গিয়ারভী শরীফ একটি বরকতময় আমল
পবিত্র কুরআনের আলোকে গিয়ারভী শরীফ: গিয়ারভী শরীফ প্রকৃতপক্ষে মনগড়া ভিত্তিহীন কোন আবিষ্কার নয়; বরং কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য প্রমাণাদি হচ্ছে এর বৈধতার সুদৃঢ় ভিত্তি। মহান ওলী হযরত মাহবূবে সোবহানি শায়খ আবদুল ক্বাদের জীলানী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র রুহ মুবারকে সওয়াব পৌঁছানার শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি হলো গিয়ারভী শরীফ। ঈসালে সাওয়াবের বৈধতা কুরআন, হাদীস ও বুযুর্গানে দ্বীনের নির্ভরযোগ্য কিতাবে অসংখ্য বর্ণনার আলোকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। নিম্নে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দলিল পেশ করা হল:- আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন,
“যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে, “হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এবং ঈমানে আমাদের অগ্রণী ভ্রাতাদের ক্ষমা কর।” (আল কুরআন, ৫৯:১০)। পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে, “যারা আরশ বহন করে আছে এবং যারা এর চতুর্পাশে ঘিরে আছে তারা তাদের প্রতিপালকের পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে প্রশংসার সাথে এবং তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মু’মিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে হে আমাদের প্রতিপালক, তোমার দয়া ও গুণ সর্বব্যাপী। অতএব, যারা তাওবা করে ও তোমার পথ অবলম্বন করে তুমি তাদেরকে ক্ষমা করো এবং তাদেরকে দোযখের শাস্তি থেকে রক্ষা করে নাও।” ( আল কুরআন, ৪০:০৭)। পবিত্র কুরআনের উল্লেখিত দু’টি আয়াত দ্বারা পরবর্তী ও পূর্ববর্তীদের পরকালীন মঙ্গল ও কল্যাণার্থে উত্তম আমল, কুরআন খানি, ফাতেহাখানি ও ঈসালে ছওয়াব ইত্যাদি বরকতময় আমল করা শরীয়ত সম্মত।
হাদীস শরীফের আলোকে গিয়ারভী শরীফ: মৃত ব্যক্তির প্রতি ইসালে সাওয়াব এর বৈধতা প্রমাণে হাদীস শরীফে অসংখ্য প্রমাণ বিদ্যমান রয়েছে। নিম্নে দু’টি উদ্ধৃতি পেশ করা হল-
এক. হযরত আবূ উসাইদ যায়েদী রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বসা ছিলাম, বনী-সালমা গোত্রের এক ব্যক্তি এসে আরয করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্, আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর পরও কি তাদের প্রতি সদাচরণ করার মত কোন পথ অবশিষ্ট আছে? অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় তো আমার মাতা-পিতার খিদমত ও সদাচরণ করেছি তাদের মৃত্যুর পরও কি এমন পন্থা আছে যে, তাঁদের সাথে সদাচরণ করব? হুযূর বললেন, “হ্যাঁ” আছে, তাদের জন্য দো’আ করা, তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা, তাদের মৃত্যুর পর তাদের অপূর্ণ ওয়াদা পূর্ণ করা, তাদের আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করা, তাদের বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।
দুই. একদা প্রিয় রসুল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর মহান দরবারে আরয করা হল, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমরা আমাদের মৃতদের পক্ষ থেকে সদক্বা ও হজ্ব আদায় করছি এসব কি তাদের নিকট পৌছবে? প্রিয় রসূল এরশাদ করেন, “হ্যাঁ নিশ্চয় সে সব আমলে তারা খুশী হয়, যেমনিভাবে তোমরা পরস্পরকে উপটোকন প্রদান করলে খুশী হয়ে থাক। ( ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী, তাযকিরাতুল মাওতা ও শরহুস সুদূর)।
গিয়ারভী শরীফ, বৈধতা প্রমাণে মুসলিম মনীষীদের অভিমত: এক. মহাগ্রন্থ আল কুরআনে উল্লেখিত “ওয়ামা ওহিল্লা বিহী লেগায়রিল্লাহ” আয়াতের ব্যাখ্যায় বাদশাহ আওরঙ্গজেব আলমগীর’র শিক্ষক মোল্লা আহমদ জিওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি প্রণীত ‘তাফসীরাত-ই আহমদিয়া’ কিতাবে বলেন, আল্লাহ ছাড়া কারো নামে যদি পশু যবেহ করা হয় যেমন কাফেরগণ তাদের প্রতিমার নামে উৎসর্গ করে থাকে তা হারাম। তবে যদি ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে পশু জবেহের পূর্বে বা পরে আল্লহ ব্যতীত অন্য কারো নাম উল্লেখ করতে কোন দোষ নেই। যেমন হেদায়া কিতাবে উল্লেখ আছে। এতে প্রতীয়মান হলো- আউলিয়া কেরামের ইসালে সাওয়াবের জন্য যে গরু, ছাগল হালাল জন্তু মান্নত করা হয় যেমন আমাদের দেশের মুসলমানগণ এ ধরনের মান্নত করে থাকেন তা ভক্ষণ করা হালাল ও পবিত্র। কারণ যবেহের সময় এ ক্ষেত্রে গায়রুল্লাহর নাম নেয়া হয়নি। ( মোল্লা জিওন, তাফসীরাতে আহমদিয়া, পৃ: ২৯)
দুই. হযরত শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ও হযরত মোল্লা জিওন রাহমাতুল্লাহি আলায়হি’র অনুরূপ কুরআনুল করীমের উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, যবেহকালে যদি আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্য কারো নাম নেয়া হয় তা হারাম হবে। ( মোল্লা জিওন, তাফসীরাতে আহমদিয়া, পৃ: ২০৬)
তিনি আরো বর্ণনা করেন যে, হযরত মির্যা মাজহার জানে জাঁনা রাহমাতুল্লাহি আলায়হি এরশাদ করেন যে, একদা আমি আউলিয়া কেরামের একদলকে ধ্যানমগ্ন মোরাক্বাবারত অবস্থায় একটি উচুস্থানে উপবিষ্ট দেখলাম। মাঝখানে হযরত খাজা নক্শবন্দ দোজানু অবস্থায় এবং হযরত জোনাইদ বাগদাদী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ঠেঁস দিয়ে বসে আছেন। অত:পর তাঁরা সবাই চলতে লাগলেন আমি তাঁদেরকে কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। একজন উত্তর দিলেন হযরত আলী মুরতাদ্বা রাদ্বিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে অভিবাদন জানানোর জন্য অগ্রসর হচ্ছেন। এদের সাথে আমি হযরত ওয়াইসুল করণী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিকেও দেখলাম। অত:পর একটি কক্ষ প্রত্যক্ষ করলাম, যেখানে নূরের বৃষ্টি বর্ষিত হচ্ছে। সমস্ত আউলিয়ায়ে কেরাম ঐ গৃহে প্রবেশ করতে শুরু করলেন, আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে একজন উত্তর দিলেন ‘ইমরোজ ওরসে হযরত গাউসুস সাকালাইন আস্ত, বতক্বরীবে ওরস তাশরীফ বরন্দ’ অর্থাৎ আজকে গাউসুল আযমের ওরস মুবারকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে যাচ্ছে। (কালেমাতে তৈয়্যবাত (ফার্সী), পৃ: ৮৭)
তিন. শাহ আবদুল আযীয দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, আমার পিতা শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বাগদাদ শরীফে সরকারীভাবে গিয়ারভী শরীফ উদযাপনের কথা অধিক গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করেছেন। গাউসে পাকের রওযা শরীফে মাসের এগার তারিখে দেশের বাদশাহ, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ও মন্ত্রীবর্গ উপস্থিত হতেন, আসরের নামাযের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত কুরআন তিলাওয়াত, ক্বসীদা পাঠ ও জীবনী আলোচনা করা হতো। এতে এক ধরণের ধ্যানমগ্নতা ও ব্যাকুলতা সৃষ্টি হতো। অত:পর খাদ্য-দ্রব্য তাবাররুক, শিরনী বিতরণ করা হতো। এশার নামায আদায়ের পর লোকজন বিদায় গ্রহণ করতো। ( শাহ আবদুল আজিজ দেহলভী, মালফুজাতে আজিজি (ফার্সী), পৃ: ৬২)
চার. হযরত শায়খ আবদুল হক্ব মুহাদ্দিস দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলেন, ইমামে আরেফ শায়খে কামিল আবদুল ওহাব গিয়ারভী শরীফ নিয়মিত উদযাপন করতেন। মূলত: গিয়ারভী শরীফ আমাদের শহরসমূহে প্রসিদ্ধ এবং আমাদের মাশায়েখ হযরাতের মধ্যে পরিচিত। কতেক পরবর্তী ওলামায়ে কেরাম বলেন, আউলিয়ায়ে কেরামের ওফাতের দিন কল্যাণ, মর্যাদা ঈমানী আলো ও বরকত লাভের প্রত্যাশায় অন্য দিন সমূহের তুলনায় অধিক হয়ে থাকে। গিয়ারভী শরীফ, ফাতেহা খানি ও ইসালে সাওয়াবের ব্যবস্থাপনা অতীব গুরুত্ব ও যত্ন সহকারে আয়োজন করা হয়। (শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভী, মা-সাবাতা বিস সুন্নাহ, পৃ: ১২৪)
শাহজাদা দারশিকো, ‘সফীনাতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে হযরত শাহ আবদুল মায়ালী ‘তোহফায়ে ক্বাদেরিা’ গ্রন্থে এবং মুফতি গোলাম সরওয়ার লাহোরী, ‘খজীনাতুল আসফিয়া’ গ্রন্থে গিয়ারভী শরীফের বরকতময় অনুষ্ঠানকে পূণ্যময় আমল বলে অভিমত ব্যক্ত করেন।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে আউলিয়ায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তাওফিক নসীব করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।
মুহাম্মদ রবিউল হোসেন নিজামী
বুড়িশ্চর, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।