মায়াবী ঘুম

করিম রেজা | শুক্রবার , ১৬ জুন, ২০২৩ at ৫:৩৬ পূর্বাহ্ণ

বাড়িটা সারাবছর তালা দেওয়া থাকে।

ভেতরে গুমোট ভাব; প্রতিটি ঘরের কোণা এখন মাকড়সার একচ্ছত্র দখলে। মেঝেতে জমেছে ধুলোবালির কয়েক স্তর পলি। সেখানে সরু সরু বেশ কিছু রাস্তাও চোখে পড়ছে। আসলে এই রাস্তাগুলো ধূলোর মাঝে ইঁদুরের ছোটাছুটি করার পদচিহ্ন। সাপটাপ আছে কিনা বুঝা যাচ্ছে না; আমি সাপ খুব ভয় পাই। এই যেমনসাপের কথা মনে পড়তেই আমার পুরো অদৃশ্য শরীরটা ছমছম করে উঠল।

এই গুমোট বাড়িতে আমি কীভাবে আসলাম সে কথায় পরে আসছি।

থাকি ঢাকায়। সারাবছর থাকে দুঃসহ যানজট; একটু বৃষ্টি হলেই নোংরা জলজটে জীবন কাটে। গ্রীষ্মের ছাতিফাটা গরমও আছে সাথে। বিশেষণগুলো যত খারাপ থাকার ইঙ্গিত দেয় মাস শেষে ঢাকার মানুষ আসলে তত খারাপ থাকে না। কারণ শরীরে যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ টাকাটাই শেষ কথা। মাস শেষে টাকা আসে; পকেট আর বুক ভরে টাকা আসে। তারপর কয়েকদিন টাকাগুলো খুব ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠে। গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানি বিল অনলাইনেই চলে যায়; বাসার কেয়ারটেকার অবশ্য চায় এসব বিল সে নিজে ব্যাংকে গিয়ে জমা দিয়ে আসতে। আগে এই কাজটি তার নির্ধারিত একটি মাসিক দায়িত্ব ছিল। এতে তার কিছু আয়ও ছিল। যতবার ব্যাংকে যেত ততবার একেকটা গল্প নিয়ে আসত সে। ইন্টারনেট ব্যাংকিং অনায়াস হওয়ার পর এরকম শত শত কেয়ারটেকারের উপরি আয় হঠাৎ থমকে গেছে। আর্থিক লেনদেনে ডিজিটাল সিস্টেমে অনাস্থাও আছে অনেকের; যেমন আমাদের বিল্ডিয়ের আসিফ সাহেব। তিনি নিজে ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে এসব বিল পরিশোধ করেন। কিছু টাকা গ্রামেও যায়; শহর থেকে গ্রামের রেমিট্যান্স। দ্রব্যমূল্য বাড়ার পর মুদিদোকানে মাসিক নির্ধারিত ব্যয় এখন আর আগের মতো নেই। অনেক কিছু কাটছাট করার পরও এখন শুকনো বাজার নয় হাজার ছুঁই ছুঁই করে। সাপ্তাহিক আর দৈনিক খরচের ফিরিস্তি আপাতত বাদ দিলাম।

গ্রামের বাড়িতে আমি বছরে এক দুবার অতিথির মতো বেড়াতে যেতাম। বড় বন্ধনগুলো ছিঁড়ে গিয়েছিল অনেক আগেই। যার ঔরস থেকে আর যার গর্ভের নাড়ি ছিঁড়ে পৃথিবীতে এসেছিলাম তাদের কেউ আর পৃথিবীতে ছিলেন না। তবে তাদের বাড়িটা আমার হয়ে টিকে ছিল। সেই বাড়ির টানেই মূলত বছরে দুয়েকবার গ্রামে যেতাম। আত্মীয় পরিজন, পুকুরের মাছ, গাছের ফল আর ছায়া, পাড়া প্রতিবেশী, বাঁধানো ঘাট, শৈশবের স্মৃতি স্মারকএসবও কম টানত না। তবে মানুষের কাছে বর্তমানটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইচ্ছা হলেই পরিবার পরিজনকে অপ্রস্তুত রেখে হুট করে গ্রামে ছুটে যাওয়া যেত না।

এখন আসি আসল কথায়। কীভাবে আমি এই গুমোট বাড়িতে এসে বন্দী হলাম। এইসব মাকড়সা আর ইঁদুরের ঘেরাটোপে ঝুলে গেলাম বাদুরের মতো! দিনটা ছিল বুধবার, ঈদের ছুটি শুরু। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলাম এবারের ঈদ করব গ্রামে। পরিবার পরিজন নিয়ে নয়, আমি একা। সামনে মেয়ের পরীক্ষা ; স্ত্রীও অসুস্থ ; নতুন সদস্য আসছে আমাদের। তাই মঙ্গলবার রাতে যাত্রা শুরু করলাম ছোটখাটো ব্যাগ সাথে নিয়ে। টেলিভিশনের ব্রেকিং নিউজে চোখ রেখে বউ বার বার সাবধান বাণী শুনিয়ে দিয়েছিল। নতুন ঝকঝকে রাস্তা নখের পিঠের মতো মসৃণ। ঢাকা থেকে যাত্রার দুঘন্টার মধ্যেই পদ্মা পার হয়ে গেলাম। একসময় ফেরিতে এই পদ্মা পার হতেই লেগে যেত কয়েক ঘন্টা। রাত শেষে ভোর হলো। ধান কাটার মৌসুম এখন। সোনালি ধানের ওপর রোদের সোনালি রঙ পড়লে গরমের তীব্রতা বেড়ে যায় হু হু করে। দুপুর হতে এখনো ঢের দেরি। কবিরা যাকে স্নিগ্ধ সকাল বলে এখন ঠিক তাই। ছোট ছোট নদীর পর নদী পেরিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। এখন আর কোনো নদীতেই ফেরি নেই। আধুনিক আর হিন্দি গানে কেটেছে সারারাত। এখন চলছে ওয়াজ।

চোখ একটু লেগে এসেছে ঘুমে। ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি কানে যেমন আওয়াজ শোনায় তেমনি শুনছি সবকিছু; চামড়া ছিঁড়ে যাওয়া ঢোলের মতো বেঢপ আওয়াজ। লাটিমের শেষ ঘুর্ণির মতো হঠাৎ ঘুরতে ঘুরতে কেঁপে উঠল সবকিছু। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, অন্তত এক ঢোক হলেও পানি পান করা দরকার। হাতের কাছেই হাফ লিটার পানির একটি বোতল আছে; একেবারে নতুন, ছিপিটা পর্যন্ত খোলা হয়নি এখনো। কিন্তু মায়াবী ঘুমটা কিছুতেই ভাঙছে না আর।

লাটিম বেতালে কতক্ষণ ঘুরেছিল এখন আর মনে নেই। কানে আসছে ধাতব পাত্রে ছুরির টুংটাং আওয়াজ। ছোটবেলায় খুব আওয়াজ করে করে বাংলা ব্যাকরণের এককথায় প্রকাশ মুখস্থ করতাম। সেখানে চুড়ির বা ছুরির টুংটাং আওয়াজকে এককথায় কী বলে তা কখনো পড়িনি। চুড়ির কথা কেন মনে পড়ল হঠাৎ! মোটা গোঁফঅলা লালচোখের একজন আমার ওপর ঝুঁকে আছে। হাতে তার রূপালি ধাতব ছুরি।

সেই আধো ঘুম আধো জাগরণ আর কখনো ভাঙেনি আমার। গ্রামের বাড়ির এই গুমোট অন্ধকারে এখন মাকড়সার গান শুনি। ইঁদুরের মারামারি দেখি দিনভর, রাতভর। ঢাকায় যাওয়ার ইচ্ছা জাগে না এতটুকু। এতদিনে নিশ্চয় মেয়ের পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধগোপন কথা
পরবর্তী নিবন্ধছেঁড়া জিভের দাস্তান অন্যলোকের সঙ্গে সংযোগ