স্ব স্ব এলাকায় উপস্থিত থেকে দলের ঘোষিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা আছে বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের প্রতি। এমনকি এ বিষয়ে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরে নির্দেশনা সম্বলিত একটি নোটিশও জারি করা হয়। এরপরও গত ১২ দিনে তিন ধাপে ঘোষিত বিএনপির হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচিতে চট্টগ্রামে প্রকাশ্যে দেখা যায়নি দলটির সিনিয়র নেতাকর্মীদের। বিশেষ করে নগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক, সদস্য সচিবসহ সিনিয়র নেতারা মাঠে ছিলেন না বলে অভিযোগ করছেন দলের তৃণমূলের কর্মীরা। তাদের ভাষায়, ‘আত্মগোপনে’ আছেন দায়িত্বশীল নেতারা। বেশিরভাগ নেতার মোবাইল ফোনও বন্ধ।
তবে এ অভিযোগ মানতে নারাজ সিনিয়র নেতারা। তারা বলছেন, কর্মসূচিকে ঘিরে বিভিন্ন থানায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে। চলছে গণগ্রেপ্তার। এ মুহূর্তে রাস্তায় আসা মানে স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হওয়া। তাই কৌশলগত কারণে গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলছেন তারা। তবে দলীয় কর্মীদের নির্দেশনা দিচ্ছেন।
নগর বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২৮ অক্টোবর ঢাকার মহাসমাবেশের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত ১২ দিনে চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলার আওতাধীন বিভিন্ন থানায় ৪৫টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার হয়েছেন দলের ৭০০ নেতাকর্মী। এর মধ্যে নগরে দায়ের হয়েছে ১৫ মামলা, গ্রেপ্তার হয়েছে ৩২০ জন। উত্তরে দায়ের হয়েছে ১৭ মামলা, গ্রেপ্তার হয়েছেন ২০০ এর অধিক। দক্ষিণে দায়ের হয়েছে ১৩ মামলা, গ্রেপ্তার হয়েছেন ১৮০ জন নেতাকর্মী। এছাড়া নগর বিএনপির সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্করের বাসায় এবং দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানকে গ্রেপ্তারে তার ভাইয়ের বাসায় পুলিশি অভিযানেরও অভিযোগ আছে।
জানা গেছে, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসাবেশের আয়োজন করে বিএনপি। সেদিন আওয়ামী লীগ ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ায় পণ্ড হয় সমাবেশ। এরপর ২৯ অক্টোবর সারাদেশে সকাল–সন্ধ্যা হরতাল পালন করে দলটি। এটি ছিল দীর্ঘ সাড়ে ৮ বছর পর ডাকা বিএনপির প্রথম হরতাল। হরতালের পর ৩০ অক্টোবর থেকে গত ৯ নভেম্বর পর্যন্ত তিন ধাপে অবরোধ কর্মসূচি পালন করে দলটি। আগামীকাল রোববার থেকে চতুর্থ ধাপে আবারও দেওয়া হয়েছে অবরোধের নতুন কর্মসূচি।
এদিকে অতীতে অবরোধ–হরতাল কর্মসূচি চলাকালে নগরের নাসিমন ভবনস্থ দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থানে দেখা যেত বিএনপি নেতাকর্মীদের। তবে গত ১২ দিনে নগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা বিএনপি এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কাউকে সেখানে দেখা যায়নি। বরং বন্ধ ছিল দলীয় কার্যালয়।
আছে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা : গত ২৪ অক্টোবর দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরে দলীয় কর্মীদের কর্মসূচি বাস্তবায়নে একটি নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, ঢাকার সমাবেশ থেকে পরবর্তী যে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে তা সফল করার জন্য ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য, যুগ্ম মহাসচিব, কেন্দ্রীয় সম্পাদক, সহ–সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সকল সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও পৌরসভার সম্ভাব্য প্রার্থী, অতীতে যারা দলের সংসদ সদস্য ছিলেন এবং যারা প্রার্থীতা প্রত্যাশা করেন তাদের স্ব স্ব এলাকায় উপস্থিত থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে নির্দেশনা দেয়া হয়। একই নির্দেশনা রয়েছে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের উপরও।
এদিকে দলটির তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় এ নির্দেশনার পরও বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, নগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন, সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর, উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও দলীয় চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম ও সদস্য সচিব মোস্তাক আহমেদ খান আত্মগোপনে আছেন। অবশ্য আবু সুফিয়ান ও এনামুল হক দুয়েকটি ঝটিকা মিছিল করেছেন বলে জানিয়েছেন দলটির নেতাকর্মীরা।
মাঠে নেই চট্টগ্রামের কেন্দ্রীয় নেতারা : দলটির কেন্দ্রীয় কমিটিতে আছেন চট্টগ্রামের ২৪ নেতা। এর মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছেন। যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী ২০১৬ সালের মে মাস থেকে জেলে আছেন। বাকি ২২ জনকে মাঠে দেখা যায়নি। এদের মধ্যে আছেন ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন ও গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী। এছাড়া চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা রোজি কবির, ডা. সুকোমল বড়ুয়া ও এস এম ফজলুল হক, মহিলা বিষয়ক সম্পাদক নূর–এ–আরা সাফা, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক এম নাজিম উদ্দিন, পরিবার কল্যাণ সম্পাদক ডা. মহসিন জিল্লুর করিম, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. ফাওয়াজ হোসেন শুভ, সহ–গবেষণা ও তথ্য বিষয়ক সম্পাদক কাদের গণি চৌধুরী এবং সহ–গ্রাম বিষয়ক সম্পাদক বেলাল আহমেদ মাঠে নেই। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সরওয়ার জামাল নিজাম, গাজী শাহাজাহন জুয়েল, মোস্তফা কামাল পাশা, এম শামসুল আলম, কামাল উদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি ফয়সল মাহমুদ চৌধুরী, আনোয়ার হোসাইন, সাথী উদয় কুমার বড়ুয়া, সুশীল বড়ুয়া, মীর হেলাল, হুম্মাম কাদের চৌধুরী ও তরিকুল আলম তেনজিংও মাঠে নেই।
কী বলছেন নেতারা : দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান আজাদীকে বলেন, বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। মিছিল–মিটিং করা গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে দিচ্ছে না। গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাই এ মুহূর্তে রাস্তায় যাওয়া মানে স্বেচ্ছায় গ্রেপ্তার হওয়া। কিন্তু গ্রেপ্তারের ভয়ে আমাদের নেতাকর্মীরা ভীত নন। কৌশলগত কারণে গ্রেপ্তার এড়িয়ে চলেছেন। একটা পর্যায় পর্যন্ত এ কৌশল থাকবে। এরপর রাজপথে থেকে এক দফা দাবি আদায় করা হবে।
‘কর্মসূচি ঘোষণা করে ঘরে বসে থাকলে দাবি আদায় আদৌ সম্ভব কী না’ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই সম্ভব। কারণ আন্দোলন এখন জনগণের হাতে। জনগণ তাদের ভোটাধিকার ফেরত চান। তারা আমাদের সমর্থন করছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ বলছেন, অবরোধের কারণে তাদের ভোগান্তি হচ্ছে। তারা নিরাপদে রাস্তায় চলাফেরা করতে চান। তবু কেন অবরোধ জানতে চাইলে আবু সুফিয়ান বলেন, আমাদের কর্মসূচিগুলো জনগণের স্বতঃস্পূর্ত অংশগ্রহণের মাধ্যমে শন্তিপূর্ণভাবে পালিত হচ্ছে।
নগর বিএনপির আহবায়ক ডা. শাহাদাত হোসেন ও সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্করের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারকেও।
নগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ইদ্রিস আলী আজাদীকে বলেন, পুলিশ গণগ্রেপ্তার করছে। সেজন্য কৌশলগত কারণে গ্রেপ্তার এড়িয়ে তারা বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিচ্ছেন। সে আলোকে আমাদের কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। ২৮ অক্টোবরের পর শুধু মহানগরে ১৫টি মামলা হয়েছে। গ্রেপ্তার ৩২০ পেরিয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ জেলায় ৩০ মামলায় গ্রেপ্তার আছেন প্রায় ৪০০ জন। যে এলাকায় মিছিল হচ্ছে সে এলাকায় মামলা ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গেলে সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তবে অবরোধ জনগণ সফল করছে। তাদের সাড়া পাচ্ছি। অবরোধ মানে মহাসড়কে গাড়ি না চলা। সেখানে সফল।