প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩ নভেম্বর, ২০২১ at ১০:২৮ পূর্বাহ্ণ

করোনা মহামারীতে ওমরাহ পালন

বিশ্বে করোনা মহামারী চলমান। এমনি অবস্থায় সৌদি সরকারের বিভিন্ন শর্তে অনুমতি পেয়ে ওমরাহ করার সৌভাগ্য হয়।
মনে হয় এই অভিজ্ঞতা হাজার হাজার অপেক্ষমান ওমরাহ যাত্রীর ন্যূনতম হলেও সহায়ক হবে। করোনা মহামারীর শুরুর দিকে ২০২০ সালের মার্চ মাসে সৌদি সরকার ওমরাহ গমন বন্ধ করে দেয়। দুই পবিত্র নগরীতে জনমানবশূন্য কারফিউ অবস্থা বিরাজ করতে থাকে ৫/৭ মাস। এমনি অবস্থায় মসজিদুল হারম ও মসজিদে নববীতে ইমাম মুয়াজ্জিন কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলিয়ে কয়েক শ’জনের উপস্থিতিতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ চলতেছিল। ২০২০ সালে সৌদি আরবের অভ্যন্তর থেকে ১ হাজার জনের অনুমতিতে ৯৩৭ জন হজ্ব করেন। চলতি ২০২১ সালেও সৌদি আরবের অভ্যন্তরে ৬০ হাজার জনের অনুমতিতে ৫৮ হাজার ৫ শত ১৮ জন হজ্ব করেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত সৌদি সরকার করোনা মহামারী চলমান অবস্থায়ও দেশকে বিভিন্ন শর্ত সাপেক্ষে স্বাভাবিক অবস্থায় পৌঁছাতে প্রচেষ্টা চালায়। স্থানীয়দের একাধিক শর্ত সাপেক্ষে মসজিদুল হারম ও মসজিদে নববীতে নামাজ পড়ার অনুমতি দেয়া হয়। পরবর্তীতে ওমরাহ করারও অনমুতি দেয়া হয়। প্রায় ৩ মাস আগে ১লা মহররম থেকে একাধিক শর্ত সাপেক্ষে বিদেশীরাও ওমরাহ করার অনুমতি লাভ করে। ফলে স্থবির হয়ে থাকা আমাদের দেশের হজ্ব এজেন্সী কাফেলাগুলো তাদের কার্যক্রম শুরু করতে থাকে। এতে দেশ থেকে ওমরাহ গমন শুরু হয়।
আমারও আগ্রহ জাগে ওমরাহ ও যেয়ারতের উদ্দেশ্যে গমন করতে। ফলে আল হেরা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলস এর এমডি মোরশেদুল আলম চৌধুরীকে জানিয়ে দিই ওমরায় গমন করতে চাই বলে। ওমরাহ ভিসার মেয়াদ ১ মাস, বেশি সময় পবিত্র নগরীতে কাটাতে আমি থাকতে চাই ২৮ দিন। কিন্তু সৌদি ওমরাহ এজেন্ট ২৬ দিনের বেশি সময়ের জন্য সম্মত নয়। অবশেষে চট্টগ্রামের সাথে সরাসরি ফ্লাইট মিলাতে ২৪ দিনে এসে দাড়ায়।
সৌদি সরকারের দেয়া শর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম হল নির্ধারিত টিকার ২ ডোজের দেয়া থাকতে হবে। দেশ থেকে রওনা হওয়ার ৭২ ঘণ্টা আগে করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ সার্টিফিকেট থাকতে হবে।
অপরদিকে সৌদি আরবের দুই পবিত্র নগরীতে অনুমতি প্রাপ্ত হোটেলগুলোর মধ্যে প্রতি কক্ষে ২ জন করে থাকা যাবে। জেদ্দা ও পবিত্র মদিনা বিমান বন্দর হতে যাতায়াতের সংখ্যা, মান অনুপাতে গাড়ির বুকিং থাকতে হবে। বিমান বন্দরে করোনা মুক্ত প্রমাণপত্র উপস্থাপন করতে হবে। এর অতিরিক্ত ইন্সুরেন্সসহ ভিসা সার্ভিস ত আছেই। সহযাত্রী হিসেবে এমদাদ উল্লাহ সাহেবসহ আমরা ২ জন ৩ অক্টোবর রবিবার চট্টগ্রাম থেকে জেদ্দা রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত দিই। আমরা ২ জনের সৌদি সরকারের অনুমোদন প্রাপ্ত ২ ডোজ টিকা দেয়া আছে। রওনা হওয়ার ৭২ ঘণ্টার মধ্যে করোনা পরীক্ষা করে নেগেটিভ হতে হবে। সে অনুপাতে শনিবার বিকেলে ২জন করোনা পরীক্ষা করাই। মহান আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে নেগেটিভ আসে। কিছুটা টেনশন মুক্ত হই। এদিকে মেয়র হজ্ব কাফেলার প্রধান ব্যক্তিত্ব সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন ও আল মুলতাজিম হজ্ব কাফেলার ফরিদ সাহেব পরামর্শ দিলেন জেদ্দা বিমান বন্দর থেকে সরাসরি পবিত্র মদিনায় যেতে। যেহেতু জেদ্দা পৌঁছে সৌদি সিম কার্ড তুলতে হয়। তথায় Tawakkalna এবং Eatmarna এ্যাপ ডাউনলোড করে অনুমতির ব্যবস্থা করতে হয়। এতে সময় লাগতে পারে।
শনিবার সন্ধ্যার মধ্যে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট ডাউনলোড করে নেয়া হয়। আল হেরার স্নেহের মোরশেদ শনিবার বাসায় এসে যাবতীয় কাগজপত্র দিয়ে যায়। বয়স হয়ে গেছে; দূরে থাকা কষ্টসাধ্য এবং কিছুটা আরাম অত্যাবশ্যক। এতে ২৪ দিনের প্যাকেজ বিমানের টিকেটসহ ২ জনে ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা।
আমরা ২ জন ৩ তারিখ রবিবার যোহরের পর বিমান বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হই। তথায় সাইদুল ও কমরুলসহ অনেকে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। বিমান বন্দরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষে কাউন্টার চোখে পড়ল। তাদেরও ভূমিকা দেখলাম। চট্টগ্রাম থেকে রওনা হওয়ার টাইমটা সুন্দর। মাগরিবের পর পরই রওনা। এ ফ্লাইটে ২০/২২ জন আমরা ওমরাহ যাত্রী। বিমান বন্দরে আমরা ৪ জন বাদে বাকীরা এহরাম পরিধান করে নিলেন। অর্থাৎ তারা জেদ্দা থেকে পবিত্র মক্কা যাবেন ওমরাহ করতে। আল হেরার আমরা ওমরাহ যাত্রীরা জেদ্দা থেকে সরাসরি পবিত্র মদিনা যাব। অতএব আমাদের এহরামের প্রয়োজন হচ্ছে না। মাগরিবের পর পর বিমানের যাত্রা। 787 Dreamliner Aircraft। বিজনেস ক্লাসে আমরা ৮ জন যাত্রী। কেবিন ক্রুদের আন্তরিকতা সম্মানের অভাব ছিল না। কিন্তু আতিথেয়তা মানের ধারে কাছেও নেই। বিমানের সব সময় শত হাজার কোটি টাকা লোকসান থাকে। বিমানের একমাত্র আয় যাত্রীদের মাধ্যমে। কিন্তু নানা অনিয়ম ও সেবায় সচ্ছতার অভাবে আজ বিমান লোকসানের ভারে ভারাক্রান্ত।
স্থানীয় সময় রাত ১০ টা ৩০ মিনিটের দিকে আমরা জেদ্দা বিমান বন্দরে অবতরণ করি। Aircraft থেকে বাসে যাত্রী নিল ১৫/২০ জন করে। বিমান বন্দরে ঢুকতে দ্রুততার সাথে আমাদের করোনা পরীক্ষা করল। অতঃপর অগ্রাধিকার দিয়ে ১ম কাউন্টারে PCR পরীক্ষা করে তথায় ঐ কাগজে সীল দিল। এরপর ইমিগ্রেশনে ডকুমেন্টগুলো উল্টায়ে পাসপোর্টে Arrival সীল দিয়ে দিল। এরপর লাগেজ নিয়ে আমরা এখানে টয়লেট সেরে এশারের নামাজ পড়ে নিই। বিমান বন্দর থেকে STC সিম কার্ড কিনে নিলাম। বিমান বন্দরের বাইরে আসতেই সৌদি ওমরাহ এজেন্ট আমরা ২ জনের একটি টেক্সী (কার) দিল। কারের সামনে আমরা ২ জনের নাম লিখা আছে। ওমরাহ যাত্রীর সংখ্যা ও ব্যয় অনুপাতে সৌদি ওমরাহ এজেন্ট ও পরিবহন কোম্পানী বাস অথবা মধ্যম আকৃতির গাড়ি অথবা ছোট আকৃতির টেক্সী (কার) প্রদান করে। বাংলাদেশী ৮/১০ জন যাত্রী পবিত্র মক্কা যেতে একটি কোস্টার টাইপের গাড়িতে উঠতেছে দেখলাম। আমাদের টেক্সীচালক ইয়েমেনী, আন্তরিক উদারপ্রাণ মনে হল। পেট্রোল পাম্পে গিয়ে তেল নিল খাবার কিনল। আমরা ২ জনকে কিছু না কিছু খাওয়াতে চায়। আমরা রাজি না হওয়ায় ২ বোতল পানি কিনে দিল। ৪ শ’ কি.মি পথ অতী দ্রুততার সাথে অতিক্রম করছে, যা ভয়ের ব্যাপার। এতে আমরা ২ জন কিছুটা আতংকিত ছিলাম। মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টা সময় নিয়ে শেষ রাতে আমাদেরকে পবিত্র মদিনায় বুকিং করা নির্ধারিত Shaza Hotel এ পৌঁছায়ে দেয়। রিসিপশনে গোল্ডেন হজ্ব কাফেলার মালিক ইদ্রিস সাহেবের প্রতিনিধি কাউসার আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়ায়। এখানে আমাদের ১৪ রাতের জন্য হোটেল কক্ষ বরাদ্ধ দেয়। হোটেল কর্তৃপক্ষ ৫ তারকামান দিতে মনে হয় সজাগ। কাউসার সাহেব আমাদের দু’জনের মোবাইলে Tawakkalna এ্যাপ ডাউনলোড করে দেয়। মসজিদে নববীতে পাঁচওয়াক্ত নামাজ পড়তে যেতে মোবাইলে Tawakkalna প্রদর্শন করা অত্যাবশ্যক। আগে জামাতের কোন কোন ওয়াক্তে আসবে সে অনুপাতে অনুমতি লাগত। এখন আর অনুমতি লাগবে না, মোবাইলে Tawakkalna প্রদর্শন করলে হবে। কাউসার সাহেব প্রথমবার ফজরের নামাজের অনেকক্ষণ আগে আমাদেরকে প্রথম বার মসজিদে নববীতে আসতে সহায়তা করলেন। মসজিদে নববীতে প্রায় ৪ ফুট দূরত্বে দূরত্বে দাগ দেয়া আছে। দাগ অনুপাতে নামাজীরা দাড়িয়ে যাচ্ছেন, নামাজ পড়তেছেন, বসতেছেন। বুঝা গেল নামাজিরা অনেকটা শৃংখলা রক্ষায় অভ্যস্ত।
তুর্কি হেরেম ব্লক করা আছে, ওখানে ইমাম সাহেব দাড়াবে। আবদুল আজিজ হেরেম ও ফাহাদ হেরেমে নামাজ পড়তেছে। হজ্ব ও রমজান তুলনা করলে হয়ত নামাজীর সংখ্যা ১০ ভাগের ১ ভাগ হবে। তবে এতে আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিতে প্রথমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দেড় দুই হাজার ওমরাহ যাত্রী হবে। বাকীরা প্রবাসী ও সৌদি মিলে ৪/৫ হাজর নামাজী মসজিদে নববীতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে মনে হচ্ছিল। (আগামীবারে সমাপ্ত)।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাউন্সিলর প্রার্থীরা কে কত ভোট পেলেন
পরবর্তী নিবন্ধচমেক হাসপাতালের টয়লেট থেকে নবজাতক উদ্ধার