যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই যে জয়ী হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। একজন প্রার্থী তুলনামূলক কম ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। এর মূলে আছে দেশটির নির্বাচন ব্যবস্থায় ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ নামের ২০০ বছর পুরনো একটি বিশেষ পদ্ধতি। এই ইলেকটোরাল কলেজে যিনি ভালো ফল করেন তার হাতেই যায় হোয়াইট হাউসের চাবি। এ নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটারদের সরাসরি ভোটে না বরং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পরোক্ষ ভোটে। খবর বিডিনিউজের।
দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে প্রার্থীকে সাধারণত দুই ধরনের ভোটে জিততে হয়। এর একটি নাগরিকদের সরাসরি ভোট, যা ‘পপুলার ভোট’ হিসেবে পরিচিত; আরেকটি হচ্ছে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এই দুটির মধ্যে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটেই প্রার্থীর চূড়ান্ত জয়–পরাজয় নির্ধারিত হয়। এ ব্যবস্থায় প্রার্থীদের জয়–পরাজয় জাতীয়ভাবে না হয়ে নির্ধারিত হয় একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে। দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো অঙ্গরাজ্যে পপুলার ভোটে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পের চেয়ে ৩০ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেলেও ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে হেরে পরাজিত হয়েছিলেন। কী এই ইলেকটোরাল কলেজ : যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে একদল কর্মকর্তাকে নির্বাচিত করে থাকেন, তাদের বলা হয় ইলেকটর। এই ইলেকটররাই নির্বাচকের ভূমিকা পালন করেন। একটি রাজ্যের ইলেকটরদের একসঙ্গে ইলেকটোরাল কলেজ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিসহ (ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া) দেশটিতে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ৫১টি। এই ইলেকটোরাল কলেজই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করে।
এক একটি রাজ্যে ইলেকটরের সংখ্যা একেকরকম। এটি নির্ধারিত হয় মার্কিন কংগ্রেসে রাজ্যের কতজন প্রতিনিধি ও সিনেটর আছেন সে হিসেবে। জনসংখ্যার ওপর রাজ্যগুলোর প্রতিনিধির সংখ্যা নির্ভর করে, প্রতি ১০ বছর পর পর আদমশুমারির মাধ্যম এটি নির্ধারণ করা হয়। এতে ১০ বছর পর পর অঙ্গরাজ্যগুলোর ইলেকটরের সংখ্যারও হ্রাস–বৃদ্ধি ঘটে।
সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের দুই কক্ষে থাকা আসনের (প্রতিনিধি পরিষদে ৪৩৫, সেনেটে ১০০) বিপরীতে রাজ্যগুলো তাদের জন্য নির্ধারিত ইলেকটর পায়। কংগ্রেসে রাজধানী অঞ্চল ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার কোনো প্রতিনিধি না থাকলেও সেখান থেকে আসেন তিনজন ইলেকটর। নির্বাচনের দিন ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিলেও আসলে তারা ৫১টি ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮ জন ইলেকটর নির্বাচিত করে তাদের হাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব তুলে দেন।
প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে এই ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে অন্তত ২৭০টি নিশ্চিত করতে হয়। অর্ধশত রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই হাতে আসে হোয়াইট হাউজের চাবি।
‘উইনার–টেইক–অল’ : বেশিরভাগ রাজ্যে নিয়ম হল– ‘উইনার–টেইক–অল’। মানে কোনো রাজ্যে যদি দশটি ইলেকটোরাল ভোট থাকে, তার মধ্যে যে দল অন্তত ছয়টি, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ইলেকটোরাল ভোট পাবে, ওই রাজ্যের সবগুলো অর্থাৎ দশটি ইলেকটোরাল ভোটই সেই দলের বলে গণ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮টি রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় এই নিয়ম অনুসরণ কর হয়। কিন্তু নেব্রাস্কা ও মেইন রাজ্যে ‘উইনার–টেইক–অল’ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না, এখানে প্রার্থীদের পাওয়া ভোটের অনুপাতে ইলেকটোরাল ভোট ভাগ করে দেওয়া হয়।
জনগণের সরাসরি ভোটে এগিয়ে থেকেও ইলেকটোরাল ভোটে হেরে যাওয়ার নজির আছে যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভোটের হিসাবে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিলারি রিপাবলিকান ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট বেশি পেলেও ইলেকটোরাল ভোটের হিসাবে হেরে যান। তার আগে ২০০০ সালে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী আল গোরের কাছে সরাসরি ভোটে হেরে যাওয়ার পরও রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশ ইলেকটোরাল ভোটে জিতে হোয়াইট হাউজের টিকেট পেয়েছিলেন।
ভোটাররা কাকে বেশি ভোট দিলেন তা বিবেচনা না করেই কিছু রাজ্যের ইলেকটররা তাদের পছন্দমতো যে কোনও প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে ইলেকটররা তাদের রাজ্যে যে প্রার্থী বেশি ভোট পেয়েছেন প্রায় সবসময় তাকেই ভোট দেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাজ্যের বেছে নেওয়া প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট দিলে ওই ইলেকটরকে ‘অবিশ্বস্ত’ বলা হয়। ২০১৬ সালে এ রকম সাতটি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পড়েছিল, কিন্তু অবিশ্বস্ত ইলেকটররা ফলাফল পরিবর্তন করতে পারেননি।
যদি কোনো প্রার্থীই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায় তাহলে কী হবে? এরকম কোনও পরিস্থিতি হলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী অনুযায়ী কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ–প্রতিনিধি পরিষদে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে আর সেনেট ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ পর্যন্ত মাত্র একবার এমনটি ঘটেছিল। ১৮২৪ সালে চার জন প্রার্থীর মধ্যে ইলেকটোরাল ভোট ভাগাভাগি হওয়ার পর তাদের মধ্যে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কিন্তু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতিতে দুই রাজনৈতিক দলের আধিপত্য তৈরি হওয়ায় এখন আর তেমনটি হবে না বলে ধরে নেওয়া হয়।
ভোটের ফল কখন পাওয়া যাবে : প্রতিটি ভোট গণনা করতে কয়েক দিনও লেগে যেতে পারে। তবে সাধারণত যেদিন ভোট হয়, তার পরের দিন সকালেই জয়ী কে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। নির্বাচনের সব মনোযোগ ট্রাম্প না হ্যারিস জিতছেন, তার ওপর নিবদ্ধ থাকলেও এই নির্বাচনে ভোটাররা আসলে প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি কংগ্রেসের নতুন সদস্যদেরকেও বেছে নেবেন। একইদিন অঙ্গরাজ্যগুলোর গভর্নর ও আইন পরিষদ নির্বাচনের ভোটও গ্রহণ করা হবে।
নির্বাচনে কমলা হ্যারিস বা ট্রাম্প জয়ী হলেই যে সঙ্গে সঙ্গে আগের প্রেসিডেন্টের স্থলাভিষিক্ত হবেন, তা নয়। কারণ, নতুন নেতাকে মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী নিয়োগ করা এবং অন্যান্য পরিকল্পনার জন্য কিছুটা সময় নিতে হয়। এরপরই নতুন প্রেসিডেন্ট আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নিতে পারেন। সাধারণত এই শপথ হয় ২০ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসির ক্যাপিটল ভবনে। শপথ অনুষ্ঠানের পরই নতুন প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউজে যান চার বছর মেয়াদে দায়িত্ব পালনের জন্য।