‘সামগ্রিক পরিবেশ ভালোই লাগছে। ঢাকার বইমেলায় যেসব বই পাওয়া যায় এমন বই এখানে পাচ্ছি। কিছু ভালো প্রকাশনের স্টল আসছে, যেখানে গবেষণা এবং প্রবন্ধের বই পাওয়া যাচ্ছে। অনেক প্রকাশনা আছে যাদের প্রকাশিত প্রবন্ধের বই সারাবছর সংগ্রহ করি স্থানীয় লাইব্রেরি থেকে। অনেক সময় লাইব্রেরিতে কাঙ্ক্ষিত বই পাই না। মেলায় ওসব প্রকাশনার স্টল থেকে প্রত্যাশিত বইগুলো সংগ্রহ করতে পারছি।’
গতকাল বুধবার বইমেলায় কথাগুলো বলছিলেন সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক মো. গোলাম মোস্তফা। এসময় তার সঙ্গে থাকা একই কলেজের একই বিভাগের প্রভাষক মো. আলতাফ উদ্দীন বলেন, যে ধরনের বই খুঁজছি তা পেয়ে ভালো লাগছে।
এই দুই শিক্ষকের কথা থেকে স্পষ্ট নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে চলমান বইমেলায় এসে সন্তুষ্ট হচ্ছে পাঠক। কাঙ্ক্ষিত বই পেয়ে আনন্দে বাড়ি ফিরছেন তারা। তবে পাঠক সন্তুষ্ট হলেও বিক্রেতাদের বক্তব্যে পাওয়া যাচ্ছে ভিন্নতা। কেউ বলছেন বিক্রি ভালো, কেউ বলছেন মোটামুটি। যেমন ‘কথা বিচিত্রা’ এর কিশোর হাবীব বলেন, সবকিছু মিলিয়ে অবস্থা খারাপ। বেশিরভাগ লোক এমনি আসে, বই কেনে না। আসলে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না। তবে প্রকাশনা সংস্থা ‘দ্বিমত’ এর এর ম্যানেজিং পার্টনার হোসাইন জাহিদ বলেন, বিক্রি খারাপ না। মোটামুটি ভালো হচ্ছে।
এদিকে প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে বিক্রির তালিকায় এগিয়ে থাকা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে– জিললুর রহমান এর ‘কবিতা পাঠে পাঠান্তরে’, রিজোয়ান মাহমুদ এর ‘এই হাত হাজার দুয়ারি’, ফারজানা রহমান শিমু এর অনুবাদগ্রন্থ (মূল লেখক– জয় শেঠি) ‘থিংক লাইক আ মঙ্ক–অপার শান্তির নিশ্চিত ঠিকানা’ এবং রশীদ এনাম এর ‘একাত্তরের জলপুত্র মুক্তিযোদ্ধা সুনীল কান্তি জলদাস’।
‘থিংক লাইক আ মঙ্ক–অপার শান্তির নিশ্চিত ঠিকানা’ গ্রন্থটি মোটিভেশনাল বই। শান্তিপূর্ণ জীবন–যাপনের জন্য কোন বিষয়গুলো অপরিহার্য তার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। শান্তি, এবং সাফল্য একে অন্যের পরিপূরক মনে হলেও কখনো কখনো সফলতা কিন্তু মনের শান্তি কেড়ে নেয়। সাফল্য এবং শান্তিকে কীভাবে একসঙ্গে রেখে এগিয়ে যাওয়া যায় তা ফুটে উঠে ‘থিংক লাইক আ মঙ্ক’ এ।
পটিয়ার একমাত্র জলদাস মুক্তিযোদ্ধা সুনীল জলদাস। তিনি জলের সঙ্গে যুদ্ধ করে সংসার চালাতেন। নিষ্পেষিত জলদাসরা যখন পরিবারের অন্ন জোগাড় করার জন্য জাল নিয়ে খালে–বিলে দৌড়াত ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে জাল ফেলে দেশের জন্য অস্ত্র কাঁধে তুলে নেন। তার সে গল্প উঠে আসে ‘একাত্তরের জলপুত্র’ গ্রন্থে।
‘কবিতা পাঠে পাঠান্তরে’ এর ফ্ল্যাপে লেখা হয়, মুহুর্মুহু উচ্চারিত স্লোগানের মর্মকথন সেই মিছিলেরই একজন যখন বয়ান করেন– কে না জানে, নিখুঁত প্রকাশ তখনই সম্ভব হয়। জিললুর রহমান সেই অনন্য একজন কথক যিনি মিছিলের সতীর্থদের মর্মজ্বালার নিপুণ বিশ্লেষণ করেছেন এ গ্রন্থের পরতে পরতে। কখনও সে আলাপ পৌঁছে গেছে আবুল হাসান হয়ে মধুসূধনে, আবার পাঁজর ফোঁড়ে ঢুকে পড়েছে ব্যক্তিগত হৃদয়ে। তাই আমরা এখানে সমকালীন বাংলা কবিতার একটা ধ্যানী মিছিলের পাশাপাশি তার উৎসমূলেরও সাক্ষাৎ পাবো।
‘এই হাত হাজার দুয়ারি’ এর ফ্ল্যাপে লেখা হয়, সমসময়কে শুধু আত্মস্থ নয়, অতিক্রমও করতে হয় কবিদের সচেতনভাবে। ঔপনিবেশিক–উত্তর একটি কালকে নির্ণয় করে কবি কেবল ব্যক্তিপ্রেমের কবিতা লেখেন না, কবিতার বাঁকবদলের বয়ান, তত্ত্ব ও ইতিহাস নিয়ে থাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ। তবু একজন কবি শেষাবধি তাত্ত্বিক নন, আমৃত্যু কবি। কবি রিজোয়ান মাহমুদ এসব দার্শনিক ভাবনাকে অভিযোজন করেছেন বিচ্ছিন্নতাবোধের বিপরীতে দাঁড়িয়ে। কবি এখানে চমৎকার সাযুজ্য খুঁজে পান রবীন্দ্রনাথের আফ্রিকার অতল অন্ধকারে আত্মমগ্ন পরিপার্শ্বকে। এই হাত হাজার দুয়ারি’র স্পর্শে প্রত্যক্ষদর্শীর পর্যবেক্ষণে দ্রাক্ষাফলের মতো সতেজ হয়ে ওঠে অচল শব্দ।
প্রসঙ্গত, মেলার আয়োজক চসিক। তবে চট্টগ্রামের সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদ, নাগরিক সমাজ, বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য শিল্প–সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরাই সম্মিলিতভাবে এ মেলা বাস্তবায়ন করছেন। সম্মিলিত উদ্যোগে এবারের মেলাটি চতুর্থ আয়োজন। মেলা প্রতিদিন বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা ও ছুটির দিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকে। মেলায় ১০৮ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ১৪০টি স্টল রয়েছে। এর মধ্যে ডাবল স্টল ৩২টি এবং সিঙ্গেল স্টল ৭৬টি। মেলা প্রাঙ্গণের আয়তন এক লাখ দুই হাজার ৩০০ বর্গফুট।
‘মায়াভবন’ এর মোড়ক উন্মোচন : গতকাল বইমেলায় অমর একুশে বইমেলায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের স্টলে সাংবাদিক আবু মোশাররফ রাসেল এর ‘মায়াভবন’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মোড়ক উন্মোচন করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাওয়া তিনজন বিশিষ্ট লেখক–সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী, রাশেদ রউফ ও মুহাম্মদ শামসুল হক। বইটির প্রকাশক হোসাইন তৌফিক ইফতিখারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কবি–সাংবাদিক ওমর কায়সার ও এজাজ ইউসুফী, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের সভাপতি সালাহউদ্দিন মো. রেজা, সহ–সভাপতি মনজুর কাদের মনজু, শিক্ষক–প্রশিক্ষক ড. শামসুদ্দিন শিশির, রাজনীতিবিদ ফরিদ মাহমুদ, দৈনিক সমকালের চট্টগ্রাম রিজিওনাল এডিটর সারওয়ার সুমন, বইয়ের লেখক আবু মোশাররফ রাসেল, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের গ্রন্থাগার সম্পাদক আহমেদ কুতুব, লেখক–সাংবাদিক আহসানুল কবির রিটন, সাংবাদিক আরিফ রায়হান ও শামসুদ্দিন ইলিয়াস।