‘চট্টগ্রাম মার্জিনাল জায়গায় পড়ে নাই’

সুনীতি ভূষণ কানুনগো

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১২:০৬ অপরাহ্ণ

সাক্ষাৎকার গ্রহণ

১৯৩৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সুনীতি ভূষণ কানুনগোর জন্ম। শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার কানুনগোপাড়া গ্রামে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন তিনি। যোগ দেন আশুতোষ কলেজের শিক্ষক হিসেবে। তবে পড়ার নেশায় চলে যান বড় গ্রন্থাগারে, ঢাকা শহরে। ইতিহাসবিদ আবদুল করিমের সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। তাঁরই অনুপ্রেরণায় যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে। ‘A History of the Muslim rule in Chittagong’ শিরোনামে পিএইচডি করেন আবদুল করিমের অধীনে। এরপর যোগ দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে। সেখানে পড়িয়েছেন ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত। খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে পড়িয়েছেন লোক প্রশাসন ও রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগে। পঁচিশ বছরের শিক্ষক জীবনে বই লিখেছেন ত্রিশটির বেশি, আর গবেষণা প্রবন্ধ দশের বেশি। প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক যুগের বাংলার রাজনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস, প্রাচ্যের রাষ্ট্র দর্শন, প্রচীন হরিকেল রাজ্য ও মধ্য চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত তাঁর উল্লেখযোগ্য বই।

কেমন আছেন?
সর্বশক্তিমানের কৃপায় ভালোই চলছে।
কীভাবে সময় কাটে এখন?
আমি তো পড়াশোনা করার লোক তাই পড়াশোনা করেই দিন চলে যায়।
এখন কি লিখছেন?

এখন হাতে আছে বাংলায় রেনেসাঁস আন্দোলন, মহাকবি আলাওল ও তার জীবনী। আর কিছু মনেও আসছে না…..

কিছু বই বোধহয় প্রেসেও আছে?
প্রেসে তো অনেক কাজই রয়ে গেছে, কিন্তু লোক দিয়ে আনতে পারছি না। নিজেও যেতে পারছি না। এখন প্রেসে পরিপূর্ণভাবে তৈরি আছে বৈষ্ণব মহাজন চারজন।
আপনার কাছে কি মনে হয় এ-অঞ্চলের ভাষা ও সাহিত্য স্বতন্ত্র?

এটা ঠিক স্বতন্ত্র না। আমরা সকলে তো বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অঙ্গ ফলে…যদি দেখো সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায়ের বইতে, তিনি সমস্ত বাংলাকে চারভাগে ভাগ করছিলেন। রাঢ়, গৌড়, প্রাকৃত, বরেন্দ্র। আর একদম শেষে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের নিজস্ব ভাষা-সাহিত্য আছে, তার স্বাতন্ত্র্যভাবটাও হয়তো প্রকট হয়ে ওঠে। কিন্তু মূল বিকাশ বারো শতকের দিকে, বিকশিত হতে হতে তা বর্তমানে এসে পৌঁছেছে।

এক্ষেত্রে বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের সাথে এর কি মিল রয়েছে? বা চট্টগ্রাম কি আলাদা কিছু?
না , চট্টগ্রাম বাংলা সাহিত্যের একটি শাখা ফলে এটিকে ঠিক আলাদা করা যায় না। ভাষার উচ্চারণ, প্রয়োগ, চর্চা ইত্যাদি চট্টগ্রামে একটু পার্থক্য আছে, একদমই মিল নেই তাও নয় আবার।

এর কারণ কি অন্য অঞ্চলের প্রভাব? বিদেশি বা ইংরেজদের?
না তবে চট্টগ্রামের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে বাইরের অঞ্চলের অনেকটা প্রভাব আছে। যেমন ধরো পর্তুগিজ সময়ে পর্তুগিজ ভাষা, প্রবাদ। মুসলমান সময়ে আরবি-ফারসি ভাষার প্রয়োগ। এসবের যথেষ্ট প্রভাব আমরা দেখি, বলা যায় কালক্রমে এসেছে। সবচেয়ে বেশি সেক্ষেত্রে ইংরেজরা বাণিজ্যের উদ্দ্যেশে এখানে এসে বসতি স্থাপনও ইংরেজ ভাষার প্রভাবের বড় কারণ। চট্টগ্রামে যারাই এসেছেন তারা কিছু না কিছু ভাষা,সংস্কৃতির উপর লিগেসি রেখে গেছেন।

চট্টগ্রামে নগর গড়ে ওঠার পেছনে যদি কিছু বলতেন…

চট্টগ্রাম শহরটা খুবই প্রাচীন শহর। অনেক পণ্ডিতেরা মনে করেন, গ্রিক আমলে তাদের প্রভাবটা প্রারম্ভিক প্রভাব। চট্টগ্রামের সমন্বয়ে দেখা যায় গ্রিক শব্দ, ভৌগলিকের কিছু প্রভাব রয়েছে। কাজেই প্রথমের স্থিরবিন্দু হিসেবে গ্রিকেরা, সাথে মিশরিওরাও। তারপর আরবরা ভারত মহাসাগরে সমুদ্র তীরবর্তী যত স্থান পেত সেখানেই ব্যবসার জন্যে যেত। ফলে চট্টগ্রামের পোর্টে আরবদের প্রাধান্য বেশি। এরপর পর্তুগিজদের।

এ-উপায়ে স্যাটেলমেন্টের জায়গায় দেখা যায়, এখানে নগর বলতে যা বোঝায় তা গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রামকে পর্তুগিজ আমলে বলা হতো, পোর্টো গ্র্যান্ডি অর্থাৎ বৃহত্তর বন্দর। আর পশ্চিম বঙ্গকে বলতো পোর্টো পিকুয়েনো বা ক্ষুদ্র বন্দর। যা হোক, এ-দ্বারা বোঝা যায় চট্টগ্রামের বাণিজ্যিক গুরুত্ব। এবং পোর্টের সাথে যাতায়াতেরও নতুন দিগন্ত।

তার মানে কি এই নগর বিষয়টা পশ্চিমবঙ্গ থেকে শেখা?
না, যেহেতু চট্টগ্রামকে পোর্টো গ্র্যান্ডি বলা হচ্ছে, তার মানে চট্টগ্রাম বৃহত্তর বন্দর আর বন্দর মানেই তো নগরী গড়ে ওঠাই স্বাভাবিক। আর আরকানিদের আগমন, সবশেষে ইংরেজদের আধিপত্য বিস্তার তো একটা প্রভাব রাখেই। সবদিক থেকে, ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য এমনকি ভ্রমণের পথেও তাদের নিজস্ব প্রভাব রয়ে গেছে। এবং বৃটিশ আমলে এ-মর্ডানাইজেশনের কাজটা প্রকটভাবে হয়েছে।

আপনার কাছে কি মনে হয়, চট্টগ্রাম অর্থনৈতিকভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়েও কেনো এখনো মার্জিনাল জায়গায় পড়ে আছে?
না, চট্টগ্রাম তো মার্জিনাল জায়গায় পড়ে নাই। চট্টগ্রাম তো বাংলাদেশের প্রথম পোর্টভিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ শহর। চট্টগ্রাম সবচেয়ে বড় বন্দর, অর্থনৈতিক রাজধানীও। চট্টগ্রাম উন্নতি করেছে অনেক, ভবিষ্যতেও করবে। সেভাবে তৈরিও হচ্ছে।
চট্টগ্রামের জনবিন্যাস কি তবে বদলে যাচ্ছে?

চট্টগ্রামের লোক তো চট্টগ্রামেই আছে। যেহেতু এটা বন্দর এবং শিল্পনগরী, এখানে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে প্রচুর পরিমাণে লোক এখানে আসছে। তার ফলে বিভিন্ন জাতির সংমিশ্রণ আমরা দেখতে পাই। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। চট্টগ্রামের উন্নতি বাণিজ্যের উপর নির্ভর করে, ফলে বাণিজ্যিকদের থেকে এর উন্নতি অস্বাভাবিক নয়। চট্টগ্রামের প্রতিদ্বন্দী্ব হিসেবে অনেক বন্দরই গড়ে উঠেছে যেমন মংলা, পায়রা বন্দর। এসব গড়ে উঠলেও কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। উন্নতির দিক থেকে চট্টগ্রামেরটাই হয়তো বেশি কেননা কর্ণফুলীর অববাহিকায় এর গুরুত্ব তো রয়েছেই। চট্টগ্রাম আর কর্ণফুলী যে একে অপরের পরিপূরক। এভাবেই চট্টগ্রামের বিকাশ হয়েছে এবং তা প্রবহমান।

এ-সময়ে এসে আপনার উপলব্ধি যদি বলেন…
অন্যান্য বৃদ্ধ লোকেদের যেমন অবস্থা হয়, আমারো তেমনি। আমার ছাত্র-ছাত্রী, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী আমার খোঁজ খবর রাখে এভাবেই তো ভালো চলে যাচ্ছে, তাতেই আমি খুশি।

পুরস্কার নিয়ে যদি কিছু বলতেন…
না, না…আমি যথেষ্ট সম্মান পেয়েছি। আর কিছু চাই না।
আপনার শিক্ষার্থীদের জন্যে কিছু বলবেন ?

আমি শিক্ষকতার পেশাতে আছি, জীবনটা এভাবেই কাটিয়েছি। আমি চাইব আমার শিক্ষার্থীরা যেন পাঠ গ্রহণে বেশি করে মনোযোগী হয়।
আপনি কি দেশের বর্তমান অবস্থা নিয়ে কিছু ভাবছেন…আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক?

জটিলতাই তো আমাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে গিয়েছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিকভাবে তো আমরা একটা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মহামারী, প্যালেস্টাইন সংঘর্ষ এসবের প্রতি আমরা কোনো সহানুভূতি দেখাতে পারছি না এটাই বিরাট দুঃখ। আর আমাদের সাথে তো বহির্বিশ্বের সম্পর্ক নিবিড়, এটাও ভাল দিক। আর দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে অন্যদের মতো আমিও খুব আশাবাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমঞ্চে নারী
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের দুই কথাসাহিত্যিক