বাংলা সাহিত্যের প্রধান দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম। অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় চরম স্বার্থকতা লাভ করেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে যে সীমাহীন অবদান রেখে গেছেন তা সারা পৃথিবীর সাহিত্যিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক। তাইতো তিনি বিশ্বকবি। অন্যদিকে বাংলাসাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাত কাজী নজরুল ইসলাম বৈচিত্র্য ও উৎকর্ষের দিক থেকে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। সমাজের প্রতিটি স্তরে নিপীড়িত জনগণের দীর্ঘশ্বাস দেশের বাতাস বিষাক্ত করেছে। নজরুল তখন বাংলাসাহিত্যে নতুন সুর সংযোজন করলেন নিপিড়ীত জনগণের প্রতি সহানুভূতির মাধ্যমে।
রবীন্দ্রকাব্য ও নজরুলকাব্যে মর্ত্যপ্রীতির নিদর্শন পাওয়া যায়। মানুষ, মানবতা নিয়ে দু’জনের ভাবনায় কোনো পার্থক্য নেই। রবীন্দ্রনাথ ‘চিত্রা’ কাব্যে ‘স্বর্গ হতে বিদায়’ কবিতায় লিখলেন–
‘….স্বর্গে তব বহুক্ অমৃত,
মর্ত্ত্যে থাক্ সুখে দুঃখে অনন্ত মিশ্রিত
প্রেমধারা–অশ্রু জলে চিরশ্যাম করি
ভূতলের স্বর্গখণ্ডগুলি!’
কাজী নজরুল ইসলাম উপলব্ধি করেছিলেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই–নহে কিছু মহীয়ান’।
রবীন্দ্রনাথের লেখায় অন্যায়ের প্রতিবাদ আছে, আছে অসত্যের প্রতি ঘৃণা প্রকাশও। নজরুল ইসলামের লেখায়ও আছে শোষণ বিরোধিতা ও দেশপ্রেম। তাই ‘অগ্নিবীণার’ ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় তিনি লিখেছেন–
‘মহা–বিদ্রোহী রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন– রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না–
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ–ভূমে রণিবে না—’
রবীন্দ্রনাথ যখন খ্যাতির মধ্য গগনে, তখন সম্পূর্ণ নিজস্ব সাবলীল ভঙ্গিতে সাহিত্য রচনা শুরু করেন নজরুল। তাঁদের পারষ্পরিক সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধার, স্নেহের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তখন কাজী নজরুল ইসলামের বয়স মাত্র ১৪ বছর। রবীন্দ্রনাথের জন্ম ১৮৬১ সালে, নজরুলের ১৮৯৯ সালে। দু’জনের বয়সের পার্থক্য ৩৮ বছর।
আকৈশোর রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা করতেন নজরুল। ‘বড়র পিরীতি বালির বাঁধ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বিশ্বকবিকে আমি শুধু শ্রদ্ধা নয়, পূজা করে এসেছি হৃদয় মন দিয়ে, যেমন করে ভক্ত তার ইষ্ট দেবতাকে পূজা করে, ছেলেবেলা থেকে তাঁর ছবি সামনে রেখে গন্ধ–ধূপ–ফুল–চন্দন দিয়ে সকাল–সন্ধ্যা বন্দনা করেছি। এ নিয়ে কত লোক কত ঠাট্টা–বিদ্রুপ করেছেন।’ এ থেকেই বোঝা যায় বাংলা সাহিত্যের দুই মহান কবির মধ্যে কী গভীর সুসম্পর্ক ছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘১৪০০ সাল’ কবিতা লেখেন ১৩০২ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে। কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ পরের পাঠককে বসন্তের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।
‘আজি হতে শতবর্ষ পরে
কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি
কৌতুহল ভরে, আজি হতে শতবর্ষ পরে।’
কাজী নজরুল ইসলাম ১৩৩৪ সালের আষাঢ় মাসে তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধা, ভক্তি সহকারে এর উত্তর লেখেন।
‘আজি হতে শতবর্ষ আগে
কে কবি, স্মরণ তুমি করেছিলে আমাদেরে
শত অনুরাগে,
আজি হ’তে শতবর্ষ আগে।’
রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন বাঙালির জীবন ও সাহিত্যে নজরুল বসন্তের অগ্রদূত। তাই নিজের লেখা ‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি কারারুদ্ধ নজরুলের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। জেলে নজরুলের উদ্দেশ্যে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় মারফত বই পাঠিয়ে, রবীন্দ্রনাথ বলে পাঠিয়েছিলেন, ‘আমি নিজের হাতে তাকে দিতে পারলাম না বলে সে যেন দুঃখ না করে। আমি তাকে আমার সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুণ্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বোলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা জাগাবার কবিওতো চাই।’ পরিবার পরিজনের বাইরে প্রথম কাউকে নোবেল বিজয়ী কবি তার বই উৎসর্গ করার ঘটনা। এই প্রসঙ্গে নজরুল নিজেই পরে অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন– ‘এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘বসন্ত’ নাটক আমায় উৎসর্গ করেন। তাঁর এই আশীর্বাদ–মালা পেয়ে আমি জেলের সর্বজ্বালা, যন্ত্রণা, ক্লেশ ভুলে যাই।’
‘বসন্ত’ গীতিনাট্যটি নজরুলকে উৎসর্গ করায় রবীন্দ্র অনুরাগী বেশ কয়েকজন কবি–সাহিত্যিক খুশি হতে পারেননি। কেউ কেউ নজরুলের সমালোচনা করে বলেন, ‘মার মার কাট–কাট ও অসির ঝনঝনার মধ্যে রূপ ও রসের প্রক্ষেপটুকু হারিয়ে গেছে।’ জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘কাব্যে অসির ঝনঝনা থাকতে পারে না, এও তোমাদের আবদার বটে।’ নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সঞ্চিতা’ কাব্য গ্রন্থটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে উৎসর্গ করেন।
সাহিত্যের ক্ষেত্রে ১৯২০ এর দিকে নজরুলের যখন আগমন, তখন রবীন্দ্রনাথ রয়েছেন গৌরবের পূর্ণতায়। নজরুল সৈনিক হিসেবে চাকরি নিয়ে ২১ বছর বয়সে কলকাতায় ফিরে আসেন। ওই সময় কলকাতার প্রবাসী, ভারতী, নবযুগ, মোসলেম ভারত প্রভৃতি পত্র–পত্রিকায় নজরুলের কবিতা ও অন্যান্য রচনা প্রকাশ হতে থাকে। পত্র–পত্রিকায় প্রকাশিত কবিতগুলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়তেন এবং নজরুলের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন ।
রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের সরাসরি দেখা হয়েছিল ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে শান্তিনিকেতনে, যখন নজরুলের বয়স ২২। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি কবিগুরুকে বলেছিলেন, ট্রেনে আসতে আসতে কাজী সাহেব আপনার গীতাঞ্জলি’র সব ক’টা গান আমাকে গেয়ে শুনিয়েছেন। কবিগুরু বললেন, ‘তাই নাকি? অদ্ভুত স্মৃতিশক্তি তো! আমার গীতাঞ্জলির গান সবতো আমারই মনে থাকে না।’
নজরুল সেদিন রবীন্দ্রনাথের কাছে একটি কবিতা আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলেন। কবিগুরু বললেন, ‘সে কী? আমি যে তোমার গান ও আবৃত্তি শোনবার জন্য প্রতীক্ষা করে আছি, তাড়াতাড়ি শুরু করে দাও।’
নজরুল আবৃত্তি করেছিলেন ‘অগ্নিবীণার’ ‘আগমনী’ কবিতাটি। এ ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে শোনান।
‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’
নজরুলের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করে শোনান ,
‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে,
এলো ফাগুন দিনের স্রোতে—’
নজরুল বাল্যকাল থেকেই রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন। নানান জায়গায় তিনি রবীন্দ্রনাথের গান গেয়ে বেড়াতেন। নিজের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামও তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীত থেকে নিয়েছিলেন। ‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে’ চরণ থেকে নজরুল ‘অগ্নিবীণা’ নিয়েছিলেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনা করে নজরুল সরাসরি চলে যান জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। নজরুল ঠাকুর বাড়িতে প্রবেশ করে ডাকলেন, ‘গুরুজি আমি এসেছি’।
বিশ্বকবির আশীর্বাদ, প্রেরণা জুগিয়েছে নজরুলের বিভিন্ন সৃষ্টিতে। ১৯২১ এর ৪ সেপ্টেম্বর, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত রবীন্দ্রনাথের ষাটতম জন্মদিন পালন উপলক্ষ্যে এক সভা হয়। নজরুল সভাকক্ষে ঢুকেই সোজা মঞ্চে উঠে কবিগুরুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মঞ্চ থেকে নেমে যাচ্ছিলেন, রবীন্দ্রনাথ খপ করে নজরুলের হাত ধরলেন। ‘না নজরুল, তুমি নিচে নয় তুমি এই সভায় আমার পাশেই বসবে।’
গান্ধিজীর অসহযোগ আন্দোলনে সাড়া দিয়ে নির্ভীক নজরুল ‘ধুমকেতু’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯২২ এর ১১ আগষ্ট প্রকাশিত এই পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাণী লিখে দেন। রবীন্দ্রনাথের হস্তলিপি সরাসরি প্রথম ৬টি সংখ্যায় প্রথম পৃষ্টায়, ৭ম সংখ্যা থেকে ৩য় পৃষ্টায় সম্পাদকীয় স্তম্ভের উপর তা ছাপা হয়।
‘আয় চলে আয়, রে, ধুমকেতু,
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন —’
ধুমকেতুতে প্রকাশিত নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ নামক একটি প্রতীকধর্মী কবিতা প্রকাশের পর নজরুলকে গ্রেফতার করে তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহ মামলা করা হয়।
মন চাইলেই নজরুল চলে যেতেন শান্তিনিকেতনে। উদ্দেশ্য গুরুদেবের সাক্ষাৎ। শিক্ষার্থীদের শারীরিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য রবীন্দ্রনাথ সৈনিক নজরুলকে শান্তিনিকেতনে থাকার আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু কোলাহল, হৈ চৈ প্রিয় নজরুল কোনো নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকতে চাননি।
রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুলের মধ্যে চিঠি–পত্রের আদান–প্রদান ছিল। রবীন্দ্রনাথের কাছে বিনয় ও শ্রদ্ধার সাথে চিঠি লিখত নজরুল। নজরুলের কাছে রবীন্দ্রনাথের চিঠিতে থাকত নানা উপদেশ, নির্দেশ আর অপার স্নেহ। একবার ‘নাগরিক’ পত্রিকার পূজা সংখ্যার জন্য লেখা চেয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে চিঠি লিখেন নজরুল। চিঠির এক জায়গায় নজরুল লিখেন, ‘গতবার পূজায় আপনার কিরণ স্পর্শে নাগরিক আলোকিত হয়ে উঠেছিল, এবারও আমরা সেই সাহসে আপনার দ্বারস্থ হচ্ছি। আপনার যে কোন লেখা পেলেই ধন্য হব। ভাদ্রের শেষে পূজা সংখ্যা নাগরিক প্রকাশিত হবে, তার আগেই লেখনি–প্রসাদ আমরা পাব, আশা করি।’ রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন ৭৫, খুব অসুস্থ। জবাবে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘তুমি তরুণ কবি, এই প্রাচীন কবি তোমার কাছ থেকে আর কিছু না হোক করুণা দাবি করতে পারে।’
চিঠির উত্তরস্বরূপ নজরুল ‘নাগরিক’ পত্রিকায় লেখেন, ‘তীর্থপথিক’ নামক কবিতাটি–
‘হে কবি, হে ঋষি অন্তর্যামী আমারে করিও ক্ষমা।
পর্বত–সম শত দোষত্রুটিও চরণে হল জমা—’
১৯৪১ সালের মে মাসে কবিগুরুর ৮০তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষ্যে নজরুল লিখলেন কবিতা ‘অশ্রুপুষ্পাঞ্জলি’। সে বছরই বাংলা ১৩৪৮ সালের ২২শে শ্রাবণ রবীন্দ্রনাথ মারা গেলে শোকে বিহবল নজরুল সেই দিনই লিখলেন, ‘রবিহারা’ কবিতা । তিনি আকাশবাণী বেতার কেন্দ্র থেকে ধারাবর্ণনা প্রচার করেন এবং আবৃত্তি করেন–
‘দুপুরের রবি পড়িয়াছে ঢলে অস্তপথের কোলে
শ্রাবণের মেঘ ছুটে এল দলে দলে
উদাস গগনতলে
বিশ্বের রবি ভারতের কবি’
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর এক বছর পরেই নজরুল চিরতরে অসুস্থ এবং ক্রমান্বয়ে সম্বিতহারা ও জিহবা আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের দুই প্রধান কবি শ্রদ্ধা আর স্নেহের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা আজীবন সাহিত্য অনুরাগীদের কাছে অনুকরণীয় ও অনুস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র : গুরু–শিষ্য সম্পর্ক (রেফুল করিম), রবীন্দ্র–নজরুল সম্পর্ক: শ্রদ্ধা আর স্নেহের অনন্য নিদর্শন (সাম্যবাদ)।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি, বোয়ালখালী হাজী মোঃ নুরুল হক ডিগ্রী কলেজ।