ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:১৬ পূর্বাহ্ণ

নিজেদের দোষেই বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট

বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতির তান্ডব সাধারণ জনগণের জীবনকে বিপর্যস্ত করছে। ৫ আগস্ট ২০২২ তারিখে ডিজেল এবং অন্যান্য পেট্রোলিয়াম পণ্যের দাম একলাফে ৫২ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়ে সরকার অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতিকে অনিবার্য করে তুলেছে। (গত ২৯ আগস্ট প্রতি লিটার ৫ টাকা করে দাম কমানো হলেও তা একেবারেই অপ্রতুল)। পেট্রোলজাত পণ্যের এই অভূতপূর্ব মাত্রার মূল্যবৃদ্ধির জন্য অজুহাত হিসেবে সরকার রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেল ও এলএনজি’র দামের প্রবল স্ফীতিকে যুক্তি হিসেবে খাড়া করলেও আমরা দেখাতে চাই যে সরকারের নিজেদের গাফেলতি এবং অদক্ষতার কারণেই অর্থনীতিতে বর্তমান বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। এই বক্তব্যের সমর্থনেই বক্ষ্যমাণ কলামটি লিখছি।
গত বছরের জুলাই থেকে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বেলাগাম বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের জুন মাসের শেষে এসে ২০২১-২২ অর্থ-বছরের মোট আমদানি ব্যয়কে ৮৯.১৬ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে গেছে, যা আগের অর্থ-বছরের তুলনায় প্রায় ৩৮ শতাংশ বেশি। স্বাধীন বাংলাদেশের ৫১ বছরে ২০২১-২২ অর্থ-বছরের আমদানি ব্যয় ছিল সর্বোচ্চ। এর ফলে, দেশের রফতানি আয় ২০২০-২১ অর্থ-বছরের তুলনায় ৩৩ শতাংশ বেড়ে ২০২১-২২ অর্থ-বছরে ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলেও ২০২১-২২ অর্থ-বছরের বাণিজ্য-ঘাটতি ইতিহাসের সর্বোচ্চ ৩৭.০৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ বরাবরই বাণিজ্য-ঘাটতির দেশ। কিন্তু, সাম্প্রতিক দু’দশক ধরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের ফর্মাল চ্যানেলের মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্স এই বাণিজ্য-ঘাটতি মেটানোর জন্য যথেষ্ট হওয়ায় দেশের ব্যালেন্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট একাউন্টে প্রায় প্রতি বছর উদ্বৃত্ত হওয়াই নিয়মে পরিণত হয়েছিল। এর ফলে ২০০১-০২ অর্থ-বছর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেখানে মাত্র ১.০৯ বিলিয়ন ডলারে অবনমিত হয়েছিল সেখান থেকে রিজার্ভ বাড়তে বাড়তে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। এরপর থেকে শুরু হলো রিজার্ভের পতনের ধারা। ২০২২ সালের জুন মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে যাওয়ার পর এখন হয়তো সরকারের টনক নড়েছে। আইএমএফ নির্দেশ দিয়েছে গত কয়েক বছর ধরে সরকার এক্সপোর্ট ডেভেলাপমেন্ট ফান্ড থেকে রফতানিকারকদেরকে রিফাইনেন্সিং স্কীমের অধীনে বৈদেশিক মুদ্রায় যে সাড়ে সাত বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে সেটাকে রিজার্ভ থেকে বাদ দিতে হবে। ঐ নির্দেশ সরকার মানছে না, কারণ তাহলে বাংলাদেশ কর্তৃক ঘোষিত রিজার্ভকে ৩২ বিলিয়ন ডলারে নামিয়ে ফেলতে হবে। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে আমদানি এল/সি খোলা জোরেসোরে শুরু হলেও অর্থমন্ত্রী তা ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি, কোন রকম আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপও গ্রহণ করেনি সরকার। বরং, ২০২১ সালে শ্রীলংকাকে কারেন্সি সোয়াপের মাধ্যমে রিজার্ভ থেকে ২৫০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়ে বাহবা কুড়িয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। রিজার্ভের পতনের এই ধারাকে আমি ২০২২ সালের এপ্রিলে বিপজ্জনক আখ্যায়িত করায় আমাকে ইংগিত করে ‘অর্বাচীন’ বলে গালমন্দ করেছিলেন। এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে আসলে কারা ‘অর্বাচীন’।
২০২২ সালের মার্চ থেকে এলএনজি’র আন্তর্জাতিক দাম ধাপে ধাপে বাড়তে বাড়তে এখন দশগুণ বেড়ে যাওয়ায় সারা বিশ্বে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। তেলের দামও ক্রমান্বয়ে বেড়ে ২০২২ সালের মে মাসে ব্যারেলপ্রতি ১৪০ ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। গত জুলাই মাস থেকে আসন্ন বিশ্বমন্দার আশংকায় তা আবার কমতে শুরু করেছে, ২৪ আগস্ট তারিখে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি ৮৯ ডলার। আমরা বিপদে পড়েছি আমদানিকৃত এলএনজি’র ওপর আমাদের জ্বালানি নীতির অতি-নির্ভরশীলতার কারণে। সরকারের ভুলনীতির কারণেই এহেন অতি-নির্ভরতা। দেশের স্থলভাগে এবং এক লাখ আঠার হাজার আট’শ তের বর্গ-কিলোমিটার সমুদ্র-সীমায় গত চৌদ্দ বছর যাবত বলতে গেলে কোন তেল-গ্যাস অনুসন্ধান চালায়নি সরকার। জ্বালানি নীতি ও বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি হিসেবে বর্তমান সরকার বেছে নিয়েছে আমদানিকৃত এলএনজি-নির্ভরতা। কারণ ২০১০-২০২০ পর্যায়ে এলএনজি’র আন্তর্জাতিক দাম ছিল ব্যারেলপ্রতি চার ডলার, ২০২২ সালের আগস্টে যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ ডলারেরও বেশি। আর, এখন চাইলেই বাংলাদেশ স্পট মার্কেট থেকে এই দামেও এলএনজি কিনতে পারছে না রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ-উদ্ভূত চরম ঘাটতির কারণে। ফলে, বাধ্য হয়ে জ্বালানি সাশ্রয়ের উদ্দেশ্যে গত এক মাস যাবত বিদ্যুতের লোডশেডিং এর ব্যাপক বিস্তার ঘটাতে হয়েছে। প্রতিদিন প্রায় দেড় হাজার থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে ফেলতে হচ্ছে। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলো বন্ধ রাখা হচ্ছে। প্রায় পঁচিশ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্যাপাসিটি অর্জন সত্ত্বেও দৈনিক উৎপাদনকে দশ/এগার হাজার মেগাওয়াটে সীমিত রাখতে হওয়ায় একদিকে লোডশেডিং যেমনি বেড়েছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অব্যবহৃত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টগুলোকে ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ হিসেবে প্রদত্ত হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ। আমদানীকৃত এলএনজি-নির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন নীতি, শিল্পনীতি এবং গৃহস্থালী জ্বালানি নীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এই বিপর্যয়ে ঠেলে দিয়েছে বলা চলে। সেজন্যই প্রশ্ন উঠবে, বর্তমান এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী কে?
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বদ্বীপ বাংলাদেশ। বিশেষজ্ঞদের মতে, এরকম বদ্বীপ অঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন সাগর-উপসাগরের তলদেশগুলো সাধারণত সবচেয়ে বেশি হাইড্রোকার্বণ (তেল ও গ্যাস) খনির ভান্ডার হওয়াই স্বাভাবিক। যুক্তরাষ্ট্রের গাল্‌ফ ডেল্টা, ইন্দোনেশিয়ার মহাকাম ডেল্টা এবং আফ্রিকার নাইজার ডেল্টা এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বঙ্গোপসাগরের ভারত উপকূলের অদূরে গোদাবরী বেসিন এবং মিয়ানমারের রাখাইন উপকূলের অদূরে বাংলাদেশের সীমানার কাছাকাছি অঞ্চলের অগভীর সাগরতলে প্রাপ্ত বিপুল গ্যাস-ভান্ডার এই তত্ত্বের সত্যতা প্রমাণ করে চলেছে। অথচ, বাংলাদেশ গত কুড়ি বছর ধরে বিশ্বের সবচেয়ে কম অনুসন্ধানকৃত বা স্বল্প-পরীক্ষিত (least explored) অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশের সম্ভাব্য গ্যাসক্ষেত্র সম্পর্কে জরিপ চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের দৃঢ় অভিমত হলো এদেশের স্থলভাগ এবং সাগরতলে এখনো ৩২ টিসিএফ থেকে ৪২ টিসিএফ গ্যাসের ভান্ডার বিদ্যমান রয়েছে। ইউনাইটেড স্টেটস জিউলজিক্যাল সার্ভে এবং পেট্রোবাংলার যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত দু’বছরের একটি মূল্যায়ন প্রকল্পের অভিমত হলো, এদেশের অনাবিষ্কৃত গ্যাস-সম্পদের পরিমাণ কমবেশি ৩২ টিসিএফ হতে পারে। নরওয়ে সরকারের অধীনস্ত নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডাইরক্টেরেট বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের হাইড্রোকার্বণ ইউনিটের সাথে যৌথ জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য অনাবিষ্কৃত গ্যাস-সম্পদ ৩৮-৪২ টিসিএফ হতে পারে। এরপর র‌্যাম্বল নামের একটি ইউরোপীয়ান তেল ও গ্যাস কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান জরিপ চালিয়ে মত দিয়েছে, সম্ভাব্য গ্যাসের পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। তাহলে বাংলাদেশে এত কম গ্যাস-অনুসন্ধান চালানোর কারণ কী? বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় অভিমত হলো, কয়েকজন প্রভাবশালী এলএনজি আমদানিকারকের অন্যায্য কায়েমী স্বার্থ রক্ষার জন্যই বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিরা গ্যাস-অনুসন্ধানকে ‘কোল্ড-স্টোরেজে’ পাঠিয়ে দিয়ে এলএনজি আমদানিকে দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
২০১৫ সালে পেট্রোবাংলা বাংলাদেশের সমুদ্র-অঞ্চলের ২৬টি অনুসন্ধান ব্লকে আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সার্ভিস কোম্পানির মাধ্যমে সিসমিক সার্ভে (মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভে) পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিল, যাতে এই জরিপের মাধ্যমে একটি ডাটাবেজ তৈরি করে তেল কোম্পানিগুলোর সাথে অনুসন্ধানের দর-কষাকষি চালানো যায়। সবচেয়ে উপযুক্ত সার্ভিস কোম্পানি বাছাইয়ের জন্য একটি ‘জাতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটি’ও গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু, কোন অজ্ঞাত কারণে কমিটির বাছাইকৃত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-নরওয়েজিয়ান জয়েন্ট ভেঞ্চার সার্ভিস কোম্পানিকে সরকার বাতিল করে দিয়েছিল। ঐ কোম্পানিটি যখন বাছাইয়ের দ্বিতীয় রাউন্ডের যোগ্যতার পরীক্ষায় আবার উত্তীর্ণ হয়েছিল তখন কোন কারণ-দর্শানো ব্যতিরেকেই পুনরায় পুরো প্রক্রিয়াটি রহস্যজনকভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে, পরবর্তী সাত বছরেও বাংলাদেশের সাগরতলের গ্যাস-অনুসন্ধান প্রক্রিয়াটি আর এগোতে পারেনি। এই সাত বছরে আর একবারও সাগরের ২৬টি ব্লকে ‘সিসমিক সার্ভে’ চালানো হয়নি, কোন তেল-গ্যাস অনুসন্ধানও শুরু করা যায়নি। সাম্প্রতিককালে ভারতের ‘অয়েল এন্ড ন্যাচারাল গ্যাস কর্পোরেশন’কে একটি ব্লকে অনুসন্ধানের দায়িত্ব প্রদান করা হলেও তারা সাত বছরে মাত্র একটি কুপ খনন করেছে। আর কোন আন্তর্জাতিক তেল-গ্যাস কোম্পানিকে এখনো বাংলাদেশের অনুসন্ধান ব্লকগুলো ইজারা দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করা যায়নি। উপরে উল্লিখিত অক্ষম্য ব্যর্থতার দায় কার? বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব তো খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাতে, মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন ডঃ তওফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। প্রতিমন্ত্রী জনাব নসরুল হামিদের হাতে তো মন্ত্রণালয়ের এতবড় গুরুদায়িত্ব থাকার কথা নয়! এ-পর্যায়ে উল্লেখ্য, প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে কয়েক দশকের বিরোধ অত্যন্ত সফলভাবে মোকাবেলা করে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল অন ল’স অব দি সি’স (ইটলস) এবং দি হ্যাগের আন্তর্জাতিক আদালত থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে বাংলাদেশ, যার পুরো কৃতিত্ব শেখ হাসিনার সরকারের। দুঃখজনক হলো, এই বিজয় অর্জনের আট বছর অতিক্রান্ত হলেও শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকারের কর্তাব্যক্তিরা অগ্রাধিকার দিয়ে অবিলম্বে এই বিশাল সমুদ্রসীমা থেকে সম্পদ আহরণ জোরদার করাকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছেন না। গ্যাস অনুসন্ধানে রহস্যজনক বিলম্ব যে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি ঘটিয়ে চলেছে তার দায় কে নেবে?
বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সমুদ্রসীমার অদূরে মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রে বেশ কয়েক বছর পূর্বে প্রায় চার ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট গ্যাস আবিষ্কৃত হয়েছে। ঐ গ্যাস এখন পুরোটাই চীনে রফতানি করছে মিয়ানমার। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ঐ অঞ্চলের নিকটবর্তী বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় একটি ব্লক দক্ষিণ কোরিয়ার দাইউ কোম্পানিকে তেল-গ্যাস আহরণের জন্যে ইজারা দিয়েছিল। দাইউ যথাযথ প্রস্তুতি এবং সরঞ্জাম নিয়ে ঐ অঞ্চলে তেল-গ্যাস এক্সপ্লোরেশন চালাবার জন্যে কয়েকটি জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হলে সেখানে মিয়ানমারের নৌবাহিনী তাদেরকে বাধা দেয় এবং ফিরে আসতে বাধ্য করে। ২০১২ সালের ইটলসের রায়ে ঐ বিরোধপূর্ণ অঞ্চলের মালিকানা এখন পেয়ে গেছে বাংলাদেশ, কিন্তু গত দশ বছরেও ওখানে এখনো কোন নূতন এক্সপ্লোরেশন শুরু করতে পারেনি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোন ইজারাদার কোম্পানি। এই অক্ষম্য বিলম্বের কারণে মিয়ানমার যে এই সমুদ্রাঞ্চলের ভূগর্ভস্থ গ্যাস তুলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে সে গ্যাস তো বাংলাদেশও পেতে পারত! কারণ, সন্নিহিত অঞ্চলগুলোর ভূগর্ভে গ্যাসের মজুদ তো শুধু মিয়ানমারের নিয়ন্ত্রণাধীন সমুদ্রসীমায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় ওখানে গ্যাস পাওয়া যাবেই, এটা প্রায় নিশ্চিত মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। (২০১৯ সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত সাউথ-ইস্ট এশিয়া পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন সোসাইটির বার্ষিক কনফারেন্সে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধান কোম্পানি বাংলাদেশের এসএস-১১ ব্লক সম্পর্কে এ-অভিমত তুলে ধরেছে)।
আর একটি বিষয় সত্যিই দুঃখজনক। বাংলাদেশ প্রতি বছর প্রায় সত্তর লাখ টন পেট্রোলজাত পণ্য আমদানি করলেও ৫৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ইস্টার্ন রিফাইনারির পরিশোধন ক্ষমতা হলো মাত্র ১৫ লাখ টন। বাকি ৫৫ লাখ টন আমাদেরকে রিফাইনড জ্বালানি তেল আমদানি করতে হয়। আরেকটি বৃহত্তর ক্যাপাসিটির রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াটি দশ বছর আগে শুরু করা হলেও রহস্যজনকভাবে সেটা আটকে আছে ভারতীয় কনসালটেন্ট ফার্মের একগুঁয়েমির কারণে। তারা ফ্রান্সের ‘টেকনিপ’ ফার্মটিকে ডিসকোয়ালিফাই করেছে অজ্ঞাত কারণে। বাংলাদেশ সরকার এদ্দিনেও এই সমস্যার সমাধান করতে পারল না! ক্রুড অয়েল আমদানি করে পরিশোধন করলে আমাদের যে খরচ পড়ত এখন তার চাইতে পনেরো/কুড়ি ডলার ব্যারেলপ্রতি বেশি খরচ পড়ছে রিফাইনড অয়েল আমদানি করায়। এমনকি, সম্প্রতি রাশিয়া আমাদেরকে কম দামে ক্রুড অয়েল আমদানির যে সুযোগ দিতে চেয়েছিল তা আমরা নিতে পারিনি রাশিয়ার ‘হেভি ক্রুড’ রিফাইন করার ক্যাপাসিটি ইস্টার্ন রিফাইনারির না থাকায়! ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের মত ‘সাদা হাতি’ প্রকল্প স্থাপন না করে তার চার ভাগের একভাগ খরচে ষাট লাখ ব্যারেল ক্রুড অয়েল পরিশোধনের উপযুক্ত একটি অয়েল রিফাইনারি স্থাপন করলাম না আমরা! এর দায় কার?
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধসচেতনতা ও ভ্যাকসিনেশন দিতে পারে ‘হেপাটাইটিস’ থেকে মুক্তি
পরবর্তী নিবন্ধনেপথ্য ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে কমিশন ডিসেম্বরে