মুখ্য, শ্রেষ্ঠ, পরা অর্থে কবিতার ভাষা তো পরম ভাষাই । সুকঠোর সাধনায় এ-পরাভাষা অধিগত হয়। কোনো সুস্থ, স্বজ্ঞান, সংবেদসম্পন্ন মানবাত্মা এই পরাভাষার সংক্রাম এড়াতে সক্ষম নয়। ধর্মগ্রন্থগুলো এ-সংক্রাম ধারণ করে, কারণ, ধর্মগ্রন্থগুলো পরাভাষার অধীন। মহাকাব্যগুলোর অধিকাংশই পরাভাষায় পরিবৃত। কবি, সাধু-সন্ত ও সুফি দরবেশগণ অনায়াসে এ ভাষার মহাসাগরে নিত্য স্নাত ও পরিস্রুত। তাই তাঁদের বচন ও রচনাসমূহ ‘অমৃতসমান’ বলে প্রতিভাত হয়। এ পরাভাষায় সংক্রামিতেরা অনেকে কবি না-হলেও কাব্যময় সত্তার অধিকারী হন। কাব্যপ্রেমী ও কবি পরাভাষার দুর্নিবার সংক্রামে অভিন্ন যুগ্মসত্তা। অন্যবিধ বিষয়গত আপাত বৈপরিত্য সত্ত্বেও একে অপরকে তাঁরা সমঝে চলেন। চেতনার দগ্ধতা ও ভাষার ঋদ্ধতা পরা-আবহ নির্মাণ করে বলেই মানুষ কবিতায় প্রণতি মানে। বিগ্রহের বেদিতলে অর্ঘ্য দিতে পুজারি যদি প্রাণিত ও প্রতপ্ত না-হয়, তাহলে কিসের দেবতা তিনি? ওই যুগ্ম আত্মায় সাম্য মেনেই ভাসছে কবিতাবিষয়ের এই বিশ্বভবতরী।
এই গদ্যের বিষয়-সম্ভার গত বিশ শতকের ১৯৭১ সাল থেকে একবিংশ শতকের ২০০১ সালের পরিধিভুক্ত। তবে অনিবার্য প্রাসঙ্গিকতার খাতিরে পরবর্তী বা পূর্ববর্তী দশকের ছিটেফোঁটা আলোচনাও এখানে যুক্ত হয়ে যেতে পারে। উল্লিখিত তিন দশকের সময়টা বাংলাদেশের ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক সকল দিক থেকেই। আমরা এ কালখণ্ডের একটি অতিক্ষুদ্র অথচ অতীব গুরুত্বমণ্ডিত মননগত ঝোঁক কবিতাচর্চার দিকটির কিয়দংশ স্পর্শ করতে ব্রতী হয়েছি। এখানে চট্টগ্রামকে বেছে নেবার যুক্তি হলো এই যে, বাংলাদেশের এই বড় নগর এবং এর লাগোয়া শহরগুলোতে বসবাসরত মানুষেরা তাঁদের ঐতিহ্যগত জীবনযাপনের সমতালে চিৎবৃত্তির ভীষণ সূক্ষ্মতম প্রকাশ কবিতা ও গানেও বেশ দর্শনীয়ভাবেই মনোনিবেশী ছিলেন যুগে-যুগে।
স্মরণ করা যাক, মনীষী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩) আমৃত্যু নিরলসভাবে এই বৃহৎ অঞ্চল থেকে যে-পুঁথিসম্ভার সংগ্রহ করেন, তার অধিকাংশই ছিল মুসলিম কবিদের। পাশাপাশি হিন্দু কবিদের রচিত কাব্যও তিনি বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে উদ্ধার করেন। মুসলিম কবিদের পুঁথিগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হিন্দু কবিদের পুঁথিসমূহ রাজশাহীর বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরে দান করে যান। নিভৃত সাহিত্যচর্চার সমতালে কবিতাপাঠ ও গানের আসর আয়োজন, গল্প ও ছড়া বলা, ছোটো-ছোটো কবিতাকেন্দ্রিক পত্রপত্রিকার প্রকাশ- এসব একক ও যূথবদ্ধ পদচারণা এই নগরের বনেদি সংস্কৃতির অচ্ছেদ্য অংশ। বাংলা সাহিত্যের প্রথাগত কালিক বিচার প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিককালের ইতিহাসেও এ অঞ্চলের প্রতিভান্বিত সন্তানদের সাহিত্য তথা কাব্যকলাচর্চার কথা ব্যাপক আকারে লিপিবদ্ধ আছে। সেই ইতিহাস মনে রেখেই খুব নিকট অতীতের আলোকে এই রচনাটির পরিকল্পনা।
দুই
বিশ্বকবিতাপ্রবাহ থেকে বাংলাদেশের কবিতা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। সাম্প্রতিক কালের গ্রামবিশ্ব বা গ্লোবাল ভিলেজের ধারণার মধ্যেও একই প্রকারের সত্যতার আভাস খুঁজে পাওয়া যায়। ঠিক একইভাবে বাংলা কবিতার মূলপ্রবাহ থেকে বৃহত্তর চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণকারী বা বসবাসকারী কবিদের কাব্যকৃতিও আলাদা কিছু নয়। এখানকার কবিদের প্রধানাংশ আঞ্চলিক বা উপভাষায় কবিতাচর্চা করেন না। এ-ভাষা সর্বজনীন বাংলাভাষাই। বিপরীতে পার্বত্য তিন জেলা রাঙামাটি বান্দরবান খাগড়াছড়ির চাকমা মারমা ত্রিপুরা তঞ্চঙ্গ্যা খুমি চাক বা অন্য ক্ষুদ্রজাতিগোষ্ঠীগুলোর কবি-সাহিত্যিকেরা তাঁদের মাতৃভাষা তথা আঞ্চলিক বা উপভাষায় কাব্যচর্চায় সবিশেষ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আলোচনার সুবিধার্থে বৃহত্তর চট্টগ্রামের (চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য ও কক্সবাজার জেলা) কবি ও তাঁদের কাব্যকৃতি বিষয়ে এখানে কিছু পর্যবেক্ষণ, মন্তব্য ও ধারণা ব্যক্ত করা হলেও তা সর্বতোভাবে আঞ্চলিকতার গণ্ডিতে বিচার্য নয়।
পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক সময়ে বিভিন্ন অভ্যুদয়িক আন্দোলন-সংগ্রামের অনিবার্য ফলস্বরূপ বাংলাদেশ নামের যে-রাষ্ট্রটি ঊনিশ শো একাত্তর সালে বিশ্বমানচিত্রে তার স্বাধীন অবস্থান নির্দিষ্ট করে, কালপ্রবাহের হিশেবে সেটি ছিল বিগত শতকের সত্তর দশকের সূচনাপর্ব। সেদিক থেকে বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যেরও একটি অন্যরকম নতুন অবয়ব ও নবীন উদ্দীপনা খুব স্বাভাবিক কারণেই এখানে পরিসর নিয়ে গড়ে উঠতে থাকে তখন থেকেই। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে ঔপনিবেশিক পুলিশের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে মাহবুব-উল আলম কর্তৃক ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ এখানেই রচিত, মুদ্রিত ও জনসমাবেশে পাঠ করা হয়। ৫০-এর দশকে রচিত এটিই মহান একুশের স্মরণে প্রথম কবিতা।
কাব্যচর্চার ধারাবাহিকতায় পূর্ববর্তী ষাটের দশকবাহিত হয়ে উল্লিখিত সত্তর দশকে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের এলাকায় বসবাসরত কবিগণ বেশ কিছু সাহিত্যপত্রের মাধ্যমে নবতর চেতনার পসরা নিয়ে তাঁদের উপস্থিতি জানান দেন। সেই সাহিত্যপত্রের কয়েকটি হলো : ‘অচিরা’, ‘স্পার্ক জেনারেশন’, ‘অসভ্য শব্দ’, ‘কবিতা’। অচিরা’র ভাব ও কর্মযোগী হলেন সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদ আবুল মোমেন ও অধ্যাপক তপনজ্যোতি বড়ুয়া। কর্মসূত্রে সেই সময়ে চট্টগ্রামে অবস্থানকারী কবি মোহাম্মদ রফিক ও আলতাফ হোসেনও কিছুদিন তাঁদের সহযোদ্ধা ছিলেন। ‘স্পার্ক জেনারেশন’-এর কাণ্ডারিরা ছিলেন ত্রিদিব দস্তিদার, স্বপন দত্ত, শিশির দত্ত, শেখ খুরশীদ আনোয়ার, আবসার হাবীব। ময়ুখ চৌধুরী ‘স্পার্ক জেনারেশন’-এর প্রাথমিক উদ্যোগে যুক্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে তাঁর উপস্থিতি এখানে তেমন সরব নয়। ‘এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধী’ এই বার্তা শিরোধার্য করে এটির প্রকাশনা চলেছিল বেশ কিছুকাল। ‘অসভ্য শব্দ’ ময়ুখ চৌধুরীর সম্পাদনায় বেরোনো একটি ছোটোকাগজ। এই কাগজগুলো অভিমুখিনতার দিক থেকে ছিল কবিতাকেন্দ্রিক। নানা দৃষ্টিকোণের কবিতাবিষয়ে গদ্য ও বিদেশি কবিতার অনুবাদও এগুলোতে কালেভদ্রে ছাপা হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা দরকার, বিশ শতকের ষাট ও সত্তর দশকে ঢাকা ও কলকাতার তরুণ কবি ও কবিতপ্রেমীরা প্রধানত বৈষম্যমূলক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পারিপার্শ্বিকতার বিরুদ্ধে দ্রোহাত্মক ও বিক্ষুব্ধ শব্দমালাকে হাতিয়ার করে কবিতার আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। এ-লক্ষ্যেই তাঁরা ছোটোকাগজের লড়াকু ইমেজের আশ্রয় গ্রহণ করেন। যেমন, কলকাতায় মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়-এর ‘হাংরি জেনারেশন’ (১৯৬২), পুষ্কর দাশগুপ্ত, পরেশ মণ্ডল, সজল বন্দ্যোপাধ্যায়-এর নতুনধারার কবিতা লেখার ‘শ্রুতি আন্দোলন’ (১৯৬৫), ছোটোগল্পের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুতে পরিবর্তন আনার ব্রত নিয়ে ‘শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন’ (১৯৬৬), কবিতায় নতুন রীতি প্রবর্তনের অঙ্গীকার নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শরৎ মুখোপাধ্যায়-এর ‘কৃত্তিবাস’ (প্রথম প্রকাশ : ১৯৫৩)- এসব লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্যপত্র সক্রিয় ছিল।
তিন
সত্তরের জের টেনে আশি’র দশকে প্রবেশ করে বাংলাদেশের সমাজ। দশকটির শুরুতে বাংলাদেশ বলয়িত হয়ে পড়ে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে। ফলে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা, ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বীকৃত অধিকারগুলো চাপা পড়ে গেল ট্যাংকবহর আর সেনাটহলের কুচকাওয়াজ আর বুটের তলে। আর এই অবরুদ্ধ সময়েই কবিতার একটি নতুন অবয়ব নির্মিত হতে থাকে গোপনে, নিভৃতে। বলা যায়, ওই অবরুদ্ধতা এনে দেয় জাবরকাটার অবকাশ। পূর্ববর্তী দশকগুলোতে প্রায় একই বিষয়-আশয়ের মধ্যে ঘোরপাক খেতে থাকা কাব্যিক প্রবণতার বিপরীতে নতুন দশকের কবিদের চেতনায় তাই নতুন দিক অন্বেষণের, নতুন ভূভাগ কর্ষণের প্রণোদনা জাগে। আশি’র দশক ও তার মধ্যপর্বে আবির্ভূত সৃজনমনস্ক, মেধাবী কবিরা তাঁদের কবিতাকে করে তোলেন ঘরোয়া আবহমণ্ডিত, পরিচিত সমাজ-পরিপাশের অবহেলিত বিষয়-আশয়ের প্রতি দায়বদ্ধ ও সুবেদী ব্যঞ্জনা সমৃদ্ধ, প্রকৃত ইহজাগতিক আবেদনময়। মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলার হাজার বছরের জনজীবনধারার মাটিলগ্নতা, লোকপুরাণ, ইতিবাচক ধর্মীয় আবহ, আদিবাসী জাতিসমূহ তথা নিম্নবর্গীয় সংস্কৃতির অন্তর্বয়ন ও চর্যাগুলো নানা সম্ভাষণ ও শব্দাবলির মোড়কে জীবন্তভাবে উপস্থাপিত হতে থাকে কবিতার ছত্রে-ছত্রে। ইতিহাস-ঐতিহ্য-মনস্তত্ত্ব-প্রত্নস্মৃতি ও লোক-সজীবতার সঙ্গে আবর্তমান বিশ্বের সর্বসাম্প্রতিক ভাঙাগড়া আর ইতি-নেতিবাচকতার এ এক হার্দ্য মেলবন্ধন।
আশি’র কবিতাকে তাই মাটির টানে, শেকড়ের মমতায় ঘরে ফেরা ভালোবাসার উৎসবই বলা যায়।
এই দশকেও কিছু লিটল ম্যাগাজিন ও সাহিত্যপত্রের উপস্থিতি ও সেসবের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। যেমন, শিশির দত্ত সম্পাদিত ‘সম্পাদক’, ‘একজন’, ‘দৈনিক কবিতা’, আসাদ মান্নান সম্পাদিত ‘কিছুদিন রৌদ্রের মুখোমুখি’, ইউসুফ মুহম্মদ সম্পাদিত ‘তোলপাড়’, এজাজ ইউসুফী সম্পাদিত ‘লিরিক’, রাশেদ মাহমুদ সম্পাদিত ‘শামা’, অমিত চৌধুরী সম্পাদিত ‘মূল্যায়ন’, মহীবুল আজিজ সম্পাদিত ‘লিটল ম্যাগাজিন’, সুমন ইসলাম ও আবু তাহের মুহাম্মদ সম্পাদিত ‘অব্যয়’, আহমেদ রায়হান সম্পাদিত ‘হৃদপিণ্ড’, অরুণ দাশগুপ্ত ও খুরশীদ আনোয়ার সম্পাদিত ‘অতঃপর’, খোকন কায়সার সম্পাদিত ‘সমস্বর’, সৈয়দ মনজুর মোরশেদ সম্পাদিত ‘স্রোত’, তপন বড়ুয়া সম্পাদিত ‘প্রান্তিক’, সুনীল নাথ সম্পাদিত ‘মফস্বল’, খালেদ হামিদী সম্পাদিত ‘অনন্তর’।
আশি’র দশকের কবিদের প্রায় সকলেই ইতোমধ্যে গ্রন্থিত হয়েছেন। কারো-কারো একাধিক কাব্যগ্রন্থ, প্রবন্ধ বা গদ্যগ্রন্থ, গবেষণাগ্রন্থ, শ্রেষ্ঠ কবিতা, নির্বাচিত কবিতা, কাব্যসমগ্রও প্রকাশিত হয়েছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এ অঞ্চলে আশি’র দশকটি ছিল বেশ বৈচিত্র্যমণ্ডিত, বর্ণিল ও ব্যাপকভিত্তিক সৃজনশীলযজ্ঞে নিবেদিত।
চার
নব্বই দশকে বিশ্বব্যাপী আসে অভাবনীয় পরিবর্তন। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, গণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, দর্শন-রাজনীতি, অর্থনীতি, নিম্নবর্গীয় বা সাব-অলটার্ন চেতনা, নারীর ক্ষমতায়ন, টেকসই উন্নয়ন বা সাসটেইনেবল ডেভলাপমেন্টের ধারণার বহুরৈখিক বিস্তার ও বিকাশ ঘটে এ সময়ে। বিগতকালের সোনালি সুদিনের মুগ্ধ অতীতচারিতা, অরিয়েন্টালিস্ট বা প্রাচ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে উত্তর ঔপনিবেশিক দেখনভঙ্গির প্রসার, উত্তর আধুনিক কবিতা আন্দোলন, রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ ও ধর্মকেন্দ্রিক উগ্র ও সাম্প্রদায়িকতা– বিপরীতে সমন্বয়ী আদর্শবাদিতার প্রবল উত্থান প্রভৃতি ইতিবাচক ও বিপরীতাত্মক স্বভাব-চারিত্র্যের উপস্থিতি এ দশককে যেমন দিয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, তেমনি বইয়ে দিয়েছে মাধুর্যময় আবেগের চঞ্চলতা।
নব্বইয়ের কবিতা তাই একই সঙ্গে ঋজু, কোলাহলপ্রিয়, প্রত্নস্মৃতিময় ও অগ্রসার।
এ দশকটিতেও বেশ কয়েকটি লিটল ম্যাগাজিন সমসাময়িক তারুণ্যের প্রবণতা ও কবিতার প্রবহমানতাকে পরিসর তৈরি করে দিতে আত্মপ্রকাশ করে। এগুলোর মধ্যে আছে ওমর কায়সার সম্পাদিত ‘মধ্যাহ্ন’, হাফিজ রশিদ খান সম্পাদিত ‘পুষ্পকরথ’, সাজিদুল হক সম্পাদিত ‘সুদর্শনচক্র’, ‘সবুজ আড্ডা’, সুজন বড়ুয়া সম্পাদিত ‘চম্পকনগর’, রেজাউল করিম সুমন সম্পাদিত ‘নির্মাণ’, কমলেশ দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘কবিকৃতি’, ‘অন্তরীপ’, আকতার হোসাইন সম্পাদিত ‘পংক্তিমালা’, শরীফা বুলবুল সম্পাদিত ‘বলাকা’, সাইদুল ইসলাম সম্পাদিত ‘ফলক’, কামাল রাহমান সম্পাদিত ‘১৪০০’, অরুণ সেন সম্পাদিত ‘ঋতপত্র’, রিজোয়ান মাহমুদ সম্পাদিত ‘একলব্য’। এ ছাড়া মহিউদ্দীন শাহ আলম নিপু সম্পাদিত ‘কালধারা’, পার্বত্য বান্দরবান থেকে হাফিজ রশিদ খান ও চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া সম্পাদিত ‘সমুজ্জ্বল সুবাতাস’, কক্সবাজার থেকে ইব্রাহীম মুহাম্মদ সম্পাদিত ‘ঋতবর্ণ’ও এ সময়ের কাগজ।
পাঁচ
বিশ শতকের শেষাংশ নতুন একবিংশ শতকের প্রথম বা শূন্যদশকের আগমনী ধারায় স্নাত। এ-সময়ের তরুণ কবিতাপথিকেরা নতুন শতকের নয়া আবহের ভেতর তাঁদের নহলি ভাবনাকে সজ্জিত করতে তৎপর হয়ে ওঠেন পুরোমাত্রায়। এ সময়েই যোগ হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিরাট সম্ভাবনার মহাগতিবেগ। তৈরি হয় কবিতারও নতুন স্থাপত্য, নবীন প্রকৌশল ও সমবায়ী ভাবনার মিনার।
প্রত্যেক দশকেরই তার পূর্ববর্তী বা পরবর্তী দশকের সঙ্গে একধরনের গাঁটছড়া বাঁধা থাকে। কিছুতেই যা এড়ানো যায় না। আগের দশকের সঙ্গে পরের দশকটি যেন কেবলই ঘুরে-ঘুরে কথা বলতে চায়। এভাবে শূন্যদশকের লাগোয়া একবিংশের প্রথম দশকেও দেখতে পাই কবিতার ওজস্বী মহাসাগরের বুকে ফেনিল লহরির মাতামাতি। প্রথম দশকে আবির্ভূত তরুণ-তরুণী কবিতাময়ীর ভাষাতেই নিজেদের পথচলাকে কালের কপোলে বিম্বিত রাখতে চান প্রায় এই সময়েই চট্টগ্রাম থেকে এখনকার কবি ও কবিতার অনুরাগীরা হাতে পেলেন নান্দনিক সৌকর্যময় কয়েকটি ছোটোকাগজ। আলী প্রয়াস সম্পাদিত ‘তৃতীয় চোখ’, মহীন রীয়াদ সম্পাদিত ‘শঙ্খ’, রাফায়েল রাসেল সম্পাদিত ‘চেরাগীআড্ডা’, মাজহারুল আলম তিতুমির সম্পাদিত ‘স্বর’, সেলিম রেজা সম্পাদিত ‘মৃত্তিকা’, মনিরুল মনির সম্পাদিত ‘খড়িমাটি’, জিললুর রহমান সম্পাদিত ‘যদিও উত্তর মেঘ’, ইলিয়াস বাবর সম্পাদিত ‘সুচক্ররেখা’, মুয়িন পারভেজ ও মেরুন হরিয়াল সম্পাদিত ‘ক্রৌঞ্চগীতি’, সাইদুল ইসলাম সম্পাদিত ‘চর্যাপদ’, শেখর দেব সম্পাদিত ‘শাঁখ’, ফারুক তাহের সম্পাদিত ‘দইজ্জা’।
সমকালীন কবিতা ও কাব্যভাবনা, সঞ্চরণশীল সমাজ প্রগতিচিন্তা, আবৃত্তিচিন্তন, নন্দনবোধ ও মুদ্রণ প্রকৌশলের স্বতন্ত্রতায় কাগজগুলো সময়ের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করে নিঃসন্দেহে।