শহরের কোনো মোড়েই জেব্রা ক্রসিং নেই, নেই ফুটওভার ব্রিজ। বেশ কয়েকটি মোড়ে যান চলাচলের সুবিধায় স্থাপন করা হয়েছে ব্যারিয়ার। ঘুরতি পথে চলছে গাড়ি। কিন্তু পথচারী পারাপারের কোনো ব্যবস্থা না থাকায় হাজার হাজার মানুষ জীবন হাতে নিয়ে রাস্তা পার হয়। নগরীর ট্রাফিক সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে গিয়ে লাখ লাখ পথচারীর জীবন হুমকির মুখে ফেলে দেয়া হয়েছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। অবশ্য নগর পুলিশ বিষয়টি অস্বীকার করে সিস্টেম অনুসরণের জন্য নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, নগরীতে যান চলাচল প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিদিনই সড়কে নামছে নতুন নতুন গাড়ি। একই সাথে বাড়ছে মানুষও। নগরীতে ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ বসবাস করছে। নগরীর ধারেকাছের উপজেলাসহ বিস্তৃত এলাকা থেকে প্রতিদিন কয়েক লাখ মানুষ নানা কাজে নগরীতে আসা যাওয়া করে। বিপুল সংখ্যক মানুষের চলাচলের জন্য এই শহরে রাস্তার সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বিশ্বমানের একটি শহরে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ রাস্তা থাকতে হয়। চট্টগ্রামে যার পরিমাণ ১০ শতাংশের বেশি নয়। এতে করে নগরীর রাস্তাগুলোতে হরদম বিশৃঙ্খখলা লেগে থাকে।
চট্টগ্রামে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শাহ আমানত সেতু কিংবা কালুরঘাট পর্যন্ত রাস্তাটিই মূলত প্রধান সড়ক। এর বাইরে অলংকার মোড় থেকে ট্রাংক রোড, বারিক বিল্ডিং মোড় থেকে স্ট্যান্ড রোড, কাপাসগোলা রোড, পোর্ট কানেক্টিং রোড, বায়েজিদ বোস্তামী রোডসহ ৫১৭টি পিচঢালা রাস্তা রয়েছে। নগরীতে সর্বমোট এগারশ’ কিলোমিটারের মতো রাস্তা রয়েছে। তবে এর মধ্যে পতেঙ্গা থেকে কালুরঘাট কিংবা শাহ আমানত সেতু পর্যন্ত প্রধান সড়কটিতেই মানুষ এবং যানবাহনের ভিড় লেগে থাকে। নগরীতে সর্বমোট ১৩৫টি ক্রসিং রয়েছে। এর মধ্যে চৌরাস্তার মোড় রয়েছে ৯৭টি এবং তিন রাস্তার মোড় রয়েছে ৩৮টি। নগরীর প্রতিটি মোড়ে যানবাহনের চাপে বিশৃংখল অবস্থা বিরাজ করে। কয়েকটি মোড়ের অবস্থা খুবই শোচনীয়। বিশেষ করে এশিয়ান হাইওয়ে খ্যাত শহরের প্রধান সড়কটির কয়েকটি মোড়ে জীবন হাতে নিয়ে পারাপার করে মানুষ।
নগরীর প্রতিটি মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল এবং মানুষ পারাপারের জেব্রা ক্রসিং থাকার কথা থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ কোনো মোড়েই কোনো জেব্রা ক্রসিং নেই। পুরো নগরীতে শুধুমাত্র প্রবর্তক মোড়ের একপাশে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে একটি জেব্রা ক্রসিং আঁকা রয়েছে। তবে সিগন্যাল কার্যকর না থাকায় সেটি কখনো ব্যবহার হতে দেখা যায় না। নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোর মধ্যে জিইসি মোড়, ইস্পাহানি মোড়, বাদামতলী মোড়, চৌমুহনী মোড়, ওয়াসা মোড়, ষোলশহর দুই নম্বর গেট মোড়, মুরাদপুর মোড়, ওমেন কলেজ মোড়, বহদ্দারহাট মোড়, অলংকার মোড়, এ কে খান মোড়ের মতো জায়গায় কোনো জেব্রা ক্রসিং নেই, নেই পথচারী পারাপারের কোনো ব্যবস্থা। যানবাহনের ফাঁকফোকর গলিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পথ চলতে হয় পথচারীকে। প্রতিদিনই বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে নানা অঘটন ঘটে, ঘটে ছোটখাটো দুর্ঘটনা।
বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পথচারীদের জন্য নতুন আপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে নতুন ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। নগরীর লালখান বাজার মোড়, জিইসি মোড়সহ কয়েকটি জায়গায় মূল মোড় বন্ধ করে ব্যারিয়ার দেয়া হয়েছে। যানবাহন চলাচলের জন্য ঘুরপথ তৈরি করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু এই ঘুরপথে প্রয়োজনীয় ট্রাফিক সিগন্যাল কার্যকর না থাকায় মানুষের ভোগান্তি এবং ঝুঁকি চরম আকার ধারণ করেছে। প্রথমতঃ মানুষ মূল মোড় দিয়ে রাস্তা পারাপার হতে চায়, ঘুরপথে যেতে চায় না। আবার ঘুরপথে গেলেও গাড়ি থামিয়ে পথচারী পারাপারের কোনো সিগন্যাল কার্যকর না থাকায় চলন্ত গাড়ি থামিয়ে পথচারীর পারাপার চলে। এতে ট্রাফিক পুলিশ কিছুটা রিল্যাঙে থাকলেও পথচারী পারাপার এবং যানবাহন চলাচলে সমস্যা প্রকট হয়ে উঠেছে। জেব্রা ক্রসিং সিস্টেম কার্যকর করা হলে শুধু মানুষের ঝুঁকিই কমে আসবে না, যানবাহন চলাচলেও গতিশীলতা তৈরি হবে।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল একাধিক পথচারী দৈনিক আজাদীকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নগরীর সবচেয়ে ব্যস্ত মোড়গুলোর মধ্যে জিইসি মোড়, ওয়াসা মোড়, লালখান বাজার, মুরাদপুর মোড়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে রাস্তা পারাপারের সময় অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বৃদ্ধ, নারী এবং শিশুদের ভোগান্তি চরমে উঠে। একটি গাড়িও থামতে চায় না, কার্যকর কোনো ট্রাফিক সিগন্যালও নেই। তীব্র প্রতিযোগিতায় নামা বাসসহ বিভিন্ন ধরণের চলন্ত যানবাহনের ভিতর দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার হতে হয়। বিষয়টিকে অত্যন্ত জরুরিভিত্তিতে দেখার জন্য তারা সিটি মেয়র এবং নগর পুলিশ কমিশনারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এই ব্যাপারে নগর ট্রাফিক পুলিশের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নগরীর প্রতিটি মোড়েই পুলিশ কাজ করে। যান চলাচলের সুবিধার জন্য কিছু মোড়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। যা মানুষের প্রয়োজনেই করা হয়েছে। এর সুফলও মিলছে। কিন্তু পথচারীরা ঘুরপথে না যাওয়ায় কিছুটা সমস্যা পরিলক্ষিত হচ্ছে। তিনি পথচারীদের নির্দিষ্ট পথ অনুসরণ করে রাস্তা পারাপারের আহ্বান জানান।
সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, নগরীর প্রতিটি মোড়েই মানুষের সমস্যা হচ্ছে। আমরা অনেকগুলো ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ করবো। আমাদের প্রকল্পটি ইতোমধ্যে অনুমোদন পেয়েছে। মোড়ে মোড়ে ফুটওভারব্রিজ নির্মাণ সম্পন্ন হলে মানুষের ভোগান্তি কমে যাবে বলেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।