সমালোচনার মুখে কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব বাতিলের পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। গতকাল রোববার পরিষদের বৈঠকে আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাজেটের এ আকার চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ৭ হাজার কোটি টাকা কম। তবে ব্যয়ের এ আকার চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের (৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা) চেয়ে ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি। টাকার ওই অংক বাংলাদেশের মোট জিডিপির ১২.৬৫ শতাংশের সমান।
সংযত থাকার এ বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি মাপার সূচক জিডিপিতেও কম সাহসী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। আসছে অর্থবছরের জন্য ৫ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে, যা বহু বছরের মধ্যে কম। জিডিপির ক্ষেত্রে সংযমী হলেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। বাজেটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমিয়ে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। খবর বিডিনিউজের।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে তার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বাজেটে চূড়ান্ত সংশোধনের তথ্যগুলো তুলে ধরেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
গত ২ জুন রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব তুলে ধরেন অর্থ উপদেষ্টা। প্রস্তাবিত বাজেটে তিনটি পরিবর্তন করে বাজেট পাস করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বরাদ্দ ৮১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা করা হয়েছে।
অর্থ সচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার বলেন, এ খাতে ৯১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে, যা ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাজেটে ছিল ৯০ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। অবসরভাতা ও সঞ্চয়পত্রের সুদ এতে অন্তর্ভুক্ত নেই।
ইতোপূর্বে ঘোষিত সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বিশেষ সুবিধা চাকরিরতদের জন্য ন্যূনতম ১,৫০০ টাকা এবং পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে ন্যূনতম ৭৫০ টাকা করা হয়েছে। যাদের নিট পেনশন ১৭ হাজার ৩৮৮ টাকার বেশি তাদের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ এবং এর চেয়ে কমের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ হারে বিশেষ সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। সরকারি চাকরিজীবীদের পাশাপাশি সশস্ত্র বাহিনী, বিচারপতি এবং এমপিওভুক্তদের ক্ষেত্রে পৃথক আদেশ করার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পরবর্তী সময়ে রপ্তানিনির্ভর প্রণোদনা ধীরে ধীরে প্রত্যাহারের তৃতীয় ধাপ হিসেবে হ্রাসের কার্যক্রম ২০২৫ সালের ১ জুলাইয়ের পরিবর্তে ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের জন্য সরকার যে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার ব্যয় প্রস্তাব করেছে তাতে মোট উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। এ খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে ৩৫ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা। সদ্য সমাপ্ত ২০২৪–২৫ অর্থবছরে তা ছিল ২ লাখ ৮১ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা।
উন্নয়ন ব্যয় কমানোর মধ্যে শুধু বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) খাতেই চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে কমেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। আর সংশোধিত এডিপির চেয়ে কমেছে ১৪ হাজার কোটি টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে এডিপির আকার ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। সংশোধন করে তা ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আগামী অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা।
আসছে অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেওয়া হবে ১ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ অন্য উৎসের মধ্যে সরকার ব্যাংক খাত থেকে নিতে চায় ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এছাড়া সঞ্চয়পত্র থেকে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ও নন–ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার ২১ হাজার কোটি টাকা নেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।
ঘাটতি পূরণে বিদেশি উৎস থেকে ১ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিতে চায় সরকার। বাজেট ঘাটতি গত ১৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর আগে ২০১০–১১ অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ছিল ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
বিদায়ী অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গত মার্চে তা সংশোধন হলে ঘাটতি দাঁড়ায় ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪ শতাংশের সমান। রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ৮.৯ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে। বাকি ৬৫ হাজার কোটি টাকা আহরণ হবে অন্যান্য উৎস থেকে। তবে চলতি অর্থবছরে বাস্তবে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হচ্ছে এনবিআরের মাধ্যমে তার সঙ্গে তুলনা করলে আসছে অর্থবছরের ৩০ শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল : বাংলানিউজ জানায়, ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন করার সময় ‘কালো টাকা সাদা করার সুযোগ’ পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এর আগে প্রস্তাবিত বাজেটে অ্যাপার্টমেন্ট বা ফ্ল্যাট কেনা এবং ভবন নির্মাণে অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। গতকাল বিকালে সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলনকক্ষে বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
কালো টাকা সাদা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বাড়তি কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তবে বিভিন্ন পক্ষের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সেই বিধান বাতিল করা হয়েছে। ফলে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ আর থাকছে না।
জমি নিবন্ধনে উৎসে কর আরো ১ শতাংশ কমল : বিডিনিউজ জানায়, আবাসন খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বাতিল করার পাশাপাশি আবাসন খাতের সংগঠন রিহ্যাবের দাবির মুখে আসছে বাজেটে জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে উৎসে কর আরো কমিয়েছে সরকার। প্রকৃত বিক্রয়মূল্যে ভূমি নিবন্ধন উৎসাহিত করতে আসছে অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এলাকা ও জমির শ্রেণিভেদে বিদ্যমান ৮, ৬ ও ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ করা হয়। এবার আরো ১ শতাংশ কমিয়ে ৫, ৪ ও ২ শতাংশ করা হয়েছে। এ পরিবর্তন এনে গতকাল ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট অনুমোদন দিয়েছে উপদেষ্টা পরিষদ।
জমি নিবন্ধনে উৎসে কর কমানোর বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টার দপ্তরে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান খান বলেন, যেহেতু আমরা কালো টাকা সাদার বিধান তুলে দিলাম, এখানে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর একটা দাবি ছিল যেন জমি নিবন্ধনে উৎসে কর কমানোর একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়। এ বাজেটে দামি এলাকার জন্য উৎসে কর ৮ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়েছিল। এখন আমরা আরো ১ শতাংশ কমিয়ে ৫ শতাংশ করেছি। আর যেসব এলাকায় ৬ শতাংশ ছিল সেসব এলাকায় আমরা ৩ শতাংশ করেছি। আর যেগুলো ৪ শতাংশ ছিল সেগুলো ২ শতাংশ। অর্থাৎ আমরা চাচ্ছিলাম, যাতে লোকজন দাম বেশি হলে জমির দাম ঠিকঠাক দেখাবে না, সেখান থেকে যেন বেরিয়ে যায়।
আইনের এ পরিবর্তনটি রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে নির্দিষ্টকরণ অধ্যাদেশের গেজেট আকারে প্রকাশিত হবে। অধ্যাদেশটি জারি করার পর তা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়ে যাবে।