সিটি গভর্নেন্স প্রজেক্টের (সিজিপি) আওতায় জাইকার অর্থায়নে ২০২০ সালে নগরের চট্টগ্রাম কলেজ রোডে জিআই পোল ও এলইডি বাতি স্থাপন করে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। গত জুলাই মাসে এলইডি বাতি স্থাপনে ভারতীয় ঋণ সহায়তার ২৬০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে চসিক। এলওসি নামে পরিচিত এ প্রকল্পেও এলইডি বাতি স্থাপনের তালিকায় রয়েছে কলেজ রোডের নাম। অর্থাৎ অতীতে বাতি লাগানো হয়েছে এমন সড়ককে আবারও বাতি লাগানোর জন্য বাছাই করেছে চসিকের বিদ্যুৎ উপ–বিভাগ।
শুধু কলেজ রোড নয়; আজাদীর অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এলওসি প্রকল্পটিতে রয়েছে এমন ৪৮টি পৃথক সড়ক সংস্থাটির অন্য প্রকল্পেও রয়েছে। যার কয়েকটিতে অতীতে এলইডি বাতি স্থাপন করা হয়েছে এবং কয়েকটিতে এলইডি বাতি স্থাপনের কাজ চলছে। অর্থাৎ এক সড়ককে বাতি স্থাপনের জন্য রাখা হয়েছে দুই প্রকল্পে। এতে ‘দ্বৈততার’ সুযোগে প্রকল্পের অর্থ ‘নয়ছয়’ হওয়ার আশঙ্কা করছেন সচেতন মহল। এছাড়া অন্য কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা সেটাও খতিয়ে দেখার দাবি করেন তারা।
জানা গেছে, ওই ৪৮টি সড়কের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৪২ কিলোমিটার। এর মধ্যে তিনটি সড়কে জাইকার অর্থায়নে এলইডি বাতি স্থাপন কাজ শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে। প্রায় একই সময়ে পিডিবির সহায়তায় একটি এবং চসিকের নিজস্ব অর্থায়নে দুটি সড়কে এলইডি বাতি স্থাপন করা হয়েছে। বাকি ৪২টি সড়কে বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় কোভিড প্রজেক্ট–১ ও ২ এর আওতায় বাতি স্থাপন কাজ চলছে; যা প্রায় শেষ পর্যায়ে। একই সড়ক একাধিক প্রকল্পভুক্ত করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, বিষয়টি আমার নলেজে ছিল না। কালকেই প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের ডেকে ডিটেইলস জেনে নেব। কেন এমন হয়েছে জানি না, তবে নিশ্চিত থাকতে পারেন প্রকল্পকে ঘিরে কোনো অনিয়ম করতে দেওয়া হবে না।
এ বিষয়ে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই এলওসি প্রকল্পের ঠিকাদারের সাথে চুক্তি হয়েছে। জাইকা ও কোভিড প্রকল্পগুলোও আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে কাজ শুরু হয় বা শেষ হয়েছে। এলওসি প্রকল্পটির যাবতীয় বিষয় খতিয়ে দেখছি। প্রকল্প ঘিরে অতীতে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে অনিয়মে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভবিষ্যতেও কেউ অনিয়ম করতে পারবে না।
এলওসি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা চসিকের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) ঝুলন কুমার দাশ আজাদীকে বলেন, প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১৭ সালে। দীর্ঘ সময় হওয়ায় এক ধরনের অনিশ্চয়তা ছিল এটার বাস্তবায়ন নিয়ে। তাই তৎকালীন প্রশাসনে যারা ছিলেন তাদের নির্দেশে গুরুত্বপূর্ণ কিছু সড়ক কোভিড ফান্ড থেকে করে ফেলা হয়। তবে এখানে ওভার লেপিং হওয়ার সুযোগ নেই। এলওসি প্রকল্পের কাজ শুরু হলে কোভিড ফান্ডে হওয়া সড়কগুলো বাদ দেওয়া হবে। সেখানে নতুন সড়ক অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
৪৮ সড়কের তালিকা : এলওসি প্রকল্পভুক্ত ৪৮ সড়ক হচ্ছে বায়েজিদ থানা রোড (টেক্সটাইল থেকে মোহাম্মদনগর), কুঞ্জছায়া আবাসিক এলাকা, শীতল ঝরনা সড়ক, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ০১–১৩ নং ব্লক, হিলভিউ আবাসিক এলাকা জামে মসজিদ ২ নং রোড, শুলকবহর মাদ্রাসা থেকে মির্জারপুল পর্যন্ত, গ্রিন ভ্যালি আবাসিক এলাকা, গার্লস স্কুল আব্দুল কাদের রোড, পথকলি রোড, মো. জামান সড়ক, কসমোপলিটন আবাসিক এলাকা, খুলশী রোড নং ১–৫, গ্রিনভিউ আবাসিক এলাকা, টাংকির পাহাড় চানমারি রোড, পূর্ব বাঘঘোনা–দক্ষিণ বাঘঘোনা, রেবতি মোহন লেইন, চন্দনপুরা পূর্ব গলি ও গুলএজার বেগম স্কুল গলি, মকবুল সওদাগর লেইন, কলেজ রোড, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ১, ২ ও ৩ নং রোড, মিয়া খান রোড, রুমঘাটা গুরামিয়া চৌধুরী লেইন, লাভলেইন গলি, আবেদীন কলোনি, ধোপা পাড়া রাবেয়া রহমান গলি, আসকারদিঘি পাড় অফিসার্স লেইন, রামকৃষ্ণ মিশন, কবি গুনাকর লেইন, আসকারদিঘির পশ্চিম পাড় পর্যন্ত, বাটালী রোড, বরফ গলি ও এতিমখানা রোড, রেলওয়ে হাসপাতাল থেকে শহীদ মিনার, বাউবি থেকে রেলওয়ে হাসপাতাল, জেলা পুলিশ বাসভবন থেকে কদমতলী সিএনজি পাম্প পর্যন্ত, আজু শাহ মাজার গেট, মতিয়ারপুল মুখ থেকে মোগলটুলী ও মসজিদ গলি বাইলেইন, ডেবার পাড় দক্ষিণ পাশ, রেডিও অফিস থেকে পানির ট্যাংক পর্যন্ত, যুগীচাঁদ ও বায়তুশ জান্নাত মসজিদ, দক্ষিণ নালাপাড়া লেইন, বাইলেইন ১–৩, উত্তর নালাপাড়া কালিবাড়ি থেকে কলেজিয়েট মোড়, চৈতন্যগলি কবরস্থানের ভিতরের রাস্তা, পুরাতন গির্জা, কোর্ট হিল, কুমিল্লা মামার মাজার, সেবক কলোনি থেকে পশু হাসপাতাল মোড়, শহিদ মিনার পার্ক, অভয়মিত্র ঘাট রোড, আশরাফ আলী রোড, চামড়া গুদাম, কলাবাগিচা মসজিদ গলি, আবদুল লতিফ সড়ক–পশ্চিম নিমতলা মেইন রোড, এজহার মেম্বার, গফুর সওদাগর বাড়ি রোড, আবু জাফর সড়ক, জলিল শাহ রোড, আবদুল লতিফ রোড বাইলেইন, পূর্ব কাটগড় রোড হাজি শফির বাড়ি পর্যন্ত, টিএসপি মেইন রোড, হাদিপাড়া ডা. নুর আলমের বাড়ি থেকে তালুকদার বাড়ি মসজিদ এবং নিজাম মার্কেট মেইন রোড বাইলেইন।
এলওসি প্রকল্পে কী হবে : ২০১৯ সালের ৯ জুলাই একনেকে অনুমোদন হয় ‘মর্ডানাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্স এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ শীর্ষক প্রকল্পটি। দীর্ঘসূত্রতা পেরিয়ে ২৬০ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ৬ জুলাই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান শাপার্জি পালনজি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেডের সাথে চুক্তি করে চসিক।
প্রকল্পটির আওতায় নগরের ৪১ ওয়ার্ডে ৪৬৬ দশমিক ৭৪ কিলোমিটার সড়কে ২০ হাজার ৬০০টি এলইডি বাতি স্থাপন করা হবে। প্রকল্পে ঋণ হিসেবে ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ অর্থের যোগান দেবে ভারত। তাই ঠিকাদার নিয়োগসহ বিভিন্ন ধাপে দেশটির চূড়ান্ত অনুমোদন না পাওয়ায় এতদিন আটকে ছিল প্রকল্পটি। প্রকল্পটিতে বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে এলওসি–৩ (লাইন অব ক্রেডিট) এর আওতায় এ প্রকল্পে ঋণ হিসেবে ভারতের দেওয়া অর্থের পরিমাণ ২১৪ কোটি ৪৬ লাখ ৮২ হাজার টাকা। অবশিষ্ট ১৭ দশমিক ৮০ শতাংশ বা ৪৬ কোটি ৪৩ লাখ ৫ হাজার টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার।
প্রকল্পের আওতায় শহরের ৪১ ওয়ার্ডে ৪০, ৬০, ১০০ ও ২৫০ ওয়াটের ২০ হাজার ৬০০টি এলইডি বাতি, ২০ হাজার ২৬৭টি জিআই পোল এবং ৫০৭টি কন্ট্রোল সুইচ বক্স বসানো হবে। পাঁচ মিটারের বেশি প্রশস্ত সড়কগুলোতে এসব বাতি লাগানো হবে। এছাড়া হাইড্রোলিক বীম লিফটার ও ইলেকট্রিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহ করা হবে। এটি চসিকের ইতিহাসে আলোকায়নের জন্য গৃহীত সর্ববৃহৎ প্রকল্প।
প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা বিষয়ে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল আজাদীকে বলেন, দুয়েকদিনের মধ্যে প্রকল্পের বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়ে মন্ত্রণালয়ে লিখব।
এদিকে ইতোপূর্বে সমাপ্ত হওয়া জাইকা প্রকল্পটির উদ্বোধন হয় ২০২০ সালের ৯ জুন। চারটি প্যাকেজে এ প্রকল্পের আওতায় ৩০টি সড়কে ৪১ কোটি ৮৩ লাখ টাকার এলইডি বাতি লাগানো হয়।