বাজারে ভারতীয় পোশাকের দাপট

লোকসানে স্থানীয় ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা বেশিরভাগ আসে চোরাইপথে মোটা অঙ্কের শুল্ক ফাঁকি

ঋত্বিক নয়ন | বৃহস্পতিবার , ২০ এপ্রিল, ২০২৩ at ৮:৪৬ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের ঈদবাজারে চলছে ভারতীয় পোশাকের দাপট। মার্কেট, শপিংমল, হাটবাজারে থরে থরে সাজানো ভারতীয় পণ্য। বৈধঅবৈধ পথে আসা শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিসসহ হরেক পোশাকের কাছে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে দেশি পোশাক। তাতে মার খাচ্ছে দেশি ছোট বড় শিল্প। লোকসান গুণছেন স্থানীয় ব্যবসায়ী উদ্যোক্তারা। আবার চোরায়পথে পণ্য আসায় মোটা অঙ্কের শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে র‌্যাবের অভিযানে রমজান মাস শুরুর অনেক আগে থেকেই প্রায় প্রতিনিয়ত ধরা পড়ছে ছোট বড় চালান। স্থলপথের পাশাপাশি প্রথমবারের মতো চট্টগ্রাম বন্দরে ধরা পড়েছে কন্টেইনার ভর্তি ভারতীয় পোশাক। ভারতের কলকাতা থেকে সোডা অ্যাশ ঘোষণায় বিপুল সংখ্যক শাড়ি ও লেহেঙ্গা নিয়ে আসে ফেনী জেলা সদরের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান আজিজ এন্টারপ্রাইজ। মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির মাধ্যমে আমদানিকারক এক কোটি ৪১ লাখ টাকা রাজস্ব ফাঁকির চেষ্টা করেছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড রিসার্চ (এআইআর) শাখার কর্মকর্তারা। কায়িক পরীক্ষায় ১২ হাজার ৫৫০ পিস বেনারসি শাড়ি, এক হাজার ১৩৯ পিস জর্জেট শাড়ি, ৪০৩ পিস লেহেঙ্গা পাওয়া যায়।

চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার মো. সাইফুল হক জানান, ঈদুল ফিতরে ভারতীয় শাড়ি ও লেহেঙ্গার চাহিদা বেশি থাকায় শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে বেশি মুনাফার উদ্দেশ্যে চালানটি আনা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে চলতি মাস এবং গত মাসে ফেনী থেকে চট্টগ্রাম আসার পথে ভারতীয় পোশাকের বেশ কয়েকটি চালান আটক করে র‌্যাব। কুমিল্লা ও ফেনী সীমান্ত হয়ে ভারত থেকে আসছে শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিসসহ হরেক রকমের পোশাক। চোরাই পথে আসা এসব পণ্য শোভা পাচ্ছে চট্টগ্রামের শপিংমল ও মার্কেটগুলোতে। ক্রেতারা বলছেন, ঈদ বাজারে বেশি চাহিদা এবং বেশি বিক্রি হয় এমন সব পোশাকই ভারতীয়।

ভারতীয় পোশাকের ভিড়ে দেশি পোশাক খুঁজে পাওয়ার উপায় নেই। শাড়ি, থ্রিপিস, লেহেঙ্গা থেকে শুরু করে মেয়েদের পোশাকের পুরোটাই ভারতীয় পণ্যের দখলে। ভারত থেকে আসা শাড়ির দাপটে কোণঠাসা জামদানি, কাতানসহ দেশের ঐহিত্যবাহী সব ব্র্যান্ডের শাড়ি। সুতার শাড়িতেও ভারতের আধিপত্য। অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় চোরাকারবারিরাই উদ্যোগী হয়ে একটা দুইটা চালান ধরিয়ে দেয়। আর তার ফাঁক গলে চলে আসে বড় চালানগুলো। প্রতি বছরই ঈদ ও পূজাকে টার্গেট করে অবৈধ পথে শুল্ক না দিয়ে শত শত কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অর্থনৈতিক মন্দায় এবার এমনিতেই কেনাবেচা তেমন নেই। তার উপর ভারতীয় পোশাকের আধিক্য বাজার পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে। বেশিরভাগ পোশাক চোরা পথে এসেছে। এতে সরকারের ভ্যাট ও ট্যাঙ ফাঁকি দেয়া হয়েছে। তাতে এসব পোশাকে খরচ কম পড়েছে। অন্যদিকে যারা দেশি পণ্যের পসরা সাজিয়েছেন তাদের খরচ বেশি হয়েছে। আবার কেনাকাটাও কম হওয়ায় তারা লোকসানের আশঙ্কা করছেন।

ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ উপলক্ষে এ বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। এর ৮০ ভাগই ভারত থেকে এসেছে। কিন্তু এসব পণ্য বৈধ পথে আসেনি। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবাধে ঢুকছে ভারতীয় পণ্য। আর এসবের মূল্য পরিশোধ করা হচ্ছে হুন্ডিতে। এভাবে কয়েক হাজার কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। ভারতবাংলাদেশের শক্তিশালী একাধিক সিন্ডিকেট এ কাজে জড়িত। রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় ভারতীয় পণ্য এ দেশে বাজারজাতকরণে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না। প্রশাসনকে ম্যানেজ করে লাখ লাখ টাকার শাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম শহরের তামাকুমন্ডি লেইন, রিয়াজ উদ্দিন বাজার, টেরি বাজারসহ বিভিন্ন বিপণী বিতানে। এ কাজে জড়িত রয়েছে একটি সিন্ডিকেট।

অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রশাসনের কড়াকড়ি ও কঠোর নজরদারির সময় চোরাচালানিরা নিজেরাই দু’ একটি চালান ধরিয়ে দেয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে জব্দকৃত চালানটি নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগে সহজেই বড়ো বড়ো চালানগুলো পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। চমকপ্রদ একটি তথ্য হলো তিন ক্যাটাগরিতে ভারতীয় শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস চোরা পথে নগরীতে আসছে। কম মূল্যের কাপড়গুলো ট্রাকে বা কাভার্ডভ্যানে ও বেশি মূল্যের কাপড়গুলো প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসে আসে।

অভিযোগ উঠেছে, কমপক্ষে ১২ জেলার সীমান্তে নিয়োজিত কতিপয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকর্মচারী ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে চোরাচালানি সিন্ডিকেট অবৈধভাবে ভারতীয় পণ্য আনছে। শার্শা, বেনাপোল ও চৌগাছা সীমান্তের ২৫ থেকে ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে সড়ক ও নৌ পথে ভারতীয় ঈদপণ্য দেশে ঢুকছে। কলকাতার পার্শ্ববর্তী ডায়মন্ড হারবারে চোরাচালানিদের শক্ত ঘাঁটি। ওই ঘাঁটি থেকে কয়েকটি সিন্ডিকেট পণ্য পাচার নিয়ন্ত্রণ করে। সেখান থেকে ট্রলারে শাড়ি, থ্রিপিস ইত্যাদি সুন্দরবন হয়ে বঙ্গোপসাগর দিয়ে বাগেরহাট, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরিশালে এ দেশীয় সিন্ডিকেটের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়। পরে তা মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার ও ট্রাকে চলে যায় বিভিন্ন জেলার শপিং মলে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, সীমান্তের জিরো পয়েন্ট পার হওয়ার পরই অপেক্ষমাণ দেশীয় ট্রাক, ভ্যান, বাইসাইকেলসহ নানা রকমের যানবাহনে পণ্য তুলে দেয়া হয়। নিরাপদে পারাপারের জন্য পথে থাকে সিন্ডিকেট সদস্যরা। জানা গেছে, একটি ট্রাকে ৯০ বেল শাড়ি, থ্রিপিস থাকে। ৯০ বেল কাপড়ের দাম এক কোটি টাকা। আর এ পণ্যের আমদানি শুল্ক ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। কলকাতা থেকে বৈধভাবে ওই পণ্য আমদানি করতে কাস্টমস খরচ, বন্দর চার্জ, ট্রাক ভাড়া, সিএন্ডএফ কমিশন ইত্যাদি দিয়ে প্রায় দ্বিগুণ মূল্য পড়ে। তা ছাড়া সময়ও লাগে এক মাসের মতো।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঈদের জনসংযোগে উন্নয়নের কথা তুলে ধরতে বললেন প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধজব্বারের বলি খেলা চট্টগ্রামবাসীর বিশাল মিলন মেলা : মেয়র