মনসুর নাদিমের ‘মনামের বৈঠকখানা’

স. ম. ইব্রাহীম | সোমবার , ২ অক্টোবর, ২০২৩ at ৪:৪৩ পূর্বাহ্ণ

আমাদের চারপাশের প্রাত্যহিক জীবনের বিভিন্ন ঘটনা, সমসাময়িক অবস্থা, সামাজিকরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক হালচাল নিয়ে রম্য কলাম মনামের বৈঠকখানা। এতে স্থান পেয়েছে ৩০টি কিস্তির লেখা। লেখাগুলো সাম্প্রতিককালের। মনামের বৈঠকখানা’য় নানান চরিত্রের সন্নিবেশ ঘটেছে। বৈঠকখানার প্রধানকর্তা একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক। দুই বিবি নিয়ে তার সংসার। অন্য চরিত্রে রয়েছে তার বন্ধু আকবর আলী, সকিনার বাপ, মাস্টার সাহেব, কেরামত, চাকর গোলাম আলী প্রমুখ। একেকটা চরিত্র ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের।

মনামের বৈঠকখানা প্রকাশিত হয়ে আসছে দীর্ঘ সাড়ে তিন দশক থেকে। আনজুমান ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত মাসিক তরজুমানে ১৯৮৭ সালের আগস্ট সংখ্যা থেকে এ ধারাবাহিক কলাম চালু হয়। পরবর্তীতে দৈনিক পূর্বদেশে মনামের বৈঠকখানা প্রকাশিত হতে থাকে। কলামটি বেশ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। বৈঠকখানায় লেখক ছদ্মনাম ব্যবহার করেন মনাম। এ কারণে আসল লেখক কে, তা জানার কৌতূহল ছিল পাঠকদের। তখন লেখার ধরনে অনেকেই মনে করতেন তিনি একজন বয়স্ক ব্যক্তি এবং দেশেই তার অবস্থান। কিন্তু লেখক মনসুর নাদিম তখন ছিলেন দুবাই প্রবাসী ও টগবগে যুবক। নিজেকে একজন বয়স্ক ব্যক্তির ভূমিকায় এনে তিনি এ কলাম লিখেন। সাহিত্যে নিজেকে অন্যভাবে প্রতিস্থাপন করে লেখা সহজ নয়। তিনি সেটা করতে সক্ষম হয়েছেন। তাছাড়া প্রবাসে থেকেও দেশের সমসাময়িক ঘটনার চিত্রাবলী তার লেখায় তুলে এনেছেন।

তার রচনা বিশেষত মধ্যবিত্তের সুখদুঃখ, হাসিকান্না, আশাআকাঙ্ক্ষা, দুশ্চিন্তাদুর্ভোগ নিয়ে আবর্তিত হয়েছে। এতে ব্যঙ্গবিদ্রূপের চাবুক মেরে তিনি তুলে ধরেছেন আমাদের চারপাশের অসঙ্গতিগুলো। রম্য রচনার নির্মাণ রীতিতে কোথাও থাকে খানিকটা গল্পের আভাস, আবার কোথাও একটু কাব্যের মাধুর্য, কোথাও হাস্য পরিহাস ও কৌতুকের আলিঙ্গন। বৈঠকখানায় এসবের সন্নিবেশ ঘটেছে।

বৈঠকখানা আলাদা দুটি বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। প্রথমত এটা রম্যরচনা, দ্বিতীয়ত এটা সাধু ভাষায় রচিত। রম্য রচনা সহজ নয়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লেখায় রস সঞ্চার করা কঠিন কাজ। এটা সহজভাবে করার চেষ্টা করেছেন রসবোধসম্পন্ন লেখক। অপর ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য এতে সাধু ভাষার প্রয়োগ। এ ভাষা আমাদের থেকে অনেকটা হারিয়ে গেছে। বর্তমানে প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস সব রচিত হচ্ছে চলতি ভাষায়। সব সংবাদপত্রের ভাষাও চলতি। বলা যায় সাধু ভাষায় রচনা লোপ পেয়েছে। লেখক এ ভাষাকে রসোত্তীর্ণ করে পাঠকদের নিকট হাজির করেছেন। তার লেখার স্টাইল আজকের সূর্যোদয়ে প্রকাশিত সাধু ভাষায় লিখিত গেদু চাচার কলাম এর সাথে অনেকটা সাদৃশ্যপূর্ণ।

যে শিরোনামে লেখাগুলো স্থান পেয়েছে : বাড়তি চাপে রক্তচাপ বাড়িয়েছে স্রেফ/ গুরুজির হাতে বেত্রদণ্ডই শোভা পায়/ মীরজাফর মরিয়াছে, আওলাদ রাখিয়া গিয়াছে।/ ধাক্কাধাক্কির রাজনীতি ও অপশব্দের ভিড়/ তেল সমাচার/ বেগুনি আলুনি কুমডুমি সমাচার/ অসুক বা ব্যারাম কেন/ সমাজ পরিবর্তনে সামাজিক সংগঠনের বিকল্প নাই/ ভয়ংকর এলম বয়ানের মলম/ মহল্লায় মহল্লায় সামাজিক সংগঠনের বিকল্প নাই/ দেশপ্রেম বনাম ক্ষমতাপ্রেম/ সমাজদর্পণে পারিবারিক শিক্ষার প্রতিচ্ছবি/ লাজনীতিহীন রাজনীতি আওয়ামী লীগে ছদ্মবেশীরা দলের জন্য অশনিসংকেত/ সরকারি বকাউল্লাদের মুখে লাগাম দিন/ ধার চাওয়াও একটি আর্ট/ কোথায় যেন ভ্রান্তি/ সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ/ সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে রাজনীতির ব্যাকরণ বুঝো হে সুজন/ ইনসান চিরদিনই স্বার্থপর/ ভগ্ন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ/ দুর্গতির কত নাম/ সুস্থতা আল্লাহর বড় নেয়ামত দৃষ্টিভ্রমে সমাজে ভুল বার্তা ছড়ায়/ ধর্ম ও রাজনীতি/ মায়ের কিল হজম করিতে হয়/ চাটার দল উইপোকার মতো খাচ্ছে উন্নয়নকে/ সুরত আলীর ইলেকশান/ ক্ষমতার নানান শাখায় কোকিলের কুহু কুহু।

দেশে কিছুদিন পর পর বাড়ানো হয় তেল গ্যাস বিদ্যুতের দাম। এতে সাধারণ মানুষের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সীমিত বাজেটে সংসার চালানোর বিষয় চিন্তা করে অনেকের হার্টবিট বেড়ে যায়। ‘বাড়তি চাপে রক্তচাপ বাড়িয়েছে স্রেফ’ শিরোনামে লেখায় উল্লেখ করা হয়েছে আবারও ৫৩টি ওষুধের দাম বাড়াইয়া দরিদ্র লোকদের বড়ই উপকার করিয়াছে কর্তৃপক্ষ। মরিবি তো কালক্ষেপণ করে কী লাভ? চারিদিকের বাড়তি চাপে রক্তচাপ বাড়িয়া গিয়াছে। একমাত্র গ্যাসের চুলার চাপ এত চাপাচাপিতে বাড়িল না। এই একটা চাপ বাড়িলে আমার দুই বিবির মুখেও হাসির চাপ বাড়িয়া যাইত। আরে বাবা গ্যাসবিদ্যুতের জন্য কৃচ্ছ্রতাসাধনে আমরা এক পায়ে খাড়া। মাগার ঠেলাঠেলি করে ওষুধের দাম বাড়ানোর কী দরকার ছিল? ভোজ্য তেলের দাম একটু পড়িল তো দাহ্য তেলের দাম চড়িল। কী লাভটা হইল? মাঝে পড়িয়া রোগ ও রোগী নিয়া জমজমাট তেজারত হয়ে গেল।

লেখকের উপলব্ধিতে এসেছেএমনিতো দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। এ সময়ে ওষুধের দাম বৃদ্ধি ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’। জীবনরক্ষাকারী ওষুধেরও দাম বাড়লে মানুষ বাঁচবে কীভাবে?

গুরুজির হাতে বেত্রদণ্ড শোভা পায়’ শিরোনামে উল্লেখ করা হয়, যেইদিন থেকে শিক্ষকের হাত থেকে বেত্র ছিনাইয়া লইয়াছে সেইদিন হইতেই অধিকাংশ ছাত্র বেলাগাম আজাদী ভোগ করিতেছে। আজ পরিস্থিতি এমন হইয়া গিয়াছে ছাত্রের হাতে শিক্ষক অপমানিত হইতেছে। সেই মানুষ গড়ার কারিগর আজ কোথায় বঞ্চিত হইতেছে, কোথাও লাঞ্ছিত হইতেছে। আমার বাপদাদাদের আমলে স্কুলে না গেলে অন্য ছাত্রদের দ্বারা ধরিয়া আনা হইত। বেত্রদণ্ডসহ কঠিন শাস্তি নির্ধারিত ছিল স্কুল পালানো ছাত্রের জন্য। আমাদের সময়ে মাবাবারা শিক্ষকদের বলিতেন– ‘চামড়া বেরাই হাড্ডিগান চাই’। লেখক এতে শিক্ষকের বেতের ভয়ে ছাত্রের লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করার বিষয় উল্লেখ করেছেন। অনেক ছেলে বেত্রদণ্ডের কারণে মানুষ হয়েছে। বর্তমানে শিক্ষকদের ক্লাসে বেত নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই। বেত্রাঘাত করা যাবে না। অথচ আমরা ছোটবেলায় স্কুলে দেখতামশিক্ষকরা ক্লাসে ঢুকার সময় সাথে বেত, ডাস্টার (ব্ল্যাকবোর্ড মোছনের জন্য) ও চক নিতেন। তখন অনেক দুষ্ট ছাত্র বেত্রাঘাতের কারণে ভাল হয়েছে। অনেক অভিভাবক সন্তানকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শিক্ষকদের বলতেন শাসন করার জন্য। হয়তো বর্তমানে এ কড়া শাসন না থাকার কারণে তৈরি হচ্ছে কিশোর গ্যাং, বখাটের দল। উচ্ছন্নে যাচ্ছে শিশু কিশোররা।

তেল সমাচার’ শিরোনামে লেখক বিষয়টি তুলে ধরেন এভাবেতেলের অতি ব্যবহারে রাজনীতি এখন পিচ্ছিল। বাজারের ফর্দে তেল দেখিলে জিসিম ঠাণ্ডা হইয়া যায়। বানরের পিচ্ছিল তৈলাক্ত বাঁশ বাহিয়া উঠিবার অঙ্ক কষিতে কত লিটার তেলের প্রয়োজন তা হিসাব করা কঠিন হইয়া পড়িবে। তেলের ইস্তেমাল সঠিকভাবে করিতে পারিলে আপনি কামিয়াব। অফিসের বসকে যথাস্থানে তেল দিতে সক্ষম হইলে প্রমোশন রুখিবার সাধ্য কাহার? নেতাদের তেল মর্দন করিলে পদপদবি জুটে। ব্যবসাবাণিজ্য করিতে হইলে বড় ভাইদের তেল মালিশ করতে হয়।

সমাজের কোথায় তেলবাজ নাই? রাজনীতি, শিক্ষা সাহিত্যকোথায় নাই বলুন। মানুষ আপন চরকায় তেল দিতে গিয়া হিতাহিত জ্ঞান হারাইয়া অযোগ্যদের তৈলাক্ত করিতেছে। এদিকে, বাজারে তৈল সংকট হইলেও সংশ্লিষ্ট মহল নাকে তেল দিয়া নাক ডাকিতেছে।

এ প্রবন্ধে লেখক তেল নিয়ে তেলসমাতি, তেল মেরে নিজের স্বার্থসিদ্ধি, তেলের দাম নিয়ে অস্থিরতা তৈরি, তেল মেরে অযোগ্য ব্যক্তির পদোন্নতি ইত্যাদি বাস্তব বিষয়গুলো তুলে এনেছেন। বিভিন্ন সময় বিদেশি কিছু রাষ্ট্র আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলায়। দেশের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলে, নানান সবক দেয়। অথচ তাদের দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে অহরহ। হত্যাকাণ্ডও সংঘটিত হচ্ছে। স্কুলের শিশুরা পর্যন্ত হত্যার শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে বৈঠকখানায় লেখক এভাবে তুলে ধরেছেন।

এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না আমেরিকার মদদে ও প্রশ্রয়ে ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছে। তাদের বসতি দখল করছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে তারা নেতিবাচক মন্তব্য করলেও বর্তমানে এ দেশের বিস্ময়কর উন্নয়ন দৃশ্যমান, অন্যদের জন্য রোল মডেল। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হয়েছে এ দেশ।

অথচ বর্তমানে তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে নাক গলাচ্ছে এবং সবক দিতে চাচ্ছে। লেখকের কলামে বাদ যায়নি নগরের অন্যতম সমস্যা জলাবদ্ধতার বিষয়ও। তিনি দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরেন এভাবে।

একদিকে করোনা অপরদিকে জলাবদ্ধতা ইনসানদের নাকাল করিয়া ফেলিয়াছে। সামান্য বৃষ্টিতে চট্টগ্রাম ভাসিয়া যায়। জোয়ারের পানি ভিটেয় উঠিতে আমাদের বাপদাদার আমলে দেখি নাই। এখন দেখিতেছি। বাপদাদার আমলে খাল প্রশস্ত ছিল। পুকুর ডোবা খালে বিলে পানি ভরিয়া যাইত, উপচাইয়া পড়িত না।

অনেক জায়গায় পুকুর ডোবা ভরাট করিয়া দালান তুলিয়াছে। দালানের পর দালান উঠিয়ে ইনসানের অন্তরও দালানের মতো শক্ত হইয়া গিয়াছে।

বৈঠকখানায় লেখক প্রাসঙ্গিকভাবে মনীষীদের কিছু বাণী ও প্রবাদ উদ্ধৃত করেছেন। প্রখ্যাত কবিদের কবিতার চরণ যুক্ত করেছেন। বেশ কিছু হিন্দি গানের কলি ও হিন্দি ছবির সংলাপ জুড়ে দিয়েছেন, যা লেখাকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি এতে ঘটনাবহুল সময়ের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি ও শিক্ষা বিষয়ে সহজ সরলভাবে তুলে ধরেছেন। নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থার বর্ণনা করেছেন সততা ও সাহসিকতার সঙ্গে। তিনি শুধু সমস্যার চিত্র তুলে ধরেছেন তা নয় অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞজনের বরাতে সমাধানের পথও বাতলে দিয়েছেন।

বৈঠকখানার লেখাগুলো সত্যিই চিত্ররূপময়। তার কারণ এর উপাদানগুলো লেখক তার আশপাশ থেকে সংগ্রহ করেছেন। যে ঘটনাগুলো আমাদের চারপাশে ঘটে চলেছে।

ভাষা সহজ সরল, স্পষ্ট, প্রাঞ্জল ও সাবলীল। বাক্য, শব্দচয়নে ভুলক্রটি খুব একটা নেই। তবে ‘চাটার দল উইপোকার মতো খাচ্ছে উন্নয়নকে’ শিরোনামে ‘খাচ্ছে’ উন্নয়নকে সংশোধন করে খাচ্ছে পরিবর্তে খাইতেছে করা দরকার। কারণ খাচ্ছে চলতি শব্দ। রম্যরসে সমৃদ্ধ প্রতিটা লেখা। শব্দচয়ন, বাচনভঙ্গি যেন ছুরির ফলার মতো। পাশাপাশি প্রচ্ছদ, অলংকরণ, রূপায়নে লেখকের স্বকীয়তার পরিচয় মেলে। এ বইয়ের প্রচ্ছদ সাদামাটা অথচ সুন্দর। অফসেট পেপারে মুদ্রিত ১২৮ পৃষ্ঠার এ বইয়ে মুদ্রণপ্রমাদ কম। প্রিন্টও ঝকঝকে। এটা প্রকাশ করেছে স্বনামধন্য মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান শৈলী প্রকাশন। মুদ্রণ তত্ত্বাবধানে আইকো। প্রচ্ছদ এঁকেছেন নাটু বিকাশ বড়ুয়া। আশা করি এ বই পাঠকপ্রিয়তা পাবে। এ লেখার রসের হাঁড়ি থেকে রম্য রচনা বিভিন্ন বয়সের পাঠকরা সাদরে গ্রহণ করবে।

লেখক : সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে পরিকল্পনা নেয়া জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে বন্য শূকরের আক্রমণে আহত ৭