যুগের সাথে, পৃথিবীর সাথে তাল মিলিয়ে চলাটা অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু সেজন্য একটা প্রস্তুতির প্রয়োজন। হুট করে কোনো কিছু পাল্টানো যায় না, পর্যায়ক্রমে পাল্টাতে হয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় স্কুল পর্যায়ে এক বিশাল পরিবর্তন আনা হচ্ছে জাপান–মালয়শিয়াসহ বিভিন্ন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে মাথায় রেখে। এতে পড়ার চাপ কমবে, খেলার মধ্যে পড়া হবে। তবে গত বছর এই নতুন কারিকুলামে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০২৩ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি যা অষ্টম, নবম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন করবে। এখন প্রশ্ন হলো– নবম শ্রেণি হচ্ছে পেশাগত জীবনের ভিত্তির প্রথম ধাপ। নবম শ্রেণির বাচ্চাদের জন্য এই পরিবর্তন কি যুক্তি সংগত হবে? যেই সন্তান অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এক নিয়মে পড়ে এসেছে, হঠাৎ করে নবম শ্রেণিতে নতুন কার্যক্রমে তারা কি অভিযোজিত হতে পারবে?
নবম, দশম শ্রেণিতে কোনো পাবলিক পরীক্ষা থাকবে না। ওদের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পর উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে প্রথম বারের মত পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। এই বাচ্চাগুলো আবার পুরোনো নিয়মেই কিন্তু একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পড়ালেখা করবে। আমরা সবাই জানি, উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা বেশ কঠিন। যা মাধ্যমিকে অনেক ভালো ফলাফল করা ছাত্র ছাত্রীরাও তাল মিলাতে গিয়ে হিমশিম খায়, সেখানে পাঠ্যক্রম অনুসরণ করতে গিয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এক রকম পড়ে আসা বাচ্চারা নবম শ্রেণিতে গিয়ে নতুন ধারার পড়াশোনা করে আবার একাদশে গিয়ে পুরোনো ধারার পড়াশোনা করাটা কি বাস্তব সম্মত?
উল্লেখযোগ্য যে, এই বাচ্চারাই ২০২০–২০২১ সালে কোভিড মহামারিতে ৫ম ও ৬ষ্ঠ শ্রেণি পার করেছিলো। তখন অনেক বাচ্চার অধঃপতন আমরা দেখেছি। সাইবার বুলি সহ নানা রকম অপরাধ ও বেড়েছিলো। পরীক্ষা না থাকায় বাচ্চাগুলোর পড়ালেখার ভিত্তিও গড়ে উঠেনি। তাই এই পিছিয়ে পড়া বাচ্চারা কি নতুন ধারায় নবম শ্রেণিতে গিতে পড়াশোনায় আরো পিছিয়ে যাবে না?
বর্তমানে সপ্তম শ্রেণির বই বিদেশী কার্যক্রম অনুযায়ী বদলেছে, আগামী বছর অষ্টম শ্রেণিতেও বদলাবে। তাই যারা এখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে তারা দুই বছর সময় পরে নতুন ধারার সাথে অভ্যস্থ হতে পারবে। ফলে নবম শ্রেণিতে ওদের সমস্যা হবেনা। কিন্তু যারা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এক নিয়মে পড়লো, কোভিডের কারণে তাদের পড়াশোনার ভিত্তিও নড়বড়ে, নতুন কার্যক্রম নবম শ্রেণিতে হলে ওদের পড়ালেখার ভিত্তি কি মজবুত হবে না ভঙ্গুর হবে?
নতুন কার্যক্রমের সাথে এখন পর্যন্ত শিক্ষকরা সেভাবে প্রশিক্ষিত হতে পারেননি। বিশেষ করে প্রান্তিক পর্যায়ের শিক্ষকেরা তো একেবারেই নয়। এই প্রশিক্ষণের জন্য অন্তত দুই তিন বছর প্রয়োজন। তাই নতুন কার্যক্রম প্রাথমিক পর্যায়ে, পর্যায়ক্রমে মাধ্যমিক পর্যায়ে চালু হওয়ার কয়েক বছর পরই নবম বা দশম শ্রেণিতে পরিবর্তন আনা যেতে পারে। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে নবম বা দশম শ্রেণিতে চালু করা হলে এটা শিক্ষকদের জন্য একটা বিরাট বড় চ্যালেঞ্জ হবে না?
বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে গেলেও গ্রামের মানুষ ঘরে ঘরে এন্ড্রয়েড ফোন এখনো অন্তত বাচ্চার হাতে দেয়ার ক্ষমতা রাখে না। কিন্তু নতুন কার্যক্রমে হাতে কলমে যে শিক্ষা হচ্ছে শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ না থাকায় বাচ্চাদের গুগোল দেখে তৈরী করতে হয়। এটা কি প্রান্তিক পর্যায়ে চালু করা বাস্তব সম্মত? আর মাধ্যমিক পর্যায়ে টিনএইজ বাচ্চাদের হাতে এন্ড্রোয়েড ফোন দেয়াটা কতটুকু নিরাপদ? (কোভিড প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিলো, কিন্ত সেজন্য কি সমস্য হয়েছিলো আমরা তা জানি) টিনএইজ বাচ্চাদের হাতে এন্ড্রোয়েড ফোন দিলে কিশোর গ্যাং যেমন বাড়বে, তেমনি মেয়েদের পড়াশোনার খরচ বেড়ে গেলে, বিশেষ করে গ্রামে বাল্য বিবাহের হার বাড়বে। এতে অনেক মেয়েরা পড়াশোনা থেকে ঝরে যাবে।
সর্বোপরি, এখন যে বাচ্চারা নবম শ্রেণিতে নতুন কার্যক্রমে পড়াশোনা শুরু করবে প্রথম বারের মত নতুন কার্যক্রমের কারণে তারা ছাড় বেশি পাবে, রেজাল্ট ও হয়তোবা ভালো হবে কিন্তু এইচ এস সি তে বড় রকমের ধাক্কা খাবে। এই বাচ্চারা এইচ এস সি তে একটা বিশাল অংশ ফেল করবে বা পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার মত উপযুক্ত মার্কস থাকবে না বা মেডিকেল বা ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলেও ভর্তি পরীক্ষায় টিকার ন্যূনতম মার্কস অর্জনের যোগ্যতাও থাকবে না। এ বিষয়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি।