আমি বখে যাওয়া ছেলে, আমি ঢিল ছুঁড়ে মারি
মাছি ভন ভন এই রোঁয়া ওঠা জেনারেল যদি নাড়ে ল্যাজ
সেলিনা আখতার তুমি প্রস্তুত রেখো, দেখো ভুলো না আবার
প্রিয় নীল শাড়িটির নীল আঁচলের কাটা নীল কিছু ব্যাণ্ডেজ।
(শাহিদ আনোয়ার : আকাশের দিকে ওড়ে লাল মাফলার )
কবিতার এই সেলিনা আকতারকে আমরা চিনি। কবি সেলিনা শেলী। শেলী শুধু শাহিদ আনোয়ারের কবিতায় ছিল না, জীবনেও ছিল। শুধু জীবনে ছিল না, রক্ত এবং আত্মায়ও ছিল। শুধু রক্তে আত্মায়? কর্মে ও আদর্শেও ছিল। না, ঠিক পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা গেল না। এই দুই কবির মহাসম্মিলনে আসলে কী কী যোগ ছিল তা ব্যাখ্যা ঠিক কয়েকটা বাক্যে সম্পন্ন করা খুব মুশকিল। ওরা কী শুধু স্বামী–স্ত্রী? দুই সন্তানের জনক–জননী? নাকি দুই আগুনের যুথবদ্ধতায় বিকীর্ণ আলোর ইতিহাস? কবি মানে তো আগুন। দুই আগুনে দু’জনে পুড়েছে, আর পুড়ে পুড়ে খাঁটিও হয়েছে। কবিতার অগ্নিপথে যেতে যেতে মত ও মনের মিল খুঁজে পেয়েছিল একদিন দু’জন। একই আকাশের তলে একই সূর্যের আলোয় আলোকিত একটি বৈষম্যহীন উদার পৃথিবীর স্বপ্নে দেখেছিল তারা। সেই স্বপ্নের সূত্র ধরে সংসারের ভেতর দিয়ে শুরু হয় ওদের যৌথ কবিতাযাপন। দ’ুজনের স্বপ্ন এক, নেশা এক, পেশাও আশ্চর্যজনকভাবে এক। দু’জনেই কবি, দ’ুজনেই শিক্ষক, দু’জনেই সমাজতন্ত্রী। সবচেয়ে বড় কথা দ’ুজনেই স্বপ্নচারী। এই স্বপ্নযাত্রায় কঠিন বাস্তবতার যাবতীয় খুঁটিনাটি, হাজার বাজার, মস্ত কণ্টক, ঝক্কিঝামেলা, অবহেলা, অপমান, অবজ্ঞা, অসচ্ছলতা সবকিছু চোয়াল শক্ত করে আশ্চর্য কাঠিন্যে অবিচলভাবে সামলে নিয়েছে উপরের কবিতায় উপস্থিত সেই সেলিনা আকতার। স্ত্রী, জননী, শিক্ষিকা জীবনযোদ্ধা সেলিনা আকতার দুই কবি শাহিদ আনোয়ার ও সেলিনা শেলীকে আগলে রেখেছে আশ্চর্য মমতায়। এ–বড় কঠিন সংগ্রাম। নিজের সত্তাকে নানাভাবে ভাগ করে বন্ধুর ও মরুময় একটা পথকে মসৃণ করে এনেছিল সেলিনা। কিন্তু বাস্তবতা বড় নির্মম। ছেলেগুলো বড় হতে লাগল, ঝামেলা একে একে কমতে লাগল, দূরের কর্মস্থলটি বদলে কাছে চলে এল, শ্বশুরবাড়ির তীব্র অবজ্ঞা–অবহেলা এড়িয়ে সংসারটা গোছানো হলো ঠিক সেসময় একদিন মধ্যরাতে শাহিদ আনোয়ার স্তব্ধ হলো, অনঢ় হলো। সে আর কথা বলল না। কবিতা লিখল না। দুইটা বছর এই একটা অচল মানুষকে নিয়ে শুরু হলো সেলিনার আরেক সংগ্রাম। শয্যাশায়ী শাহিদ শুধু চোখের ভাষায় কথা বলত। মুখ দিয়ে ধ্বনি বের হতো না। যেন তার জিভ ছিঁড়ে গেছে। অথচ অবয়ব দেখে মনে হতো কিছু একটা বলতে চায় শাহিদ। কী সে কথা? সেলিনা বোঝে। কী শোনাতে চায় সেটা সে জানে। কারণ মানুষটাকে সারা জীবনভর পাঠ করেছে সে। তার মনে কী ভাষা, বুকে কী অভিমান, অন্তরে কী কষ্ট সেটা সেলিনা ছাড়া কে বুঝবে! সেই ছেঁড়া জিভের অনুচ্চারিত সকল কথাই যেন কবিতা হয়ে বের হয়ে এল সেলিনার অন্তরের কলম থেকে। খড়িমাটি প্রকাশন ২০২৩–এর বইমেলায় এনেছে সেলিনা শেলীর ২১টি কবিতার এই অন্যরকম গ্রন্থটি। বইটির নাম ছেঁড়া জিভের দাস্তান। সবক’টি কবিতা একজন শাহিদ আনোয়ারকে নিয়ে। বলা যায় অন্যলোকের বাসিন্দা কবি শাহিদ আনোয়ারের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে চলেছে শব্দসাঁকোর মাধ্যমেই। তার সাথে কথা বলছে–
একদিন একাকীত্বগুলো জড়ো করে দেখি
তার ভেতর একটি নিউরনের মতোন ঘুমিয়ে
পড়েছি আমি।
আকাশ তার পরিসীমা ভেঙে
বৃষ্টি হয়ে ফিরে গেছে।
কোন অনন্তের ভেতর থেকে
ভেসে আসা অন্ধকার
আমাকে বলে– চাঁদেরও ওপার চাঁদ
প্রাণের বীজ বোনা কোনো ঘর.
দূরে কোন এক নক্ষত্রলোকে আমাকে
নিয়ে যাবে– আমি ফিরে পাবো সঙ্গমসময়, বোঝাপড়া–পরম্পরা
একটি অনন্ত চুমুর মুহূর্ত।
বইটিতে শিরোনামহীন একুশটি কবিতার মধ্যে এটি সর্বশেষ। আগের বিশটি কবিতার মধ্যেও একই স্বর। একই হাহাকার। তবে এই শেষের কবিতাটি যেন পুরো বইয়ের সারমর্ম। একটা সংগ্রামমুখর জীবনে শেলী আসলে রণক্ষেত্রের সৈনিক। সেখানে সে হার মানতে জানে না। পুরো বইটিতে ট্রমা কবলিত একটা মানুষের গোঙানি স্পষ্ট। কিন্তু শেষটিতে এসে যেন উঠে দাঁড়াতে চায় আবার। বলছে– আমি ফিরে পাবো সঙ্গমসময়, বোঝাপড়া–পরম্পরা
একটি অনন্ত চুমুর মুহূর্ত।
আবার একটু বিভ্রমও হয়। অনন্ত চুমুর মুহূর্তর জন্য ভেসে আসা অন্ধকার তাকে নিয়ে যাবে দূরে কোন এক নক্ষত্রলোকে। জীবনের আহ্বান নাকি মৃত্যুচিন্তা? এরকম একটি দোলাচলে পাঠক দুলতে থাকে। কবিতা আসলে সেরকম। পাঠককে এক দ্বান্দ্বিক বোধে উপনীত করে।
আগের আবেগ, উচ্ছ্বাস, টগবগ করা ছন্দ, দ্রোহ, প্রতিবাদ এবং জীবনের প্রবল আনন্দ থেকে বেরিয়ে এসে শেলী এখানে শান্ত, স্থির আর গম্ভীর। একটা কোলাহলহীন নির্জন পৃথিবীতে এসে বসেছে কবি।
ব্লেক রেইনের কবি এখন বলছে–
মৃত্যু ও আমি হাত ধরে আছি প্রতি পলে প্রকম্পনে
বিশদে বেদনা মুক্ত করো হে, বলি– প্রভু নিরঞ্জনে।
……………………………………………..
……………………………………………….
তুমি হবে খুনি? নিয়ে যাবে তাকে? এমন যদিবা করো
আমার আত্মায় তার সুগন্ধি, আমাকেই আগে মারো।
প্রতিবাদ নেই, ক্ষোভও নেই। প্রবল অভিমান প্রতিটি পঙ্ক্তি জুড়ে। পাশাপাশি রোগ–শোক–জরা কবলিত মানুষের অসহায়ত্ব কেমন বিলাপের মতো উঠে এসেছে এখানে।
অথচ তোমার জন্যে অনুনয়ে ন্যুব্জ আমি
হাতজোড় করে মিনতিতে চিকিৎসার ঘরে ঘরে
করোনানিদান কালে তিলে তিলে ভেঙেছি নিজেকে!
করোনাকালে অসুস্থ অচেতন কবিকে নিয়ে তার অনুভূতির একটি শৈল্পিক করুণ বয়ান এই দাস্তান। প্রতিমুহূর্তে কবি স্মৃতিতাড়িত। এখানে অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত মিলেমিশে একাকার। আবার পার্থিবতার অনেক ঊর্ধ্বে গিয়ে কখনো কখনো অলৌকিক সংযোগে নিত্য কথা বলে চলেছে কবি শাহিদ আনোয়ারের সঙ্গে–
তোমার মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে পড়বার আগে
কী স্মৃতি শেষবার খেলিয়ে নিয়েছ তুমি?
অনন্তযাতনা দিয়ে যাবার আগে কিছু কী বলার ছিল না?
এই একপথের কথোপকথনের পর যখন ফিরে আসে তখন কবি দেখতে বা শুনতে পায়
হ্যাঙারের গন্ধমেদুর আস্তিন গোটানো শার্ট মৃত্যুমৃদঙ্গে বেজে ওঠে।
তোমার পাশেই রেখেছি আমার তিন হাত অনন্তঘর!
অনাদিকালের পাথরখণ্ডের মতো
আজ
আমি তোমার আপন অথবা পর।
সেলিনা শেলীর এই বইয়ের প্রতি পঙ্ক্তিতে ভেসে উঠছে শাহিদ আনোয়ার। শুধু একজন মানুষকে নিবেদিত এরকম প্রেমসিক্ত বিষণ্ন কবিতার বই কয়টি আছে আমি জানি না। শাহিদের শৈশবের বন্ধু আমি। বন্ধু হিসেবে এই বইটির মর্ম তাই আমি একটু বেশি উপলব্ধি করতে পারি। জীবনের শেষ দিনগুলোতে, জীবনের সংগ্রামের দিনগুলোতে যে যন্ত্রণা তাকে বইতে হয়েছে, যে নিপীড়ন তাকে অসুস্থতা থেকে আরো ঘোর অসুখী করে তুলেছে তার বিশদ বিবরণ এখানে পাওয়া যায়। ব্যক্তি শাহিদ আনোয়ার কিংবা ব্যক্তি সেলিনা শেলীর ভোগান্তির আর বেদনার কাব্যিক বিবরণ শেষ পর্যন্ত সমাজ আর মানুষের কুসংস্কারই বিম্বিত হয়েছে।
ক্রন্দনগুলো ভাঙা সেরেনাদ হয়ে বাজছে
একমুঠো জীবনের ভেতর তুমি ছিলে রক্তীয়দের ঘৃণা।
আমি নিশ্চিত এই দাহকাণ্ডের অগ্নিকাঠি আমি।
উগ্র ধর্মপুঙ্গব ওদের আত্মাকে তবারুক
বানিয়েছে।
………………………………………….
যাকে ওরা তছনছ করতে গিয়ে আঙুলে চামড়ায় ফোস্কা ফেলেছে–
সে এক নিরীহ পদ্যকার, ভালোবাসা ছাড়া যার কোনো ধর্ম নেই।
………………………………………………………..
এ জীবন কবির জীবন– পাঠকই আত্মীয় জেনো
কাব্যই পরম সাঁই।
কবির জীবনই কাটিয়েছে শাহিদ আনোয়ার। সেলিনা শেলীও কবির জীবন পার করছে। ভালোবাসা ছাড়া যার আর কোনো ধর্ম নেই। সেই কাঙ্ক্ষিত ভালোবাসা পাঠকের কাছ থেকেই পাবে। এ–বিশ্বাস আমার আছে।