মঞ্চে নারী

সাবিরা সুলতানা বীনা | শনিবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১২:০০ অপরাহ্ণ


পরিস্থিতির বদল হয়নি এত বছরেও

চট্টগ্রামে নারী নাট্যকর্মীদের অবস্থান জানতে হলে আমাদের এ-শহরে নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে নারীরা অতীতে কি ভূমিকা পালন করেছে সে সম্পর্কে জানার প্রয়োজন আছে।
নাটকের ধারাবাহিকতায় আমরা দেখতে পাই যে, দেশ বিভাগের পর থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত নারী নাট্যকর্মীদের অবস্থান বিশেষ একটা বদল হয়নি। গান, নাচ, আবৃত্তি মডেলিং জগতে নারীদের পদচারণা বেড়েছে ঠিকই কিন্তু থিয়েটারে তেমন করে সাবলীল পদচারণা বেড়েছে কি? সাবলীল বলছি এ-কারণে বরাবর থিয়েটার হলো পুরুষশাসিত শিল্পকলা, অবক্ষয়ী এ-সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ পুরুষই নারী প্রশ্নে মালিকানার মনোভাব পোষণ করে। লেনিন বলেছিলেন, অনেক কমিউনিস্টকে নারী জাতি সম্পর্কে প্রশ্ন করলেই বেরিয়ে পড়ে এক একটি দানব; তাই বিজ্ঞানের চরম উন্নতির সোপানে দাঁড়িয়েও মেয়েরা ভাঙতে পারছে না অধীনস্থ জীবনের প্রলম্বিত ছায়া। তবু নারীরা তাঁদের আশা-আকাঙ্ক্ষা আঁকড়ে ধরে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার চেষ্টারত।

সেই পঞ্চাশের দশকের শুরু থেকে সুষ্ঠু নাট্যচর্চার প্রাণকেন্দ্র ছিল চট্টগ্রাম কলেজ। যেহেতু বছরে একবারেই এই কলেজে নাটকের প্রদর্শনী হতো তাই নাটক পাগল কিছু তরুণ-মাহাবুব হাসান, আজীজ মিছির, রামেন্দ্র মজুমদার, মৃণাল কান্তি দস্তিদার আরও অনেকের সহযোগিতায় নিয়মিত নাটকের প্রচেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু সামাজিক কারণে মেয়েদের মঞ্চে আনা তখনো নিষিদ্ধ। ১৯৫১ সালে মোমিন রোডের হরিখোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হয় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সম্মেলন। এ-বছর সংগঠিত হলো প্রান্তিক নব নাট্য সংঘ। চট্টগ্রামে সাংস্কৃতিক চর্চা আন্দোলনে রূপান্তরিত হলো। মহিলারাও এগিয়ে এলেন অভিনয় শিল্পে।

প্রান্তিক নব নাট্য সংঘ গণসংগীতের পাশাপাশি জীবনঘনিষ্ঠ নাটক পরিবেশন করতে লাগল। দেওয়ান বাজার অগ্রণী সংঘে নাটক মঞ্চায়নে এগিয়ে আসেন ঘরের মা- বোনেরা। প্রথম স্ত্রী-পুরুষের মিলিত অভিনয়ে ১৯৫২ সালের ১৪ অক্টোবর ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে জবানবন্দী নাটকটি অভিনীত হয়। এতে কামেলা শরাফী এবং মনি ইমাম অভিনেত্রী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।

‘দুই পুরুষ’ নাটক পরিচালনা করেন প্রণব কুমার দাশ। নারী শিল্পী ছিলেন মীরা সেন, ছায়া রায়, সুপ্তী খাস্তগীর ও মিনু দাশ। এদের প্রত্যেকর স্বামীই ছিলেন সংস্কৃতি জগতের মানুষ। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, এ-চিত্রটা তেমন বদলায়নি। অর্থাৎ স্বামী যদি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বিশেষ করে মঞ্চ নাটকের সঙ্গে যুক্ত থাকেন তবেই সেই পরিবারের নারী নাট্যকর্মী (যদি সেই পুরুষ চান) অভিনয়ে অংশগ্রহণের সুযোগ পান। যদিও আমার ক্ষেত্রে আমার মা-বাবার সহযোগিতা আমাকে এ-কাজে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

১৯৮৩ সাল থেকে দেখছি, অনেক নারী নাট্যকর্মী তাঁদের স্বপ্নকে গলা টিপে ফিরে গেছেন সংসারের ঘেরাটোপে। ১৯৫২ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত নারী নাট্যকর্মীদের মঞ্চে কাজ করার ক্ষেত্রে যে দৃষ্টিভঙ্গির তেমন বদল হয়নি তার প্রমাণ এই আমরা। দীর্ঘসময় মঞ্চে টিকে থাকার পেছনে জীবনসঙ্গীদের ভূমিকা থাকে। এখনকার অনেক নারী নাট্যকর্মীদের ক্ষেত্রে কথাটি প্রযোজ্য। আবার উল্টো ঘটনাও ঘটে। নাটকের মঞ্চে পরিচয় এবং তারপর পরিণতি। পরবর্তী সময়ে সংসারের দোহাই দিয়ে পুরুষ সঙ্গীটি ওই নারীর স্বপ্নকে মঞ্চের আলো থেকে সরিয়ে দিয়েছেন চিরতরে। তাই প্রথমে যে পুরুষতান্ত্রিক ও মালিকানার মনোভাবের কথা বলেছিলাম তা এই সময়েও কিছুমাত্র দূর হয়নি। এখনো দলের সিদ্ধান্তদাতা সবাই পুরুষ, তাঁদের ইচ্ছায় দলগুলো পরিচালিত হয়। নারীরা একটা সময়ে বয়সের কারণে মঞ্চে কাজ কম করার আক্ষেপ নিয়ে সরে আসেন। অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে জীবন কাটিয়ে দেন।

নারী নাট্যকর্মীরা উপার্জনশীল হলেও সংসারের সব দায় আমাদের। তাই সব কাজ সেরে ভালোবাসার টানে ক্লান্ত পায়ে প্রত্যেক নারী নাট্যকর্মী মঞ্চের আলোয় এসে দাঁড়ান। সাংসারিক, সামাজিক যে যুদ্ধে আমরা লিপ্ত থাকি তা কিন্তু পুরুষ নাট্যকর্মীকে তেমন করে পোহাতে হয় না। নাটকের রিহার্সাল, শো এসবের আগে ঘরের দায়িত্ব পালন করে আসতে হয়। তবুও নারীরা তাঁদের স্বপ্নকে হারিয়ে যেতে দিতে চান না।

এখনো নারী থিয়েটার কর্মীদের প্রতিবেশীদের বক্র দৃষ্টি সইতে হয়। যদিও মঞ্চ থেকে আসা সুবর্ণা মোস্তফা মধ্যবিত্তের পছন্দের নায়িকা হয়ে উঠেছেন, তবু ঘরের পাশের অভিনয় শিল্পী মেয়েটা তাদের কাছে আপন হতে পারেনি। নাটকে কাজ করি শুনলে বাড়িওয়ালারা বাড়ি ভাড়া দিতে চাইতো না। এখনকার ছেলে-মেয়েরা শুনলে অবাক হবে। কিন্তু ৮৩-৮৪ সালে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন আমি হয়েছি।

আসলে প্রত্যেক নারী নাট্যকর্মী তাঁদের নিজ নিজ জায়গা থেকে তাঁদের মতো করে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। এর বাইরে মহড়া থেকে বাড়ি ফিরবার জন্য পুরুষ কর্মীদের সহযোগিতার প্রয়োজন তো হতোই। ব্যাপারটিকে সহজভাবে মেনে নেওয়া প্রতিবেশীদের জন্য কষ্টসাধ্য বিষয় ছিল।

থিয়েটার সমাজের বাইরের কোনো বিষয় নয়। পেশাগত জীবনে মেয়েরা যেভাবে নিজেদের শৃঙ্খল ভাঙতে পেরেছে, তেমন করে থিয়েটারেও একদিন নারীরা তাদের জায়গা করে নেবে। এ-জন্য দরকার রাষ্ট্রের বদল এবং পেশাগত চর্চার পথ তৈরি করা।

আসলে মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে নারীরা তাঁদের অধিকারের জায়গাটা হারিয়েছে। তা ফিরে পেতে নারী-পুরুষ উভয়েরই সম্মিলিত চেষ্টা প্রয়োজন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধহালদা চলচ্চিত্র
পরবর্তী নিবন্ধ‘চট্টগ্রাম মার্জিনাল জায়গায় পড়ে নাই’