বিশ্বের ১২১তম এবং এশিয়ার প্রথম নারী লেখক হিসেবে এ–বছর সাহিত্যে নোবেল পেলেন দক্ষিণ কোরিয়ার কবি ও কথাসাহিত্যিক, সিউল ইনস্টিটিউট অফ আর্টসের ক্রিয়েটিভ রাইটিং বিভাগের সাবেক প্রফেসর হান কাং। এ স্বীকৃতির মূলে রয়েছে, তাঁর স্বকীয় গভীর ক্ষুরধার ও কাব্যময় গদ্য, যা ইতিহাসের যন্ত্রণাদগ্ধ ঘটনাকে উপজীব্য করে মানব জীবনের ভঙ্গুরতাকে উন্মোচিত করে, আলোর পাদপ্রদীপে নিয়ে আসে জীবনের নানা উত্থান–পতন, দুঃখ–বেদনার অনুভূতি, ঐতিহাসিক ট্রমা, অদৃশ্য অনুশাসন। তাঁর নিরীক্ষাধর্মী ও কাব্যময় লিখনশৈলী গদ্য সাহিত্যের ভাণ্ডারে এক অভূতপূর্ব ব্যতিক্রমী সংযোজন, যা তাঁকে সাফল্যের স্বর্ণ দুয়ারে পৌঁছে দেয়। এ প্রসঙ্গে নোবেল কমিটি জানান, “কাব্যের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে গদ্যের নতুন ধারার সূচনা ঘটিয়েছেন হান কাং। তাঁর কাজ বিভিন্ন ধরনের শৈলীকে একত্র করে নতুন কিছু তৈরি করেছে। এই কাজগুলো নৃশংসতা, শোক ও পিতৃতন্ত্রের মতো জটিল বিষয়গুলোকে সম্বোধন করে।” তাঁর লেখায় দেহের সাথে আত্মার, জীবিতের সাথে মৃতের সংযোগ নিয়ে এক ধরনের সচেতন বোধ বিচ্ছুরিত হতে দেখা যায়, যা সুনির্দিষ্ট গণ্ডি বা ছকে বাঁধা যায় না। তাঁর গদ্য সাহিত্যে ‘ক্রিয়েটিভ ইমাজিনেশন’ এতটাই প্রখর যে, নোবেল কমিটির বিচারকরা তা এড়িয়ে যেতে পারেননি। ফলতঃ বিগত এক দশক ধরে নোবেল জয়ের তালিকায় থাকা তার দেশের ৯১ বছর বয়সী কবি কো উন’সহ বিশ্বের তাবৎ বাঘা বাঘা সাহিত্যিককে পিছনে ফেলে সাহিত্যে নোবেল নামের সোনার ট্রফি ছিনিয়ে নেন ৫৩ বছর বয়সী এই হ্যান কাং।
হান কাং–য়ের জন্ম ১৯৭০ সালের ২৭ জুন দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজু শহরের এক সাহিত্যিক পরিবারে। তাঁর বাবা হান সিউঙ ওন দক্ষিণ কোরিয়ার একজন খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক। তাঁর বড়ভাই হ্যান ডং রিম ও ছোট ভাই হান কিম ইনও লেখক। তাঁর বয়স যখন সবেমাত্র ৯, তখন তাঁর পুরো পরিবার রাজধানী সিউলে চলে যায়। এখানেই পিতা ও ভাইদের উৎসাহ– অনুপ্রেরণায় বই পড়ে পড়ে হান–এর বেড়ে ওঠা। লেখক পরিবারে আশৈশব লালিত হওয়ার সুবাদে সঙ্গত কারণেই পারিবারিক আবহের মাঝেই তাঁর মাঝে এক সৃষ্টিশীল লেখক সত্তা অঙ্কুরিত ও বিকশিত হয়, যা তাঁকে সাহিত্যিক হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করে।
কোরীয় সাহিত্য নিয়ে ইয়োনসেই ভার্সিটি থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী হান কাং–য়ের সাহিত্যিক হিসেবে প্রথম অভিষেক ঘটে ১৯৯৩ সালে দক্ষিণ কোরিয় সাময়িকী ‘লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি’তে ৫টি গুচ্ছ কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। এরপর ১৯৯৪ সালে তিনি ‘রেড অ্যাঙ্কর’ নামে একটা ছোট গল্পের মাধ্যমে ডেইলি সিউল শিনম্যান সাহিত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার বিজয়ী হয়ে সবার নজর কাড়েন। ১৯৯৫ সালে কারলেকেন টু ইয়েসু (ইয়েসুর প্রেম) নামে তার একটা ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। এটি প্রকাশের পর পরই তিনি জিতে নেন হ্যানকুক সেরা লিখিয়ে পুরস্কার। মূলতঃ এটির মাধ্যমে তাঁর গদ্য একত্রিত অবস্থায় প্রথম পাঠকের সামনে আসে। পরবর্তীতে তিনি উপন্যাস লেখায় হাত দেন এবং বছর তিনেকের মধ্যে লিখে ফেলেন জীবনের প্রথম উপন্যাস ব্ল্যাক ডিয়ার। ১৯৯৮ সালে এটি প্রকাশিত হলে ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা লক্ষ করে তিনি নিজেকে লেখালেখিতে পরিপূর্ণভাবে সমর্পনের সিদ্ধান্ত নেন এবং গল্প, গদ্য নোবেল– নোবেলা লেখায় মনোযোগী হন। এরপর একে একে বেরুতে থাকে তাঁর অসাধারণ সব সৃষ্টিকর্ম। হান কাং–য়ের এ পর্যন্ত ৮টি উপন্যাস, ৫টি উপন্যাসিকা, ১টি কাব্যগ্রন্থ ও ২টি প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।
হান কাং–য়ের শৈশবে সংগঠিত ১৯৮০ সালের গোয়াংজু বিদ্রোহ তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করেছিল, যা তিনি তাঁর অসাধারণ উপন্যাস Human Acts এ উপস্থাপন করেন। হিউম্যান অ্যাক্টস উপন্যাসে হান কাং লিখেন, ‘মৌলিকভাবে মানুষ কি সত্যিই নিষ্ঠুর ? প্রজাতি হিসেবে নিষ্ঠুরতাই কি একমাত্র অভিজ্ঞতা, যা আমাদের মিলিয়ে দেয়। যে মর্যাদা আঁকড়ে পড়ে থাকি আমরা, তা আত্মবিভ্রম ব্যতীত কিছু নয়! একটা মুখোশ, যা আমাদের একমাত্র সত্য থেকে দূরে রাখে, যে আমরা প্রত্যেকেই পতঙ্গ, হিংস্র জন্তু, মাংশের পিণ্ডে পরিণত হতে পারি যে কোনও মুহূর্তে। অধঃপতন, নিধন–মানবজাতির জন্য কি অপরিহার্য, ইতিহাস কি একে অনিবার্য বলে চিহ্নিত করেছে।” হান কাং–য়ের Your Cold Hands (২০০২) একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। এ উপন্যাসে তিনি মানবদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে দ্বন্দ্বের চিত্র তুলে ধরেন।
হান কাং–এর লেখালেখির বড় সাফল্য আসে তার ‘দ্য ভেজিটারিয়ান্থ উপন্যাসটি প্রকাশের পর। এটি একটি মাস্টার পিস। এটির কেন্দ্রীয় ও নারী চরিত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা অন্যান্য চরিত্রের পটভূমি এবং গাছপালা ও সূর্যকিরণের চিত্রকল্পের আবহ তৈরির জন্য তিনি অনেক ভাবনাচিন্তা ও পর্যবেক্ষণ করে মাসের পর মাস খেটে উপন্যাসটি সমৃদ্ধ করেন। পশ্চিমে এটির ইংরেজি ভার্সন প্রকাশের পরপরই হান কাং–য়ের ভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। বইটি আরও ১৩ ভাষায় অনূদিত হয়। লেখক হিসেবে পাল্টে যায় তাঁর জীবন। ইংরেজি অনুবাদের পর ২০১৬ সালে এ–উপন্যাসের জন্যে তিনি ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার জিতে নেন । এ গ্রন্থটিই চলিত অক্টোবরে তাঁকে পাইয়ে দেয় ‘নোবেল প্রাইজ’ নামের হীরক খন্ড। এটি নিয়ে ২০০৯ সালে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়। তিন পর্বে লেখা এ–উপন্যাসটিতে ইয়ং হাই নামের এক নারীর নিরামিষাশী হয়ে ওঠার গল্প তুলে আনা হয়েছে, যিনি মাংস খেতে অস্বীকৃতি জানানোর পর তাঁর স্বামী, কর্তৃত্ববাদী বাবা এবং অন্যান্যদের দ্বারা নিগ্রহের শিকার হয়ে নিষ্ঠুরতার আতঙ্ক নিয়ে ‘বৃক্ষের মতো’ বেঁচে থাকার প্রচেষ্ঠা চালান। তাঁর উদ্ভিদময় সেই রাজ্য একদিকে যেমন আকর্ষণীয়, অন্যদিকে তেমনই বিপজ্জনকও।
বন্ধুত্ব ও শিল্পকলাকে উচ্চকিত করে লেখা হান কাং–য়ের The Wind Blows, go (২০১০) উপন্যাসটিও বেশ আলোচিত। এতে দুঃখ ও রুপান্তরের আকাঙ্ক্ষা যেন একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। ২০১১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর Greek Lessons উপন্যাস। এতে বাকশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি হারানো যন্ত্রণাদগ্ধ দুই নরনারীর নিবিড় নৈকট্যের মনোমুগ্ধকর সম্পর্কের বর্ণনা বিধৃত হয়। তাঁরা ছিল বিচ্ছিন্ন, কিন্তু ঘটনা পরম্পরা তাদের একত্রিত করে। তখন তারা বুঝতে পারে, পৃথিবীতে কেবল তারাই একমাত্র যন্ত্রণাদগ্ধ নয়। ২০২৩ সালে তাঁর এ–বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
তাঁর ২০১৬ সালে প্রকাশিত The White Book একটি আত্নজৈবনিক গদ্য কবিতার সংকলন। এতে তাঁর ৬৪টি কবিতার মাধ্যমে জন্মের পর দু’ঘন্টা বেঁচে থাকা সদ্যমৃত সাদা কাফনে জড়ানো বোনের স্মৃতিকাতরতা উদ্ভুত নিজের মাঝে জমে থাকা গভীর বোধের আলোকে জীবন ও মৃত্যুকে রং ও রূপের প্রিজমে প্রতিফলিত করেছেন অস্তিত্বের গভীর ধ্যানে। তাঁর এই অসাধারণ গ্রন্থটি ২০১৭ সালে ডেবোরা স্মিথ ইংরেজি অনুবাদ করার পর ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো তিনি জিতে নেন ম্যানবুকার প্রাইজ।
হান কাং–য়ের কাছে লেখালেখি দৈনিক সাধনার বিষয়। এজন্য তিনি প্রতদিন লেখালেখি করেন এবং বিশ্বাস করেন, তিনি গন্তব্যের নিকটবর্তী হচ্ছেন।
তাঁর সাহিত্যচর্চা শৈল চিকিৎসকের এমন এক নির্ভুল ‘অস্ত্রোপচার’, যেখানে মানবিক আত্মাকে ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে এর অনুষঙ্গগুলির চারপাশে সূক্ষ্ম সূতোর আখ্যান বোনা হয়; যা বেদনা, ক্ষত, আকাঙ্ক্ষা ও মুক্তির থিমকে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করে। তাঁর সাহিত্য যেন, রাত্রির গভীরতা শেষে বালার্কেও তীর্যক রশ্মি, যা দিবালোকের আগাম জানান দেয়। এমন এক সাহিত্যিককে নোবেল পুরস্কার দিয়ে নোবেল কমিটি প্রান্তিক কণ্ঠস্বরকেই উচ্চকিত করলেন।