জাদুকর

সুসেন কান্তি দাশ | বুধবার , ২৪ এপ্রিল, ২০২৪ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

দূরের দেশ থেকে জাদু শিখে ফিরেছে আমাদের মোহন। সেই ছোটকালে গেছে। ফিরে এসেছে নতুন বেশে। রঙবেরঙের ঝলমলে লম্বা পোশাক। সূর্যের আলো গিয়ে পড়লে জামার সংযুক্ত পাথর অদ্ভুৎ জ্যোতি বাড়িয়ে দেয়। রাতের কালোতে তারাদের মতো করে মিটি মিটি করে জ্বলে ওঠে। মোহনের মুখভর্তি দাড়ি, বেশ লম্বাটে চুল। তার চাহনী অতি কোমল। পাড়ার লোকে তাকে দলবেঁধে দেখতে আসে। যে যা চায় তাই লোকেদের দিয়ে যায়। এই উপহার দেয়ার বিষয়টিও বেশ মোহনীয়। কোনো এক শিশু এসে তার কাছে যদি বেলুন অথবা খেলনা চাইলো। অমনি মোহন শূন্যে হাত বাড়িয়ে মন্ত্র আওড়ে দেয়। অমনি আকাশ থেকে উড়ে আসে বেলুন, ঝরে পড়ে নানান খেলনাপাটি। এসব পেয়ে ছোটরা বেজায় খুশি।

সেদিন দূরের গ্রাম থেকে কয়েকজন অসহায় লোক এলো। তারা জানালোনিজেদের অভাবের কথা। কেউ বললো, ঘরে চাল নেই, ডাল নেই, কেউ বললো, ঘরে পরনের কাপড়চোপড় নেই। মোহন মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলে শূন্য থেকে ভেসে এলো রাশিরাশি খাবার আর দামি পোশাক। অসহায় লোকেরা সেসব কুড়িয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো।

দিকেদিকে রটে গেলো, জানান হলো মোহন জাদুকরের কথা। প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে লোকেরা আসে। মোহন জাদুকর সবার কথা শুনে। কাউকে উপহার দেয়ার পরিবর্তে যথাযথ পরামর্শউপদেশ দেয়। এতেও তারা খুব সন্তুষ্টি নিয়ে ফিরে যায়।

মোহন এই গাঁয়ের ছেলে। গাঁয়ের নাম রঙ্গপুর। লোকে বলে মোহনের বাবা ছিলেন একজন কৃষক। আগেরকার সময়ে গাঁয়ের লোকেরা খুব গরিব ছিলো। বাবা ছেলেকে দূরের দেশে পাঠিয়েছিলোউন্নত শিক্ষা অর্জন করতে। বাবার নাকি স্বপ্ন ছিলোমোহন ফিরে এসে দশেরদেশের উপকারে আসবে।

এখন মোহনের সময় কেটে যায় এগ্রামওগ্রাম ঘুরে ঘুরে। একদিন ঘুরতেঘুরতে মোহন জাদুকর এসে থামলো একটি নিচু এলাকায়। এখানে চাষের ফলন তেমন হয় না। লোকেরা জানায়, বর্ষাকালে বৃষ্টির জল জমে এই এলাকায় মাটি অতি নরম হয়ে ওঠে। যা ফসল উৎপাদনের বাধা হয়। এছাড়া ফসল না হওয়ায় এই এলাকার লোকেরা অনাহারে কাটায়। সব শুনে মোহনের মন খারাপ হয়ে গেলো। বিষণ্ন মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র আওড়াতে থাকে। লোকেরা বিস্ময়ভরা দৃষ্টি মেলে দেখলো আকাশ থেকে রাশি রাশি মাটি ভেসে আসছে। অনায়াসে নিচু এলাকা ভরে গেলো। নিচু এলাকার লোকেরা অবারিত আনন্দে ভরে ওঠে।

এভাবে যেখানে যতো সমস্যা নিয়ে যে আসে তার মুখে হাসি এনে দেয় এই জাদুকর। শুধু তাই নয়, কলাপাতার বাঁশিতে সুর তুলে, কখনো মিষ্টিসুরে গান গেয়ে মন জুড়িয়ে দেয়।

একদিন মোহন জাদুকরের বিশেষ নিমন্ত্রণে ভিড় জমায় রঙ্গপুর গ্রামে। এ গ্রামের লোক, সে গ্রামের লোক, হাজারহাজার মানুষের সমাবেশ হলো। মোহন ও তার লোকেরা মিলে সবাইকে অনেক মজাদার সব খাবার খাওয়ালো।

তখন বিকেল বেলা, খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে। সবাই এবার মোহন জাদুকরের কথা শোনার জন্য বসে আছে। মোহন বললোআমার জাদু ভালো মানুষের জন্য। যারা মানুষের উপকার করতে চায় তাদের জন্য। যারা কারো ক্ষতি করতে চায় তাদের জন্য আমার জাদু কাজ করবে না।

একটু থেমে মোহন বলেন, তোমরা যারা আমার জাদুশক্তিতে লাভবান হয়েছো, তারা অন্যের উপকার করো। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব করো না, ঝগড়া করো না। একথা বলতে না বলতেই জমায়েত হওয়া লোকেদের অনেকেই হাতাহাতিঝগড়াতে লিপ্ত হয়। মোহন জাদুকর এদের থামতে বলেও কোনো কাজ হলো না। এ সময় মোহন বাবু চোখ বন্ধ করে মন্ত্র আওড়ায়। অমনি চারিদিক হতে উড়ে আসে ফুলের পাঁপড়ি। অনেক সুগন্ধি মাখানো এতে। এমনভাবে ঝরেছে যেনো, কোনো বিশেষ অতিথিকে বরণের জন্য পুষ্প বৃষ্টি হচ্ছে। এ সময় কিছুটা বিবাদ কমে আসে। মোহন আবার বললোনাচো, গাও, আনন্দ করো, তার জাদুশক্তির এমন গুণ, মুহূর্তেই মিটে গেলো ঝগড়া। উপস্থিত সকলে লাফিয়েলাফিয়ে নাচতে থাকে, গলা ছেড়ে গাইতে থাকে। সবার মনপ্রাণ জুড়িয়ে একাকার হয়ে গেলো।

তখন শেষ বেলা। আকাশে সোনালী রোদের মেলা বসেছে। মেঘগুলি হেলেদুলে সবাইকে স্বাগত জানিয়ে যায়। মোহন এবার তোমাদের বাড়ি ফেরার পালা। তোমরা বাড়ি ফিরে যাও। যাবার বেলায় আবার সস্নেহে বুঝিয়ে বলেনআনন্দ সকল বেদনাকে ভুলিয়ে দিয়ে যায়। যেমন করে আবার জাদুতে দ্বন্দ্ব মিটে গেলো।

দেখতেদেখতে মোহনের জাদুশক্তি আর তার সৎ উদ্দেশ্যের কথা কারো অজানা রইল না। বিষয়টি কারোকারো ঈর্ষার কারণ হয়ে ওঠে। অনেকেই মোহন জাদুকরের কাছে জাদু শিখতে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু তার এককথা। জাদু শিখে তা ভালো কাজে লাগাতে হবে। প্রতিদিন অনেকেই আসে জাদু শিখতে।

এদের মধ্যে একজন খুব লোভী ও হিংস্র প্রকৃতির। সে নিজেকে ভালো মানুষের পরিচয় দিয়ে মোহনের কাছ থেকে জাদু শিখে যায়। মনে মনে জাদুশক্তির অপকৌশল খাটিয়ে গ্রামবাসীদের ক্ষতি করার বাসনা করে।

মোহন এর জাদু দিনে দিনে প্রসার ঘটায়। পাড়ার শিশুকিশোরদের মন ভালো করার জন্য সপ্তাহের একদিন আসর বসায়। বড় রাস্তার পাশে বটের তলায়। সময়টা বিকাল বেলা। একটি মন্ত্র আওড়িয়ে বাতাসে সুরের ঢেউ তুলে। অদেখা কোনো বাঁশীঅলা বাঁশিতে সুর তুলে, মায়াবী কোনো কণ্ঠ গান শোনায়। সে গানে সুর মেলায় সকলে।

এদিকে মোহনের কাছ থেকে জাদু শিখে অনেকেই তার মতো মানুষের উপকারে রত হয়। কিন্তু লোভী ও মানুষের ক্ষতি করতে চাওয়া লোকটি জাদুবলে নিজেকে ভয়ানক করে উপস্থাপন করতে জানে। কখনো সাপ হয়ে ফণা তুলে, কখনো বাঘের রূপ নিয়ে থাবা তুলে। বিষয়টি মোহন বুঝতে পেরে তাকে এরূপ না সাজার জন্য বলেন। মোহন জানায়খারাপ মনের লোকেরা খারাপ হয়ে বাঁচে, ভালো মনের মানুষগুলো মানুষের ভালো করে বাঁচে। তাই তাকে ভয়ংকর প্রাণী না সাজার উপদেশও দেয়। কিন্তু লোভী লোকটি মনে মনে এই ফন্দি আঁটেগ্রামের মানুষের সব সম্পদ, জমিজমা তার করে নেবে, জাদুবলে।

একদিন মোহন গেছে গ্রামের বাইরে শহরের কাছাকাছি। এই সুযোগে লোভী লোকটি নিজেকে ভয়ংকর একটি অজগর সাপে রূপান্তর করে। আর দংশন করার জন্য তেড়ে আসে। গ্রামবাসীরা বাঁচাও! বাঁচাও! আর্তনাদ করে ছুটোছুটি করতে থাকে। কেউ কেউ লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে। সাপটি অমনি তাকে ছোবল দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে গ্রামের লোকজন গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় সাপটি তার আগের রূপ ধারণ করে। এই ভেবে খুশি হয় যে, এখন থেকে রঙ্গপুর তার দখলে চলে যায়। কেউ তাকে দমাতে পারবে না। এমনকি মোহনের জাদুও এখানে চলবে না। কিন্তু মোহনের জাদুবিদ্যার গভীরতা সে আঁচ করতে চায়নি।

এর মধ্যে সব ঘটনা কেউ একজন গিয়ে পৌঁছে দিলো মোহন এর কানে। মোহন ফিরে আসে। পিছু পিছু ভয়ে ভয়ে আসে গ্রামবাসী। মোহন এদের অভয় দেয়। এ সময় লোভী জাদুকর পুনরায় সাপ হয়ে তাকে কামড়াতে আসে। সে ভেবেছে, এখন বুঝি মোহন ও ভয় পাবে। কিন্তু মোহন চোখ বন্ধ করে মন্ত্র আওড়াতে সাপটি কাঠের সাপে পরিণত হয়। এ সময় আবার অবারিত আনন্দে সবাই মেতে ওঠে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধবোশেখ এলো রঙ ছড়ালো