চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের বহির্বিভাগ এবং ওয়ার্ডে সেবা নিতে প্রতিদিনই ভিড় করছেন ডায়াবেটিস রোগীরা। তবে চিকিৎসকরা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেতন হওয়ার ওপর গুরুত্ব বেশি দিচ্ছেন। ডায়াবেটিসকে নীরব ঘাতক বলা হয়। কারণ ডায়াবেটিস আক্রান্ত অর্ধেক লোক জানেই না, তারা এ রোগে আক্রান্ত। এমন পরিস্থিতিতে ‘ডায়াবেটিস : সুস্বাস্থ্যই হোক আমাদের অঙ্গীকার’–এই প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পালিত হবে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস।
চিকিৎসকরা জানান, রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেশিদিন ধরে বেশি থাকলে ডায়াবেটিস রোগ দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের নানা প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্যান্য রোগের ফলেও ডায়াবেটিস হয়ে থাকে। সব বয়সীদের এ রোগ হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। বলা যায়–এটি আজীবনের রোগ। ঘন ঘন প্রশ্রাব, অত্যধিক পিপাসা লাগা, বেশি ক্ষুধা পাওয়া, দুর্বল বোধ করা এবং কেটে ছিঁড়ে গেলে ক্ষতস্থান তাড়াতাড়ি না শুকানোই হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। ডায়াবেটিস প্রতিরোধে প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল ও মোটা শস্যদানা জাতীয় খাবার খেতে হবে। এতে টাইপ–২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। এছাড়া ডায়াবেটিসের বোঝা কমানোর জন্য অবশ্যই স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খেতে হবে। সুষম খাবার টাইপ–২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনে। তবে বর্তমানে হাইক্যালরি ও অপুষ্টিকর সস্তা খাবার বিশেষত ফাস্টফুড গ্রহণ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে টাইপ–২ ডায়াবেটিস। এছাড়া স্থূলতা, কায়িক পরিশ্রম না করাও ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম একটি কারণ। তবে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করলে রোগী নিজেই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
চমেক হাসপাতাল এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে টাইপ–২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়ে ৮২৫ রোগী ভর্তি ছিলেন। এছাড়া টাইপ–১ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ভর্তি সংখ্যা ছিল ২৫ জন এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে ৫৫ জন রোগী ভর্তি ছিলেন। অপরদিকে গত এক বছরে এন্ডোক্রাইনোলজি বহির্বিভাগে টাইপ–২ ডায়াবেটিস আক্রান্ত ১৮ হাজার রোগী সেবা নিয়েছেন। এছাড়া টাইপ–১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৯০ জন এবং গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ৪০০ রোগী সেবা নিয়েছেন।
চিকিৎসকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এন্ডোক্রাইনোলজি ওয়ার্ডে মোট শয্যা আছে ১৬টি। এরমধ্যে ৮টি পুরুষ এবং ৮টি মহিলার জন্য সংরক্ষিত। তবে বর্তমানে ডায়াবেটিস ও অন্যান্য হরমোন রোগ বাড়ার কারণে নির্ধারিত শয্যার বাইরে দেড় থেকে দ্বিগুণ বেশি রোগী ভর্তি থাকছে। শয্যার অতিরিক্ত রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। ওয়ার্ডে নেই কোনো এইচডিইউ বেড। জটিল রোগীদের তাই বাধ্য হয়ে মেডিসিন ওয়ার্ডে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এতে রোগীদের চিকিৎসা ও ফলোআপ করতেও ডায়াবেটিস চিকিৎসকদের মেডিসিন ওয়ার্ডে দৌঁড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। তাই ওয়ার্ডে অন্তত চারটি এইচডিইউ বেড স্থাপনসহ মোট শয্যা ১৬ থেকে ৩২ এ উন্নীত করা প্রয়োজন।
এদিকে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলে কলেজের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগে বর্তমানে একজন সহযোগী অধ্যাপক, দুইজন সহকারী অধ্যাপক এবং একজন সহকারী রেজিস্ট্রার কর্মরত আছেন। অন্যদিকে রেজিস্ট্রারের পদই সৃষ্টি হয়নি। এছাড়া ওয়ার্ডে নেই কোনো ইনডোর মেডিকেল অফিসার। বিভিন্ন বিভাগ থেকে আগত স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী এবং অনারারি চিকিৎসক দিয়ে ওয়ার্ড চালাতে হচ্ছে। এছাড়া একমাত্র সহকারী রেজিস্ট্রারকে ওয়ার্ড এবং বহির্বিভাগ দুটোই সামলাতে হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ওয়ার্ডের জন্য ৪ জন মেডিকেল অফিসার এবং বহির্বিভাগের জন্য ৪ জন মেডিকেল অফিসার পদায়ন করা জরুরি বলে মত দিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চমেক হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার দৈনিক আজাদীকে বলেন, ডায়াবেটিস আজীবনের রোগ। এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময়ের কোনো সুযোগ নেই। তবে বর্তমানে ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসার নামে অনেক অপচিকিৎসা চলছে। এখানে কিটো ডায়েট তত্ত্ব সামনে এনে বলা হচ্ছে– ওষুধ না খেয়েই ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে অনেক চটকদার বিজ্ঞাপনও হচ্ছে। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে– এ তালিকায় স্বীকৃত মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাস করা ডাক্তারও কিটো ডায়েট তত্ত্ব নিয়ে ‘ফেসবুক–ইউটিউবে ভিউ’ ব্যবসা করছেন। সাধারণ মানুষ তাদের সেই তত্ত্ব গ্রহণ করছে। এছাড়া ডায়াবেটিসের রোগের চিকিৎসায় অনেকে মনে করেন–একবার ইনসুলিন দিলে সারা জীবন দিতে হবে। আসলে ইনসুলিন দেয়ার পরে অবস্থার উন্নতি হলে আবার মুখের ওষুধে ফিরিয়ে আনা যায়। সাধারণ মানুষকে এসব বিভ্রান্তি থেকে সরে আসতে হবে। কোনো ধরনের অপপ্রচারে প্রলুব্ধ হয়ে অপচিকিৎসা নেয়া যাবে না।