মন খারাপের নদী

জাহেদ মোতালেব | শনিবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ


একটা হিসাব ভুল করেছে, তাই বাবা তুলে গালি দিলেন রাকিবের বস।
সে বলল, স্যার প্লিজ, আমার আব্বাকে নিয়ে কিছু বলবেন না।
বস ঝাড়ি মেরে বললেন, তোমার বাপ কি লাট সাহেব?

রাগে চোখে-মুখে সে আঁধার দেখল। চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ, লাট সাহেব। বলে ক্রুদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকল। পারলে থাপ্পড়ই মারত। বলল, আপনার চাকরির কেথাপুড়ি। বলেই বেরিয়ে গেল।

ভাদ্র মাসের দুপুর। ভ্যাপসা গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ। অফিস থেকে বেরিয়ে শুধু হেঁটেছে। আগ্রাবাদ থেকে হাঁটতে হাঁটতে সি-বিচ গেল। বসল সমুদ্রের সামনে। ঢেউ দেখতে দেখতে তারও ঢেউ হয়ে যেতে ইচ্ছে করল।

তারপর কাজল লেপ্টে যাওয়া কিশোরীর চোখের মতো সন্ধ্যা এল। সমুদ্রপাড় থেকে উঠে এল সে। পঙ্খিরাজের মতো চলছে দুয়েকটা টেক্সি-রিকশা। দুই যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি হয়েছে। প্রতিবাদে দুদিনের হরতাল চলছে। আজ প্রথম দিন। পিনপিন বৃষ্টি পড়ছে। কালো ছাতা মাথায় বুড়োটা খুঁড়িয়ে হাঁটছে। হরতালও চলছে ঠিক তেমন।
মনে পড়ল আব্বার কথা। মারা যাওয়ার আগে কিছুদিন অসুস্থ ছিলেন। আত্মীয়-স্বজন, পরিচিতরা খবর নিত না। তিনি আক্ষেপ করতেন, বুঝলি রাকু, মানুষের মনুষ্যত্ব কমে যাচ্ছে। তিনি মারা গিয়েছিলেন গত বছর ভাদ্রের এক সন্ধ্যায়। সেদিন এ-রকম বৃষ্টি ছিল।

বিচ থেকে আন্দরকিল্লায় এল। এই সেই আন্দরকিল্লা, এখানে মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল। মোগলরা এসে মসজিদ বানায়। ইংরেজ এসে মসজিদটিকে গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করেছিল।

মোড়ে জটলা। কিছু মানুষ শিয়ালের মতো গলা উঁচিয়ে হুক্কা হুয়া করছে। একটু পর মসজিদের সামনে ও সিটি কর্পোরেশনের পাশে মারপিট শুরু হয়।
জেমিসন মাতৃসদনের গলি থেকে বের হয় তার রুমমেট। তাকে দেখে রাকিব এগিয়ে যায়। মারপিট ছড়িয়ে পড়ছে দেখে তারা গলির ভেতরে ঢুকে পড়ে।
মাতৃসদনের সামনে ক্ষুব্ধ এক লোক বলল, এটা তো মগের মুল্লুুক ছিল। মগের বংশধররা এখনো রয়ে গেছে।
রাকিব বলল, মানুষ কেমন বেশরম হয়ে যাচ্ছে দেখেন।
রুমমেট বলল, আমার মা কী বলে জানেন? বলে, লজ্জা মানুষকে নিজের কব্জায় রাখে।

চেরাগী পাহাড়ের মাথার উপর সন্ধ্যার আকাশ। সন্ধ্যা মানুষকে কোন পথে নিয়ে যায়? ক্রিং ক্রিং বেল বাজিয়ে জোরে ছোটা রিকশার গতিতে যেন সেই প্রশ্ন।
হাইওয়ে সুইটসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বুড়ো ভিক্ষুক। কাঁধে নীল থলে, হাতে লাঠি। উপরের পাটির তিনটা দাঁত নেই। বাকিগুলো গাবের কষের চেয়েও কালো। সে ডিসি হিলের বাঁশঝাড়ের দিকে তাকিয়ে উল্টো দিকে দাঁড়ানো ভিক্ষুককে বলে, জীবনের কোনো ভ্যালু নাইরে।
বৃষ্টি থেমেছে। আকাশে ছড়ানো-ছিটানো মেঘ। মেঘের মতোই তার দাঁড়ানোর ভঙ্গি।
তরুণ ভিক্ষুক এক পায়ে দাঁড়িয়ে। বাঁ পা হাঁটুর নিচ থেকে কাটা। ডান হাতও অর্ধেক নেই। বুড়োর কথা শুনে ঠোঁটের ফাঁকে হাসে।

অনেক দিন আগের কথা। তাদের গ্রামের কয়েকজন লোক ফাঁদ পেতে ধানক্ষেত থেকে শিয়াল ধরেছিল। বাতের ব্যথা সারাতে দুজন বুড়োবুড়ি শিয়ালের মাংসও খেয়েছিল। ডিসি হিলে শিয়ালের ডাক শুনে সেই কথা মনে পড়ল।
তার মন এখন জ্বরের মতো। ভাবে, মুখে মিথ্যার প্রলেপ দিয়ে ইঁদুরের মতো কে দৌড়ায়? সে কী করবে? অক্ষম, তাই মোক্ষম কিছু করার মুরোদ নেই। অক্ষমতা কি কান্নার মতো? নাকি সন্ধ্যার মতো?
হাঁটতে হাঁটতে কোনো তরুণীর মনে ঢুকে যেতে পারলে বেশ হতো। তার সঙ্গে নানা কথা বলত। প্রেমের মতো বানাত একটা রাস্তা। ভেঙে ফেলত মনের আয়নাটা। মেয়েটা অবাক হলে সে বলত, এটা ভুল আয়না। যা দেখি আমি নিজে দেখি না, কে যেন দেখায়। সেই দেখাটা আমাকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

গভীর রাত। বুড়ো ভিক্ষুকের নীল থলে মাথায় নিয়ে রাকিব হাঁটছে। থলেয় চাল। হাঁটতে হাঁটতে দেখে ঘন গাছপালায় ঘেরা বনপথ। আকাশে চাঁদ আছে, তবু ভয় লাগে।
হঠাৎ গর্জন শোনে। বাঁশে বাঁশে ঘষা লেগে যেমন শব্দ হয়, তার চেয়ে একটু জোরালো। এত এত প্রাণী থাকতে কেন যেন বাঘের কথা মনে পড়ল। রাতে বিড়ালের চোখ দেখেছে। ওটা কিসের চোখ?

চোখগুলো একটু উঁচুতে, তাই বুঝল বড় কোনো প্রাণী। দাঁড়িয়েই থাকল। চাঁদের আলোয় এগিয়ে এল একটা বাঘ। বুক ধুকপুক করছে। কী করবে? দৌড় দেবে? জান তো এমনিতেই যাবে। মরলে মরব-এটা ভেবে বলল, দেখ, আমি তোমার কোনো ক্ষতি করিনি। আশা করি তুমিও আমাকে আক্রমণ করবে না। তুমি কি জানো, ছোটবেলায় তোমাকে বাঘমামা ডাকতাম! বলার পর ভাবল, বাঘ কি মানুষের কথা বোঝে?
শোন, তখন আমার বয়স বারো কি তেরো। এক মাস ধরে ম্যালেরিয়ায় ভুগছি। দুপুরের রোদকে মনে হয় তোমার চোখ। পৌষের শীতের মতো কেঁপে কেঁপে জ্বর আসে। প্রায় কাঁদতাম আর দৌড়ে খেলার মাঠে চলে যেতে চাইতাম।

আম্মা তখন তোমার গল্প বলতেন। বলতেন, বাঘ হলো গোঁয়ার প্রকৃতির। যা ঠিক করে তাই-ই করে। তোমার নদী পার হওয়ার গল্প শুনিয়ে বলতেন, মানুষকেও বাঘের গোঁয়ার্তুমির মতো হতে হয়। কেন জানিস? দুঃখ-কষ্ট মোকাবেলা করতে হলে বাঘ হতে হয়। আচ্ছা রাকু, তুই পৃথিবীতে এসেছিস পরাজিত হওয়ার জন্য?
বাঘটাকে সে বলে, শোন মামা, সেই থেকে আমি তোমাকে ভালোবাসি, তোমার শক্তিমত্তা ভালোবাসি।

কার ধাক্কায় যেন জেগে ওঠে। এদিক-ওদিক তাকায়, কাউকে দেখে না। নিজেকে তার খুব একলা মনে হলো। ভাবে, আম্মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাব। ঘুম থেকে উঠে দেখব, পৃথিবীতে অপরাজেয় কিছু নেই। আম্মা জিজ্ঞেস করবেন, কোথায় যাচ্ছিস? আমি বলব, স্বপ্ন দেখতে যাচ্ছি।
বাইরে তাকিয়ে দেখে, সকালের আলো ছোটবেলার মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

রাকিব থাকে মোমিন রোড ঝাউতলায়। পাড়ার মাঝখানে মসজিদ। উত্তর পাশে মেথরপট্টি। সেখানে সারা বছর উৎসব লেগে থাকে। ঝগড়া কম। কিন্তু দক্ষিণ ও পশ্চিম পাড়ার মানুষ মাঝরাতের কুকুরের মতো ঝগড়া করে। সকালে, দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায় একবার ঝগড়া না করলে তাদের পেটের ভাত হজম হয় না। কখনো গভীর রাতে তারা কুকুরকেও হার মানায়। আজ সকালে শুরু করেছে।

মানুষ এখানে তিন রকম। এক দল ঝগড়া করে, আরেক দল ঝগড়া শুনে তাদের করুণা করে। মাঝখানে আরেক দল আছে, তারা ধনী। তারা কানে তুলা দিয়ে চলাফেরা করে।

রাকিবের মনে হয়, ঝগড়াটে মানুষগুলো একেকজন ‘কালা চিঁয়া’। গায়ের রং কালো ও মুখটা ছুঁচোর মতো বলে তাকে ওই নামে ডাকা হতো। লোকটা এই এলাকার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ছিল।

বিকেলে বেরুল। নীল-সাদা আকাশে চোখ রেখে ভাবল, কোথায় যাব? ভাবনা ঘামে ভেজা গেঞ্জির মতো মনে লেপ্টে থাকে। জীবন যেন পাটিপাতার বাঁশি। পাতাটা শুকিয়ে গেছে। তাই বাঁশি বাজে না।

আশেপাশে অনেক মানুষ, তবু কত একা! ডিসি হিলের ভেতর দিয়ে নন্দনকানন পার হয়। নিউ মার্কেট পেরিয়ে আলকরণের ভেতর দিয়ে গিয়ে অভয়মিত্র ঘাটের দিকে হাঁটে। পুরনো অশ্বত্থ, পরিত্যক্ত মন্দির বা কেওড়াগাছে লেগে থাকা কাদার মতো মনে হয় সবকিছু।

কেওড়াগাছের পাশে বনবিভাগের কাঠ। নদীর রং কাঠের মতো। চর পড়ে আরো ছোট হয়েছে। চায়ের দোকানের পাশে বিক্রি করা চনামনার ঠ্যাঙের মতো স্রোত।
জেলেপাড়ায় ঢুকতেই কয়েকটি সানাই বা স্বর্ণকুটি ফুলের গাছ। বর্ষায় ফুল ফুটলে মনে হয়, এক ঝাঁক হলুদ চড়ুই মেহমানকে ডাকছে। পাড়ার এক বুড়ো ঘাটে বসে বিড়ি ফুঁকছেন। তার অবাক চেহারা দেখে বলেন, হেই দিন আর নাই।

আরেক বুড়ো চশমার ফাঁকে গাঙচিল দেখার চেষ্টা করছেন। দূরে নৌকা থেকে মানুষ নামছে। বুড়োর মনে হয়, কাদামাখা কাঁকড়ার মতো তারা হেঁটে আসছে। মনে পড়ে, সেই জোয়ান কালে বাহু দুটি ছিল জামগাছের মোটা ডালের মতো শক্ত। সাত কেজি ওজনের একটা রুই ধরেছিলেন ঘাটের পূর্ব দিক থেকে। জালসহ মাছটাকে জড়িয়ে কাদা বেয়ে হাঁটছিলেন। এখনো স্পষ্ট মনে আছে, বউকে প্রথম জড়িয়ে ধরার মতো সুখ পেয়েছিলেন। সেই কথা মনে পড়ায় গা শিরশির করে।
শুনে মনে হলো, রাকিব আর নিজের নেই, বুড়োর ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

বুড়ো চোখ মেলে শেষ বিকেলের সূর্য দেখেন। এই আলোর কোথাও রুই মাছের লাল ও বউয়ের দৃষ্টিটা আছে!
অনেক কাল আগে যখন এই পাড়া ছিল না, কেওড়াগাছের গোড়ায় হয়ত জোয়ারের জল জমত, সেখানে মা মাছের সঙ্গে খেলত মৃত জেলেদের আত্মা। তখন হয়ত পাড়ে বাড়ি খাওয়া ঢেউয়ে শোনা যেত, একদিন অভয় আসবে। অশ্বত্থ ফুলের বাঁশি বাজিয়ে মিত্র পাতাবে এই জল আর জলের প্রাণীর সঙ্গে।

চশমা-বুড়োর ছুড়ে মারা বিড়ি কাদামাটিতে ডুব দেয়। তিনি ভাবেন, মাটিতে কত মায়া!
রাকুর মনে হয়, মাছের নিশ্বাস থেকে এসেছে এই মাটি।

বুড়োর ইচ্ছে করে, কাদা মাড়িয়ে হেঁটে পাড়ে উঠতে। হাঁটতে হাঁটতে হয়ত ছোটবেলায় যাবেন। অভয় মিত্রের জমিদার বাড়ির পাশে দৈত্যের মতো বড় অশ্বত্থটার নিচে দাঁড়াবেন। তখন ঝরে পড়বে হলুদ-কমলায় মেশানো অশ্বত্থ ফুল। তারা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে বাঁশি বাজাবেন। বাঁশির সুরে জমিদার বাড়িতে নামবে ছায়া।
অশ্বত্থের কাছে দাঁড়িয়ে আছে বহুদিনের পুরনো যজ্ঞডুমুর। শ্রাবণ মাস এলে গাঢ় খয়েরি ও সবুজ রঙের ডুমুরে ভরে থাকত গাছ। তখন তাঁরা বানরের মতো উঠে যেতেন গাছে। বুড়ো কেয়ারটেকার তাদের ‘ডঁগুলা চুরা বাঁদর’ বলে গালি দিতেন।

রাকিব আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ জুড়ে সন্ধ্যার রং।
আব্বা ছিলেন কাঞ্চননগর প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। চেয়েছিলেন ছেলে শিক্ষক হবে; কিন্তু হয়েছে কেরানি। সারা দিন পরের যোগ-বিয়োগ মিলায়। পেপার পড়া ছিল তাঁর নেশা। স্কুল থেকে এসেই পড়তেন। মাঝেমধ্যে বলতেন, বুঝলে রাকুর মা, মানুষ শুধু পেতে চায়, দিতে চায় না। তাই তো হিসাব মিলে না।

আম্মা বলতেন, আগে নিজের হিসাব মিলাও। আব্বা বলতেন, তা আর মিলল কই। তাঁর সেই দীর্ঘশ্বাস আজ বুড়োর মধ্যে দেখে কী যে হলো, ভাটার স্রোতে ভেসে সাগরের দিকে চলে যেতে ইচ্ছে করল।
অনেক জোয়ার-ভাটা দেখা চশমা-বুড়ো ছেলেটার চোখে জল দেখে কিছু একটা বুঝতে পারেন। বললেন, মানুষ অইলু নদীর মতন। বুড়ো তাকে সাহস দিতে চেষ্টা করেন।

রাকিব উঠতে চায়। কিন্তু কে যেন কুটিল মুখে বলে, তুই মরে ভূত হয়ে যা। আমরা ভূতের মুখে কাঠি দেব।
শত শত আলো কর্ণফুলীর পানিতে ঝিকমিক করছে। আলো নাকি মানুষের রক্ত? এই নদীতে কত কত রক্ত মিশেছে তা কি কেউ জানে! মনে হলো, সে মরে যাচ্ছে আর তার মুখের উপর হাঁটছে পিঁপড়া।

বুড়ো জিজ্ঞেস করেন, তোমার চোখে-মুখে এত দুঃখ কেন?
অস্তায়মান সূর্যের দিকে তাকান বুড়ো। তার চোখে মোটা কালো ফ্রেমের গোলাকার চশমা। একেবারে আব্বার চশমাটার মতো। হাসপাতালের সেই দৃশ্য মনে পড়ে। হাঁটুতে দুই হাত রেখে কিছুটা কাত হয়ে বসে আছেন আব্বা। শ্যাওলা ধরা দেয়ালের দিকে মুখ। চোখে সাদা ব্যান্ডেজ। এমন অসহায়তা ফুটে উঠেছে! তখন সে ক্লাস ফোরের ছাত্র। হাসপাতালের সাথে প্রথম পরিচয়। এই দৃশ্য দেখে তার চোখ ফেটে কান্না আসছিল।

হাতের লাঠিটা শক্ত করে ধরে বুড়ো বলেন, কেওড়াগাছ কীভাবে মাটি আঁকড়ে ধরে আছে দেখ। মাছ ধরতে ভালো লাগত আর ভালো লাগত বউকে। এই দুইটা জিনিস আমাকে বাঁচিয়েছে। অভাব ছিল, তবুও কীভাবে যেন জীবন পার হয়ে গেল।
রাকিবের চোখ স্রোতের দিকে।

বুড়ো বলেন, এখন বুড়ো হয়ে গেছি, স্মৃতি নিয়ে সময় পার করি। শোনো বাবা, একলা বাঁচা যায় না। বাঁচতে হলে কিছু ধরতে হয়। অথৈ জলে মাছ ধরার যে সুখ, জীবন থেকেও তা ধরার চেষ্টা করতাম। এই দেখ, লাঠিটা সুন্দর করে ছেঁচে দিয়েছিল আমার পরিবার। মনে হয়, এটার প্রাণ আছে। মাঝে মাঝে কথাও বলি।
বেলা বিস্কুট চায়ে ভেজালে কেমন হয়? বুড়ো প্রশ্ন করেন। নিজেই জবাব দেন, নরম হয়ে যায়। মানুষও তেমন। ভালো লাগা দিয়ে ভিজিয়ে রাখলে মানুষের মনও বেলা বিস্কুটের মতো হয়ে যায়।

রাকিব কিছু বলতে পারে না। শুনতে শুনতে তার মধ্যে একটা নদী বয়ে যায়।
কর্ণফুলীতে আগে বাঘা হাউস, পাঙাস, বোয়াল, কাতাল, রুই ও দেশি কোরাল পাওয়া গেত। জেলেরা বারো-পনেরো কেজি ওজনের বোয়াল ও কাতাল ধরেছে। সময়ে ইলিশও পাওয়া যেত। সার কারখানা হওয়ার পর বড় মাছ আর ধরা পড়ে না। এখন পাওয়া যায় ফাইস্যে, হোলা ইছে, ছউয়া ও চরবটি মাছ। হোলা ইছে ছোট, তরকারিতে দেয়। এগুলো জোয়ার-ভাটার আঘাতে নদীতেই ডিম পাড়ে। আগে বিন্দি জাল বসালে এক জালে চার-পাঁচ লাই মাছ পাওয়া যেত। এখন বেশি হলে দুই-তিন কেজি।

স্বপ্নের মতো কথা বলছিলেন বুড়ো। বললেন, নদী তখন ছিল ভরা যুবতী।
পাশের বুড়ো বলেন, নদী এখন মুখে মেছেতা হওয়া মেয়ে। একটু পর তার দাঁতের ফাঁক দিয়ে গান বেরুয় : ওরে কর্ণফুলীরে, অভাগিনীর দুঃখর কথা কইও বন্ধুরে…

শুকাতে দেওয়া জালের উপর দিয়ে এক লোক হেঁটে যাচ্ছিল। চশমা-বুড়ো বলেন, জালের উপর পা দিলে মনে হয় পরাণের উপর পা দিল।
বুড়ো যেন সন্ধ্যার আলোয় মাখা। বাঁ চোখের নিচে একটা তিল। ঠোঁটের উপর বিন্দি জালের মতো লম্বা গোঁফ।
মাছের ট্রলার আসায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে আট-দশজন শ্রমিক। ট্রলার থেকে মাছ নামাচ্ছে। তাদের ঘাড় বেয়ে পড়ছে বরফের পানি। গা বেয়ে তা নিচে পড়ে। ঘাটের ধূসর কাঠ এলোমেলো ভিজে আছে।

রাকিবের মনে পড়ে, তখন সবে ডিগ্রি পাস করেছে। আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চাকরির খোঁজে নেমে পড়ল সে। অনেক চেষ্টা করল, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা করতে পারল না। এক বন্ধুর কাছে খবর পেয়ে ঢাকাও গেল। হলো না। সিকিউরিটি গার্ডের বিজ্ঞাপন দেখে একদিন শান্তিবাগ গেল। দেখল, বেড়ার একটা ঘরে সাইনবোর্ডটা উল্টো হয়ে ঝুলছে। এর পরেই আগ্রাবাদে চাকরিটা পেয়েছিল।

কিছু ভালো লাগছে না। ইকবাল রোড দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আবার কর্ণফুলীর পাড়ে যায়। লোকটা কচ্ছপের মতো বসে ছেঁড়া জালে ইঁদুর গতিতে তবিল চালাচ্ছে। বোয়াল মাছের পিঠের মতো পেশি। শ্যামলা গায়ে গোধূলির ঘ্রাণ। ঘূর্ণিঝড়ে ট্রলার থেকে পড়ে যাওয়া চকরিয়ার এক জেলের কথা বলছিল। সাত দিন সমুদ্রে ভেসে শরীর ফোমের মতো নরম হয়ে গিয়েছিল। মাংস খুবলে খেয়েছে মাছ ও অন্যান্য প্রাণী। তারপরও বেঁচে ফিরেছে। মানুষের জান অনেক শক্ত, লোহার চেয়েও শক্ত। এ কথা বলে সে হাসে।

কেওড়াগাছের গোড়ায় যে মাটি দেখেছে, লোকটার ঠোঁটেও কি সেই মাটি! আকাশের লালচে আলোয় যেন ওই গন্ধ। শহরটাকে মনে হয় একটা সাগর। মানুষগুলো ছেঁড়া, রং উঠে যাওয়া একেকটা বয়া।
রাকিব মৃত্যুর গন্ধ পায়। যে বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে, বেদনার মতো সারা শরীর নীল হয়ে মারা গিয়েছিল ছোট ভাইটা। কাঁঠালগাছতলে তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল।

মানুষ মরে যাওয়ার পর আকাশে-বাতাসে তার নিশ্বাস, হাসি বা প্রাণের স্ফুলিঙ্গ থেকে যায়! আকাশের কারুকাজ দেখে মনে হয়, থাকে।
আব্বার মনটা ছিল উৎসবের মতো। তাকে নিয়ে কত মেলায় যে গেছে! একবার অবাক কাণ্ড, তাকে নিয়ে গেল ঢাকায় একুশে বইমেলায়। মা জানত তারা শহরে গেছে। আসার পর মুচকি হেসে জানালেন। মা রেগে বললেন, সবাই যায় কক্সবাজার-রাঙামাটি, তোমার বেলায় সব উল্টো।

আব্বার পাগলামি দেখে মা মাঝেমধ্যে বিবিরহাটের ছানার মিষ্টির মতো হাসতেন। জ্বলজ্বল করত তার মুখ। সেই আলোটা ধরতে চাইত রাকিব।
সে চারপাশে তাকায়। সন্ধ্যার বিষণ্ন আলো, গোধূলির রং, পাখিদের উড়ে যাওয়ার মধ্যে তার জন্য কি কিছু আছে? ভাবে, অপরাধ করলে মানুষ ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে যায়। সে কেন কুঁকড়ে থাকবে?

জাল তুনা লোকটার তবিল ঘুরবে। ছেঁড়া সময় জোড়া লাগবে। পাখির কলকাকলিতে ফুটবে আলো। আলো থেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করবে আব্বাকে।
আব্বা জিজ্ঞেস করবেন, রাকু, মানুষ কোথায় যাওয়ার জন্য বাঁচে?

আব্বাকে রাকু দেখবে না। প্রশ্নটাও শুনবে না। পাটিপাতার গাছ থেকে ছিঁড়ে নেবে একটা পাতা। ভাঁজ করে বাঁশি বানিয়ে ফুঁ দেবে। হয়ত তখন সন্ধ্যার মতো ছড়িয়ে পড়বে কর্ণফুলীর রং। নদীটা মন খারাপের মতো ঢুকে যাবে তার ভেতরে। সেই রং আর মন খারাপের নদী নিয়ে কী করবে সে ভেবে পাবে না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকবিতার পরম ভাষায়
পরবর্তী নিবন্ধসাঁকো