যায়। অনেক বছর আগে বোম্বেতে আরবসাগরের তীরে মেরিন ড্রাইভ দেখে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম। শহরের রাস্তার পাশে আরব সাগরের তীরে বিশাল রাস্তা। পাশে বসার সুন্দর ব্যবস্থা। সেদিন ভেবেছিলাম আমাদের চট্টগ্রামেও সমুদ্র তীরে যদি এরকম রাস্তা থাকতো। এতো বছর পর আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের অনেক অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছেন। তাঁর প্রতি চট্টগ্রামবাসীর কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ।

বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার হওয়ায় বর্ষাকালে পানির প্লাবন থেকে কিছুটা রক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু এক ফ্লাইওভার থেকে আরেক ফ্লাইওভারের মাঝখানের স্বল্প ফাঁকা জায়গা দীর্ঘ দশ বছরেও পাকা হয় নি। এ বছরের বৃষ্টিতে বড় বড় গর্ত হয়েছে এবং পানি জমে রয়েছে। গাড়িতে বসে এতো ঝাঁকুনি অসহ্য লাগছিল। ভাবছিলাম রিক্সা বা ট্যাক্সি আরোহীদের কি করুণ অবস্থা। জনপ্রতিনিধিরা উপলব্ধি করতে পারেন না। কারণ তারা মার্সিডিজ, বিএমডব্লিউতে (এখন আরও নতুন ধরনের গাড়ি আছে) চলাচল করেন মনে হয় সেসব গাড়িতে তীব্র ঝাঁকুনি উপলব্ধি করা যায় না। লিংক রোড খুব সুন্দর, মসৃণ। রাস্তার দু’পাশে সবুজ শ্যামল পাহাড় সামনে উন্মুক্ত আকাশ, কালো সাদা মেঘ ও সূর্যাস্তের কমলা হলুদ আলো, মাঝে মাঝে পাহাড়ের ওপর সাদা কাশফুলের সমারোহ। কতদূর যাবার পর ড্রাইভার বললো আর যাওয়া যাবে না। রাস্তায় গাড়ির জ্যাম, প্রায় দু’ঘন্টা গাড়ির জ্যামে আটকে ছিলাম। পরে ফাঁক বুঝে গাড়ি ফিরিয়ে নিতে বললাম। সমুদ্রের বিপুল জলরাশি, অফুরন্ত ঢেউয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করার সৌভাগ্য হলো না। রাস্তা বিশাল কিন্তু পোশাক শিল্পের অসংখ্য কন্টেনার প্রায় সমগ্র রাস্তা জুড়ে ধীর গতিতে যাচ্ছিল। সেগুলোকে পাশ কাটিয়ে ট্যাক্সি বা গাড়ি যেতে পারছিল না। পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নারীরা স্বাবলম্বী হয়েছে। কিন্তু কন্টেনারগুলো যদি রাত এগারোটার পরে যাতায়াত করে তবে রাস্তায় জ্যাম হয় না। অথবা রাস্তার একপাশ দিয়ে চলাচল করতে পারে। তাহলে জনসাধারণের সুবিধা হতো। মেরিন ড্রাইভে জ্যাম হলে তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য কেউ কি ডিউটিতে থাকেন না? ট্যাক্সি

কয়েকদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম বিপুল পরিমাণে ইলিশ মাছ কলকাতায় রপ্তানি হচ্ছে। বড় চিংড়ি মাছও বিদেশে রপ্তানি হয়। দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আজকাল সেজন্য চিংড়ি ও ইলিশ মাছ খেতে পারছে না। আজকাল নববর্ষেও বাজারে ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না। যখন ইলিশ মাছ বাজারে প্রচুর তখন এতো দাম যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। কলকাতায় ইলিশ মাছ পাঠাচ্ছে ভালই হবে। কলকাতা আমাদের দেশের কাছে তাই যখন কলকাতার মানুষ এদেশের ইলিশ খাবে বাতাসে সুগন্ধ ভেসে আসবে। এদেশের সাধারণ মানুষের ঘ্রাণে অর্ধভোজন হয়ে যাবে। বিদেশে রপ্তানি করলে ডলার অর্জিত হয়। কৃষক, তাঁতী জেলে, রিক্সাচালক, শ্রমিক তাদের কি লাভ হয়। একশত বছর আগে তাদের যা অবস্থা ছিল এখনো তাদের ভাঙ্গাচোরা ঘর, শূন্য গোয়াল, পরনে পুরাতন পোশাক। অঘ্রাণে ধান খেতের মাঝে কৃষকের হাসির ছবি দেখে আমরা ভাবি, বাহ্‌! কৃষক তো খুব ধনী হয়েছে। কিন্তু একবার ক্যামেরাম্যান কৃষকের ঘরে গিয়ে ছবি তুললে বুঝতে পারবেন শত বছরেও কৃষকের অবস্থার পরিবর্তন হয় নি। মাছ, মাংস সবই বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। খুব খুশির কথা। কিন্তু এদেশের সাধারণ মানুষ কি খাবে। কচুশাক, কচুর লতি ইত্যাদিও কি ভবিষ্যতে পাওয়া যাবে? কাঁচা মরিচ দিয়ে সাদা ভাত খেতো। এখন সে উপায়ও নেই। ধনীদের জন্য চিন্তা নেই। তারা দেশে বিদেশে চিংড়ি, ইলিশ, ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ, মোগলাই সবই মহানন্দে খাচ্ছে। দূর ছাই! সাধারণ মানুষের জন্য আমি নগণ্য মানুষ কেন চিন্তা করছি।

টীকা : সূর্যান্ত দেখতে যাবো। গাড়ির জ্যামে তা সম্ভব হলো না। তাই এলোমেলো কত ভাবনা মাথায় এসেছিলো। ভাবছি আজকাল সাধারণ মানুষের জন্য কেউ কি চিন্তা করে? আবর্জনা, ভাঙা রাস্তা, বৃষ্টির পানি, শাক ভাত। সাধারণ মানুষের দুর্বিষহ জীবন তো কোন মতে কেটে যাচ্ছে। তাদের জন্য ভাবনা করার কি আছে?

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা হোক আনন্দের
পরবর্তী নিবন্ধসমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে পরিকল্পনা নেয়া জরুরি